ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তিতা কথা

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ১০:৩১ এএম, ১৮ নভেম্বর ২০২১

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন দেখছিলাম ১৭ নভেম্বর ২০২১। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ তার অংশগ্রহণ এবং লন্ডন ও ফ্রান্সে দুই সপ্তাহের সফর নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলন। সবকিছু ভালোই চলছিল, কিছু তৈলাক্ত, কিছু জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাবও দিচ্ছিলেন তিনি গুড মুডে। কিন্তু সবকিছু তিতা করে দিয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগদান সংক্রান্ত এক প্রশ্ন। তিনি এতে এতটা ক্ষুব্ধ, বিরক্ত এবং অতীতের তিক্ত স্মৃতিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন যে, এরপর আর কোনো প্রশ্ন নেননি। নিজেই বলে দিলেন- সংবাদ সম্মেলন শেষ।

খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, খালেদা জিয়ার জন্য আমি আমার নির্বাহী ক্ষমতা বলে যা করতে পারি তাই করেছি, আইন পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবে।’ ‘আমরা অমানুষ না। অমানুষ না বলেই তাকে অন্তত তার বাসায় থাকার ব্যবস্থাটুকু, নির্বাহী ক্ষমতা আমার হাতে যতটুকু আছে, আমি সেটুকু দিয়ে তাকে বাসায় থাকার, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বাকিটা আইনগত ব্যাপার। আর কত চান?’

জাতির পিতার খুনিদের পুরস্কৃত করার পরও তার সরকার খালেদা জিয়াকে মানবতা দেখিয়েছে অভিমত ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার বাবা, মা, ভাই এমনকি ছোট্ট রাসেলকে পর্যন্ত হত্যা করেছে। তারপরও তাকে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেছি। কারণ আমরা অমানুষ নই।’

অনেকের মনে আছে হয়তো, খালেদা জিয়া এর আগেও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন। দীর্ঘদিনব্যাপী তিনি পায়ের রোগে, চোখের রোগে ভুগছিলেন। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি যখন চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান তখন কিন্তু তিনি সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন না, অভিযুক্ত ছিলেন। এখন তার শারীরিক পরিস্থিতি আরও জটিল।

এতিমখানার জন্য টাকা এসেছে বিদেশ থেকে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়া সে টাকা এতিমখানার খাতে খরচ করেননি। আবার এতিমখানার অ্যাকাউন্টেও টাকাটা নেই। টাকাটা ছিল তার জিম্মায়। সুতরাং আইনি দৃষ্টিতে টাকাটা তিনি নিজে আত্মসাৎ করেছেন এ কথা আদালত নয়- গ্রাম্য সালিশ বসালেও বলবে। তখন হয়তোবা তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে বিচারের রায়ে তার শাস্তি হবে। রায়ের পর তার জেল হলে দল যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে সে সম্পর্কেও মা-ছেলের পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের জরুরি ছিল তখন।

বেগম জিয়া ১৫০ বার সময় প্রার্থনা করে তিনবার বিচারিক আদালতের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে নিজেকে কঠিন মামলাবাজ হিসেবে প্রকাশ করেও সাজা এড়াতে পারেননি। শুধু দীর্ঘ আট বছর আদালতের সময় বরবাদ করেছেন।

দেশে ফিরে এসে ওই দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে তিন বছর আগে কারাগারে গেছেন। গত বছর মার্চে করোনাভাইরাসের কারণে সরকার দণ্ডের কার্যকারিতা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেয়। শর্তানুযায়ী তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না। তবে তার বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন।

তবে পরিস্থিতির কারণে খালেদা জিয়া তিনদফায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। সর্বশেষ ১৩ নভেম্বর একই হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। এবারের পরিস্থিতি আগের চেয়ে নাজুক বলে হয়তো কেউ ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি বিশেষ অনুকম্পা দেখাবেন।

বাস্তবে মনে হচ্ছে তা সম্ভব না। প্রধানমন্ত্রী বারবার তাকে হত্যাপ্রচেষ্টায় খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উত্থাপন করে উল্টো প্রশ্নকারী সাংবাদিককে প্রশ্ন করেন, আপনাকে কেউ হত্যার চেষ্টা করলে আপনি কি তাকে ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে আসতেন? বা আপনার পরিবারকে কেউ হত্যার পর বিচার না করে সেই খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করতো তাহলে কী করতেন?

