ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্রমাণ করুন, আপনি অবিবাহিত!

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৫৪ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০২১

মাজেদুল নয়ন

জুলাই মাসের শুরুর দিক। চার বছরের প্রেমের দেড় বছরই যখন করোনা খেয়ে দিচ্ছে, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার তবে বিয়ে করা প্রয়োজন। থাই নারীর নাম কানালাউই ওয়ায়েক্লেহং, ডাক নাম ‘পে’। আবদার করে বসলো, বিয়ে যে ধর্ম অনুসারেই হোক না কেন, নিবন্ধন করতে হবে থাইল্যান্ডের রীতিতে। রাজার দেশের কন্যা বলে কথা। মেনে নিলাম। ব্যাংককে বসেই ঢাকায় অবস্থিত থাই অ্যাম্বাসিতে পে ইমেইল করে জানতে চাইলো, তাকে বিয়ে করতে হলে বাংলাদেশে ছেলের কী কী কাগজের প্রয়োজন।

দূতাবাসের ফিরতি ইমেইলটি আমাকে ফরোয়ার্ড করলো পে। সেই তালিকায় শুধু দুটি জিনিসই নতুন মনে হলো। একটি হচ্ছে ‘সিঙ্গেল সার্টিফিকেট’ আরেকটি ‘জাতীয় পরিচয়পত্র সত্যায়ন’। সিঙ্গেল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে, ‘আমি অবিবাহিত’।

স্বজন এবং বন্ধু ছাড়াও আমার পরিমণ্ডল এবং সূর্য-চন্দ্র সাক্ষী রয়েছে, এই জনমে কখনোই আমি কাজী অফিসে বসিনি বা অন্য কোনো উপায়ে মানবিক বা বাস্তবিক বিয়ে করিনি। তাই নিজেকে অবিবাহিত প্রমাণ করা যে কঠিন কিছু নয়, সেটি ধরে আমরা বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে ফেললাম। আর ডিজিটাল এই বাংলাদেশে নিশ্চয়ই এমন কোনো ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর বসালেই মিলবে আমার অবিবাহিতের প্রমাণ। বিষয়টিকে এতটাই সহজ ভেবেছিলাম আমি।

মহামারির আগে যখন আমরা ঢাকা-ব্যাংকক যাতায়াত করতাম, যাওয়া আসার ভাড়া ছিল ১৪ হাজার টাকা। অথচ এবার ৩১ জুলাই পে’কে ঢাকায় আসার টিকিট কাটতে গুনতে হলো ৩৯ হাজার টাকা। যাই হোক, বিয়ের জন্য মনের ভেতর যখন ধেই ধেই করে দোলনা দুলে যাচ্ছে, তখন এই অর্থ বড় বিষয় নয়। করোনায় বেঁচে থাকাই যেখানে মুখ্য, সেখানে বিয়ের জন্য দু-একটি কিডনি হয়তো বিক্রি করে আইফোন ১৪ না হলেও বিমানের টিকিট কেনা যায়।

দূতাবাস থেকে পে’কে জানিয়ে দেয়া হলো ঢাকায় কিন্তু কাগজপত্র পেতে অনেক দেরি হয়। তোমরা সব কাগজ জোগাড় করলে আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের আয়োজন করে ফেলবো। পে যখন আমাকে এই কথাটি বললো, আমি তো রেগে মেগে আগুন। ঢাকায় এই থাই দূতাবাসের তো দেখি ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই! ফোন কেটেই ঢুকে গেলাম প্রত্যয়ন ওয়েবসাইটে। দু-চার মিনিটের মধ্যেই পেয়ে গেলাম কাঙ্ক্ষিত ‘বৈবাহিক অবস্থা’ প্রমাণের সনদ। কিন্তু সেই ফরমটি পূরণ করার আগে জাতীয় ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হয়। সেটি করলাম। এরপর গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা সব বসিয়ে যখন ফরমটি ডাউনলোড করবো সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না। নেটওয়ার্কের সমস্যা বা আমার ল্যাপটপের সমস্যা ভেবে বারবার চেষ্টা করতে লাগলাম।

