ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নারীর অধিকারের স্বীকৃতিই পারে সকল প্রকার নির্যাতনকে রুখে দিতে

লীনা পারভীন | প্রকাশিত: ১০:১৪ এএম, ২৫ নভেম্বর ২০২১

প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে একটি দিন পালন করা হয়। নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতার অবসানের লক্ষ্যে ১৯৮১ সাল থেকে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসাবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। ১৯৬০ সালে তিনজন নারীর সাথে ঘটে যাওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আলোচনায় আসে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়টি।

এবছর দিনোটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে “Orange the World-End Violence against Women now”. এখানে কমলা রঙটিকে নারীর জ্বলে উঠা এবং নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত ভবিষ্যতের কথা মনে করার প্রতিক হিসেবে বুঝানো হয়েছে। জাতসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি তিনজনে একজন করে নারী কোন না কোনভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক করোনাকালীন এর ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৩ টি দেশের উপর করা এক জরিপের ফলাফলে ইউ এন উইমেন বলছে প্রতি ৩ জনের ২ জন নারী খাদ্য সংকটসহ আরও নানারকম সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। কিন্তু এর পুরোটাই প্রকাশিত নয়। মাত্র প্রতি ১০ জনে ১ জন নারী তাদের অভিযোগ নিয়ে আইনের মুখোমুখি হচ্ছে।

নারীর প্রতি সহিংসতার এই চিত্র সার্বজনীন। কেবল বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে তা নয়। অথবা, কেবল বাংলাদেশের নারীরাই দুর্বল বা অসচেতন বিষয়টা তেমন আর থাকছে না। আমরা দেখেছি করোনাকালীন গোটা বিশ্ব গৃহবন্দী ছিল, সবাই একটা অজানা আতংকে ছিল। মৃত্যুভয়ে থাকা সময়টাতেও নারী ও শিশু নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে আশংকাজনক হারে। একদিকে একহাতে সংসারের সকল কাজ কর্ম সম্পাদন, সন্তানের দেখভাল করা অন্যদিকে সংসারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্গতিও নারীকেই সামাল দিতে হয়েছে।

প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে আমরা নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া নানাধরনের সহিংসতার ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছি। গৃহ নির্যাতন, গণপরিবহনে নির্যাতন, কর্মস্থলে নির্যাতন, রাস্তাঘাটে নির্যাতন। কোথায় হচ্ছেনা নারী নির্যাতন? কিন্তু এ যেন কমছেই না। বাংলাদেশে কিছুদিন আগে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। একই উসিলায় বাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য যে অর্ধেক ভাড়ার সুবিধা ছিল সেটি উঠিয়ে দিয়েছে। সেটি নিয়ে আন্দোলন চলছে। কিন্তু ভয়াবহ যে ঘটনাটি ঘটে গেলো সেটিও ঘটেছে একজন নারীরর উপরেই। জানা গেছে, একজন নারী শিক্ষার্থী বাসে হাফ ভাড়া নেয়ার দাবি করলে বাসের হেল্পার তাকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। কত সহজ হয়ে গেছে আজকাল নারীকে ধর্ষণ করতে চাওয়া। নারীরা কি এতই ফেলনা হয়ে গেলো আমাদের সমাজে? এই ঘটনাটি কি আমাদের বিবেককে নাড়া দিবেনা একটুও? সেই বাসের হেলপারকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু একজন পুরুষ হেলপারের মগজে একজন নারীর প্রতি যে ভয়াবহ বিদ্বেষ বাসা বেঁধেছে এর প্রতিকার কী?