প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে খালেদা সরকারের হিংসাত্মক কাজের কয়েকটি উদাহরণ দেন। ‘৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে জাতির পিতার খুনি রশিদকে সংসদ সদস্য করে বিরোধী দলের নেতার আসনে বসানো, জাতির পিতার অপর খুনি খায়রুজ্জামানকে তার বিচারের রায় হওয়ার সময় নতুন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেওয়া এবং রাষ্ট্রদূত করা, মারা যাওয়া অপর খুনি পাশাকে মারা যাওয়ার পর প্রমোশন দিয়ে সবধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান- এর অন্যতম।

খালেদা জিয়া রাজনীতি করেন এবং রাজনীতিতে তিনি সরকারি দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছে মনে হতে পারে একজন অসুস্থ ব্যক্তির প্রতি প্রধানমন্ত্রী আরও সদয় হলেই পারেন। তিনি তো অনেক মানবতাবাদী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মূল কথার সঙ্গে, বা তিনি কেন এর বেশি সদয় হতে পারেন সেই যুক্তির সঙ্গে কারও দ্বিমতেরও সুযোগ নেই। বিএনপি শুধু ‘৭৫ এর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের পুরস্কৃতই করেনি তার প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির নেতৃত্ব বিলীন করতে সচেষ্ট ছিল।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সংসদ নেত্রী খালেদা জিয়া সংসদে দাঁড়িয়ে এমন নির্মম রসিকতাও করেছেন যে- সেই গ্রেনেড তিনিই ভ্যানিটি ব্যাগে করে এনে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। উনাকে মারতে যাবে কে। এমনকি গ্রেনেড হামলায় দলের ২২ জন নেতাকর্মী মারা যাওয়া এবং বিপুল সংখ্যক আহত হওয়ার পরও এই বিষয়ে সংসদে একদিন আলোচনা পর্যন্ত করতে দেয়নি আওয়ামী লীগকে। ‘ভোটারহীন নির্বাচনের সরকার’ থেকে বিএনপির ভোটারপূর্ণ নির্বাচনের সেই সরকার কোন অর্থে উন্নত ছিল তাহলে?

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব তিক্ত কথা স্মরণ করিয়ে দেন সবাইকে। আর বলেন, খালেদা জিয়ার জন্য যারা তাকে দয়া দেখাতে বলেন তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে প্রচলিত প্রবাদ ‘রাখে আল্লাহ মারে কে,’ উল্লেখ করে এর উল্টোটাও উচ্চারণ করেন, ‘মারে আল্লাহ রাখে কে?’ প্রথমটা তিনি নিজের বেলায় টানেন, যেখানে তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেও এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার মারতে পারেনি। পরেরটা কার জন্য বলেছেন সহজে অনুমেয়।

মনে হচ্ছে দেশে বর্তমানে খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া আর বিএনপির মতো এত অসহায় অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক নেতা বা দলকে সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও খেলতেন। প্রতিপক্ষকে বিদায় করার জন্য ফাঁসি দিতেও দ্বিধা করতেন না। শেষ পর্যন্ত তার জীবনাবসান হয়েছে খুবই করুণভাবে।

বেগম জিয়া দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলে তারেক জিয়া হাওয়া ভবন প্রতিষ্ঠা করে বাবার পথেই হেঁটেছিলেন। এখন খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া এবং বিএনপি যেসব দুর্যোগের মোকাবিলা করছে তা তাদের পূর্বের কর্মকাণ্ডের ফলাফল। এখন তাদের হাতে অসংগঠিত জনসমর্থন ছাড়া আর কোনো পুঁজি নেই।

আমার দেখায়, ক্ষমতায় না থাকলে রাজনীতিবিদদের রোগ বেশি থাকে। আবার ক্ষমতায় ফিরে এলে সুস্থ হয়ে যান তারা। তখন রাষ্ট্রের টাকায় হাঁচি-কাশির জন্যও তারা বিদেশে চিকিৎসা নেন। বেগম জিয়া এখনো যেটুকু সচল আছেন তাও রাষ্ট্রক্ষমতার মোহে পড়ে। এ নেশা ছুটে গেলে তিনি হয়তো আরও শয্যাশায়ী হয়ে পড়বেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের আইনের পথে হাঁটতে বলেছেন। এই হাঁটায় পথ কবে শেষ হবে কে জানে!

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]

এইচআর/এএসএম