প্রায় অর্ধেক দিন যখন এভাবে অতিবাহিত করলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন দেওয়ার। হেল্পলাইনে ফোন দেয়ায় অন্য পাশ থেকে যখন ‘হ্যালো’ ধমক শুনলাম। সত্যি অবাক হলাম! এর আগের সরকারের এ ধরনের মন্ত্রণালয় বা দপ্তরে ফোন দিয়ে কখনোই ওপাশ থেকে কারও ‘হ্যালো’ শব্দ শুনিনি।

ধমক খেয়ে জানালাম কী কারণে ফোন দিয়েছি। অন্য পাশ থেকে বললেন, ইউনিয়ন অফিস এই প্রত্ায়নপত্র দিতে পারে না। আর অনলাইনেও হবে না। জেলা প্রশাসক অফিসের প্রবাসী কল্যাণ শাখায় যোগাযোগ করতে বললেন।
এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের বংশকে নির্মূল করতে সরকার থেকে শাটডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কোরবানির ঈদের আগে ১৫ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এই শাটডাউন আবার শিথিল রয়েছে। বিন্দুমাত্র দেরি না করে ১৫ জুলাইতেই চলে গেলাম ঢাকার জেলা প্রশাসক অফিসে। এ ধরনের কাজে তখনো জেলা প্রশাসনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ অফিসে লোকজন কম। ব্যস্ততাও অনেক কম।

প্রবাসী কল্যাণ শাখার একজন কর্মচারী পুরো বিষয়টি সহজেই আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, আপনার নিজেকে অবিবাহিত প্রমাণ করা খুবই সহজ একটি বিষয়। তবে এতে সাধারণত ৫ থেকে ৬ মাস সময় লাগে। এর চেয়ে আপনি বিয়ে করে ফেলেন, সেটা এক ঘণ্টায়ই সম্ভব! তবে প্রশাসনসহ সব বিভাগে আমার বন্ধুর ভাগ্য অনেক ভালো ধারণা নিয়ে প্রত্যয়নপত্রের আবেদন করলাম এবং ১৫ দিনেই পাবো বলেও একটা ধারণা করলাম। কারণ মনে হলো বিষয়টা পাসপোর্টের মতোই। আবেদনের আগে ব্যাংকে গিয়ে ৭০০ টাকা জমা দিয়ে চালান নিয়ে আসতে হলো। এবার কি আবেদন করতে পারবো?

উত্তর, না। এবার আমাকে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে আমার ছবিসহ একটি নোটারি করতে হলো যে আমি অবিবাহিত এবং আমার নামের মানুষটি আমি নিজেই। এই নোটারির সঙ্গে ব্যাংক চালান, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধনের সব কপি যখন জমা দিলাম, তখনো আরেকটি কাগজ বাকি। সেটি হচ্ছে নাগরিকত্বের সনদপত্র। ওই শাখায় জানালাম, আমার স্থায়ী ঠিকানার ইউনিয়ন অফিস থেকে নাগরিকত্বের সনদপত্র নেওয়া আছে। কিন্তু কর্তব্যরত ব্যক্তি জানালেন, তাহলে আপনার গ্রামে স্পেশাল ব্রাঞ্চের তদন্ত হবে। আরেক ঝামেলা! এর চেয়ে আপনি বর্তমান ঠিকানার ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস থেকে একটি নাগরিকত্বের সনদপত্র নিয়ে আসেন।

অগত্যা পরের রোববার ১০০ টাকার বিনিময়ে একটি নাগরিকত্বের সনদপত্র জোগাড় করলাম কাউন্সিলর অফিস থেকে। প্রশ্ন করতে পারেন, একশ টাকা দিলাম কেন? উত্তর হচ্ছে, নাহলে সেদিন কাজ শেষ করে পরের দিন আবার যেতে বলেছিল। সবকিছু জমা দেওয়া হলে গেলাম জেলা প্রশাসক অফিসে। এরপর শুধুই অপেক্ষা। প্রশাসনের কয়েকজন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির স্বাক্ষর হয়ে আমার আবেদনটি সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে যাবে। তবে শাটডাউনসহ ঈদের ছুটি মিলিয়ে এ স্বাক্ষরটি হতে লাগলো ১৬ দিন। এর মধ্যেই আমাকে বিবাহ করার জন্য থাই তরুণীও দেশে এসে হাজির। কিন্তু এখনো আমি নিজেকে অবিবাহিত প্রমাণ করতে পারলাম না।