নারীকে কেন্দ্র করে দিবস আছে অনেক। নারী দিবস, মা দিবস, সহিংসতা প্রতিরোধ দিবস। এমনকি বিভিন্ন মহিয়সী নারীদের জন্ম বা মৃত্যুদিনেও আমরা নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা বা নারীর মর্যাদা নিয়েই আলোচনা করে থাকি। এতে করে ফলাফল কতটা পরিবর্তন হচ্ছে? ২৫ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর জাতিসংঘ কর্মসূচি ঘোষণা করে। আমাদের দেশের সরকারও এই দিবসকে কেন্দ্র করে বাণী দেয়। কর্মসূচি ঘোষণা করে। কিন্তু দিবসকেন্দ্রিক সেইসব আলোচনা বাস্তবে কতটা কার্যকর হচ্ছে?

করোনাকালে দেশে বাল্যবিবাহ বেড়েছে মারাত্মক হারে। বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। পরিবার তাদের কন্যা সন্তানকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর চেয়ে বিয়ে দেয়াতেই সমাধান মনে করছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেলো আর্থিক সংকটের পাশাপাশি নারীর নিরাপত্তা একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবারের লোকজন এই সমাজে তাদের কন্যাসন্তানকে নিরাপদ মনে করছেনা। এই মনস্তত্ত্বের পিছনে রয়েছে অনেক কারণ। আমি উপরে যে ঘটনাটি বললাম সেটির মধ্যেই রয়েছে অনিরাপত্তার কারণ। নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনার কোন দৃষ্টান্তমূলক বিচার আমরা করতে পারিনি। যে পরিমাণ নারী কর্মসূত্রে বাইরে এসেছে বা আসছে তাদের জন্য একটি নিরাপদ সামাজিক ব্যবস্থার কোন পরিকল্পনা কোথাও নেই।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশ হিসেবেই আমাদের দেশের নারীসমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যা ঘটার ঘটছে। একটি পরিকল্পিত উন্নয়ন ছকের কথা আমরা বলে আসছি অনেকদিন ধরেই। সেই কাজটি আজও হয়নি। আর হয়নি বলেই নানা অজুহাতে সামাজিকভাবে নারীর প্রতি একধরণের নেতিবাচক মনোভাবের চাষ হচ্ছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন সময়ে নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে চলছে নারীর প্রতি বিষোদ্গার। নারীর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ নিয়ে হরহামেশাই চলে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য। সেসবের বিরুদ্ধে কখনও কোন আইনি পদক্ষেপ চোখে পড়েনি অথচ মিথ্যা বা গুজব প্রচার করে ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে নানাজনকে গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। এই যে এতসব ঘটনার বর্ণনা সেগুলো এখন সবারই জানা। কিন্তু কাজের কাজটি হচ্ছে না কোনদিকেই।

দিবস আসে দিবস চলে যায়। ঘটনা কিন্তু থামছে না। কেন? একই কথা প্রতিবছর লিখেই যাচ্ছি। কোন পরিবর্তন কি হয়েছে কোথাও? এর কারণ বিশ্লেষণ করা দরকার। আমাদেরকে একটু কার্যকারণের দিকেও মনোযোগী হওয়া দরকার। কেন থামছে না নারীর প্রতি সহিংসতা? কোথায় ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে? বাস্তবে সমস্যা আমাদের মানসিকতায়। সমস্যা নারীকে মানুষ মনে না করায়। সমস্যা নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতাকে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে স্বীকৃতি না দেয়ায়।

নারীরা এখনও তাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে নিজের অধিকার পায়নি। রাস্তাঘাটে একজন পুরুষ নিজের মত করে চলতে পারলেও পারেনা একজন নারী। কারণ সমাজ এখনও নারীকে মনে করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক যাদের প্রতিবাদের ক্ষমতা নেই, আইনের লড়াই করার সাহস নেই। নারীকে সেই সাহস দিতে পারে একমাত্র রাষ্ট্র। এর জন্য দরকার নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সকল সহিংস ঘটনার সঠিক সময়ে বিচার নিশ্চিত করা এবং সমাজে নারীর অধিকার মানবাধিকার বলে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে নারীর প্রতি একটি ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করা।

লেখক : কলামিস্ট, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন