ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শান্তি প্রতিষ্ঠার এক গর্বিত নাম বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:০৯ এএম, ২১ নভেম্বর ২০২১

তাপস হালদার

বাঙালি জাতির সর্ব শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদেরও মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে উত্তাল হয়ে উঠে সারা বাংলাদেশইবাংলাদেশ। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি ২৫ মার্চের মধ্য রাতে বাঙালিদের উপর শুরু করে গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পূর্বে তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনা সদস্যরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল যশোর সেনানিবাসে, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল জয়দেবপুরে, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল সৈয়দপুরে, চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল কুমিল্লায় ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করে এবং সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীকে। তাঁর অধীনে পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়হয়েই। প্রতিটি সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, তারা প্রত্যেকেই পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ ত্যাগকারী বাঙালি সদস্য। এছাড়া হাজার হাজার বাঙালি সদস্যরা যার যার অবস্থান থেকে যুদ্ধ শুরু করে দেন। কিন্তু ২১ নভেম্বর সেই ঐতিহাসিক দিন,যেদিন সেনাবাহিনী,নৌ-বাহিনী ও বিমান বাহিনী সম্মিলিত ভাবে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তিন বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমনের মুখে দ্রুতই পিছু হটতে শুরু করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। এক পর্যায়ে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। গৌরবময় দিনটিকে স্মরণীয় রাখতে প্রতি বছর পালিত হয় ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস।’ আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে দিবসটি সম্মিলিতভাবে পালন হয়ে আসছে। এর আগে সেনা বাহিনী ২৫ মার্চ, বিমান বাহিনী ২৮ সেপ্টেম্বর ও নৌ বাহিনী ১০ ডিসেস্বর আলাদা আলাদা ভাবে দিবসটি পালন করতো। পরবর্তীতে ২১ নভেম্বরের তাৎপর্যকে সমুন্নত রাখতে সম্মিলিত ভাবে সশস্ত্র দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে সীমিত সম্পদ নিয়ে উন্নত পেশাদার বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে তৈরি করেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, কম্বাইন্ড আর্মস স্কুল এবং সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোরের জন্য স্বতন্ত্র ট্রেনিং সেন্টার। আধুনিক ও যুগোপযোগী পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে প্রণয়ন করেন জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সশস্ত্র বাহিনী একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষা, বন্যা, টর্নেডো, সাইক্লোন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ত্রাণ ও উদ্ধার কার্য পরিচালনায় বেসামরিক প্রশাসনকে কার্যকর সহায়তা প্রদান করে থাকে। এছাড়া ছবিসহ ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র, মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো তৈরিতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

বাংলাদেশের প্রতিটি বৃহৎ অবকাঠামো তৈরিতে কাজ করছে সশস্ত্র বাহিনী। পদ্মা সেতু, হাতিরঝিল প্রকল্প, জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণ, ফ্লাইওভার ও আন্ডারপাস নির্মাণ, কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কসহ অসংখ্য বৃহৎ স্থাপনা নির্মাণে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী।

শুধু দেশের মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক বিশ্বেও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকাণ্ড বিশেষ ভাবে প্রশংসিত। জাতিসংঘের ৬৮টি মিশনের মধ্যে অন্তত ৫৪টিতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। জাতিসংঘের ৭৫ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সংস্থাটি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশই শান্তিরক্ষী প্রেরণে এক নম্বর সদস্য।জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, হাইতি, লেবানন, কঙ্গো, নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা, লাইবেরিয়া,তাজিকিস্তান, কসোভো, জর্জিয়া,পূর্ব তিমুর, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী সশস্ত্র বাহিনী শান্তি রক্ষার পাশাপাশি সেই সব দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে।

বৈশ্বিক করোনা মহামারি কালে অন্য সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে লকডাউন কার্যক্রম বাস্তবায়ন,সাধারণ মানুষের মধ্যে মহামারি প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি, রাস্তাঘাট স্যানিটাইজার করা, বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণ, দুঃস্থ ও অসহায় পরিবারকে মানবিক সহায়তা এবং মেডিকেল ক্যাম্প কিংবা অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করে সহায়তা প্রদান করেন। বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত জনপ্রতিনিধি, চিকিৎসক, শিক্ষক, বিশিষ্টজনসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করেছে। বিদেশে আটকে পড়া ব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ১৭টি ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশ বিমান বাহিনী মালদ্বীপে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের জন্য একটি মেডিকেল টিম ও করোনা চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে।

বিভিন্ন জেলায় কর্মহীন গরিব ও অসহায় মানুষের মাঝে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পৌঁছে দিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হয় 'এক মিনিটের বাজার', 'সম্প্রীতির বাজার', 'সেনা বাজার'। এসব বাজার থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী ও কাঁচাবাজার স্বল্প মূল্যে জনগণের মাঝে বিক্রি করা হয়। এমনকি রোজার সময়ে দুস্থ ও নিম্ন আয়ের পরিবারকে বিনামূল্যে ইফতার প্রদান করতে আয়োজন করা হয়েছিল 'সম্প্রীতি ইফতার'।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের অহংকার ও গৌরবের প্রতীক। এখনও বাংলাদেশের জনগনের আস্তার প্রতীক সশস্ত্র বাহিনী। যেকোন সংকটে অতন্ত্র প্রহরীর মতো জনগণের পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। একাত্তর সালে যেভাবে জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল, ঠিক তেমনি ভিশন -৪১ বাস্তবায়নেও সরকারের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।

শুধু দেশই নয়, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনেও বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠার গর্বিত নাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বির্নিমাণে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও সশস্ত্র বাহিনী জনগণের পাশে থেকে কাজ করবে আজকের এই শুভ দিনে সেই প্রত্যাশাই করি।

লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
haldertapas80@gmail

এইচআর/এমএস