সরকারি বার্তা প্রেরকের মাধ্যমে পৌঁছাতে দেরি হতে পারে, এই ভয়ে নিজেই ওই আবেদনপত্রটি বয়ে নিয়ে গেলাম সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে। সেখান থেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্তার স্বাক্ষর পেলে এ আবেদনপত্রটি যাবে মালিবাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে। কিন্তু সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিস থেকে আর আবেদনপত্রটির হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক পরিচিত ব্যক্তিকে দিয়ে বললাম। কোনোভাবেই কিছু হচ্ছে না। এখনো নাকি স্বাক্ষরও হয়নি। আমি এসবি অফিসে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি, এখনো সিটি এসবি অফিস থেকে যায়নি আবেদন।

প্রায় ২৩ দিন পর নিজে গেলাম খোঁজ নিতে। কাকরাইলের সিটি এসবি অফিসে দায়িত্বরত ব্যক্তিকে আবেদনপত্রের স্মারক নম্বর দিলাম। বললেন, দুপুরের পর আসেন। সেই দুপুরের পর অপেক্ষা করতে করতে প্রায় বিকেল। এমন সময় জানানো হলো আপনার এই কাগজ তো গত ৮ সেপ্টেম্বরই স্বাক্ষর হয়ে গেছে। আপনি একবার আসবেন না? আর এই সিটি এসবি অফিসে পুলিশের বড় কর্তাদের দিয়ে না বলে ছোটদের দিয়ে বলান। কাজ হবে।

আমি বললাম, আমি আসবো কেন আর ফোনই বা দেওয়াতে হবে কেন? স্বাক্ষর হয়ে গেলে এসবি অফিসে পাঠালেন না কেন? বললো, যাই হোক। চিন্তুা করবেন না। তিন-চারদিনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে।

অবশেষে পকেট থেকে কিছু দেওয়ার পর আবেদনপত্রটি সেই বিকেলেই পৌঁছে গেলো মালিবাগের এসবি অফিসে। একেবারে আমার হোয়াটসঅ্যাপে চিঠির স্মারক নম্বরও চলে আসলো।

এদিকে প্রায় এক মাস হয়ে গেলো থাই কন্যার বাংলাদেশে অবস্থান। বোঝাই গেলো এক মাসে আমার পক্ষে নিজেকে অবিবাহিত প্রমাণ করা সম্ভব নয়। পে’র ভিসার মেয়াদ আরও এক মাসের জন্য বাড়াতে গেলাম। সে নিমন্ত্রণের গল্প না হয় আরেকদিন শোনাবো।

ঢাকায় আমার নতুন বাসায় আসলেন এসবির তদন্ত কর্মকর্তা। আমার বাসায় পে’কে দেখে বললেন, আপনি তো সিঙ্গেল না। তাহলে অবিবাহিত সার্টিফিকেট কীভাবে পাবেন!

উত্তরে আমি জানালাম, ভাই বিয়ের নিবন্ধন করতে হলে এই সার্টিফিকেট লাগবে। আমাদের দুজনকে বসিয়ে বেশি কিছুক্ষণ জেরা করার পর তদন্ত কর্মকর্তা বললেন, আমি আপনাদের উত্তরে সন্তুষ্ট। তবে আপনার এলাকায় একটি তদন্তের আবেদন পাঠানো হবে। অনেক অনুরোধের পরেও সেই তদন্ত আটকানো গেলো না। আমি বারবার বললাম, ভাই, মেয়েটার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনারা আমার অফিস এবং অন্যান্য নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একটু দ্রুত খবর নিন।

এর মধ্যেই আমার বাবা, বড় ভাই থেকেও লিখিত প্রত্যায়ন আনা হলো যে আমি অবিবাহিত। ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে আবারো নাগরিকত্বের সনদ জোগাড় করে দেওয়া হলো।

এই তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, এক সপ্তাহের মধ্যেই আমার জেলা লক্ষ্মীপুরের স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে আমার বাড়িতে গিয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট পাঠানো হবে। তবে সেই রিপোর্ট আসতে লাগলো আরও ২৪ দিন। আমি ১৫ দিনের মাথায় যখন লক্ষ্মীপুরের তদন্ত কর্মকর্তাকে ফোন দিলাম, তিনি বললেন, ‘আরে আপনার ফোনের জ্বালাতেই তো আমি কাজ করতে পারি না।’ উত্তরে বললাম, ‘ভাই ১৫ দিন হওয়ার পর আপনাকে ফোন দিয়েছি!’ এরপর ফোন কেটে দিয়েছিলেন তিনি।

সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে যখন ঢাকার মালিবাগের এসবি অফিসে তদন্ত রিপোর্ট আসলো জেলা থেকে, ততদিনে পে’র দ্বিতীয় পর্যায়েও ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। এবার আর ভিসার মেয়াদ বাড়লো না। বরং সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে প্রতিদিনের জন্য ২০০ এবং ৫০০ টাকা জরিমানা দিয়ে থাকতে হবে তাকে।

বেশ কয়েকবার আমি এবং পে সিদ্ধান্ত নেই এই ঝামেলার বিয়ে আর করার দরকার নেই। বরং পে ফিরে যাক। পরক্ষণেই আবার ভাবি যে এতটুকু যেহেতু করলাম আরও করি। শেষটা দেখেই নেই।

ঢাকার এসবি অফিসের তদন্ত কর্মকর্তা তার সবটুকু আন্তরিকতা দিয়ে প্রতিবেদনটি পাঠালেন আবার ঢাকা জেলা প্রশাসক অফিসে। কিন্তু এ মালিবাগেই আবারো সময় কেটে গেলো ১০ দিন। দায়িত্বরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পেতে যেতে হলো আরও দুদিন। তিনি সুন্দর ব্যবহার করলেন, লাল চা খাওয়ালেন। কিন্তু সময় কমলো না।

ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রবাসী কল্যাণ শাখায় এসবি থেকে প্রতিবেদন গেলো ২৩ সেপ্টেম্বর। এরপর সেখানকার সবার সহযোগিতা আর আন্তরিকতায় সময় লাগলো আরও ১২ দিন। তবে সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন বললেন, ভাই আপনি খুব ভাগ্যবান যে এই সার্টিফিকেট এতো কম সময়ে পেলেন। আমি জানতে চাইলান, ৮০ দিন কম সময়! তিনি উত্তরে বললেন, এটা পেতে সাধারণত ৫ থেকে ৬ মাস লাগার কথা।

শেষ দিনগুলোতে হয়রানির শিকার হতে হতে আমার শুধু একটা প্রশ্নই মনে আসছিল, ডিজিটাল বাংলাদেশে একজন মানুষ বিবাহিত কি না সেটির কোনো তথ্য সন্নিবেশন নেই! যেখানে জাতীয় পরিচয়পত্র বা নাম ঠিকানা দিলে জানা যায়, এই লোক বিবাহিত কি না!? পরে জানলাম, আসলেই এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তাহলে এ বিয়ে নিবন্ধনের কাজ কী? শুধু কাবিননামা পকেটে নিয়ে যেন কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়া যায়! সেটা!

এই দীর্ঘ লেখা যারা পড়বেন, তাদের মধ্যে যদি অবিবাহিত কেউ থাকেন এবং কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করে বলেন, নিজেকে অবিবাহিত প্রমাণ করুন। সেই চ্যালেঞ্জ ভুলেও গ্রহণ করবেন না। এর চেয়ে বিয়ে করে ফেলুন।

লেখক : সাংবাদিক

এইচআর/জিকেএস