‘নির্বাচন আইসিইউতে, গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে’ ইসি কোথায়?
আমাদের দেশের নির্বাচনে যতো ধরনের সহিংসতা হয় তার প্রায় প্রত্যেকটিই হয়েছে এবারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে। সংঘাত, সংঘর্ষ, হামলা, গোলাগুলি ও ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা সহিংসতায় পূর্ণ ছিল এ নির্বাচন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৩৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
এদেশে একসময় নির্বাচন একটি উৎসবই ছিল। এই উৎসব বেশি উদযাপিত হতো স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। এছাড়া অন্যান্য নির্বাচনও স্থানীয়ভাবে উৎসবমুখর পরিবেশেই উদযাপিত হতো। তবে, সহিংসতা বা প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনাও যে ঘটতো না তা নয়। তবে তা ব্যাপকহারে নয়। এসব নির্বাচনে সহিংসতা বা নির্বাচনী বিশৃঙ্খলা হলেও নির্বাচনের ওপর নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত ছিল। পুলিশ ও প্রশাসন এসব সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাচনের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতো। এটিই কাম্য ছিল। কারণ, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, তবে সরকার বা নির্বাচন কমিশনের কাজ হচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। সেই প্রস্তুতি, ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি কমিশনের থাকা চাই।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আগে নির্দলীয়ভাবে হতো। বর্তমান সরকার ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই থেকে জাতীয় রাজনীতির চিরচেনা সংঘাত-সংঘর্ষ স্থানীয় নির্বাচনেও বিরাজ করতে শুরু করেছে। আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রভাব তেমনটা দৃশ্যমান ছিল না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতো গোত্রীয় বা বংশীয় প্রভাব, স্থানীয় সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্ক, এলাকাভিত্তিক প্রভাব ইত্যাদি। ফলে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিহিংসা থাকলেও ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হতো না। ব্যালট পেপারে রাজনৈতিক দলের প্রতীক বসার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায়ে মানুষের মধ্যেও এখন ব্যাপক বিভাজন শুরু হয়েছে। এর ফলে এদেশের চিরচেনা সামাজিক সম্পর্কেও চির ধরেছে। রাজনৈতিক পরিচয়ই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হওয়ায় জাতীয় রাজনীতি ও নির্বাচনের সব অনুষঙ্গই আজ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে। স্থানীয় কোন্দল, দলাদলি, গ্রাম্য রাজনীতির নানা বিষয়ের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে জাতীয় রাজনীতির নানা বিষয়াদি। দিনকে দিন এসব বেড়েই চলেছে। ফলে, এবারের নির্বাচনে এই নজিরবিহীন সহিংসতা মৃত্যু। জাতীয় নির্বাচনে আমরা একই দলের একাধিক প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখি। মনোনয়ন না পেলে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচন করতে দেখি। ইউপি নির্বাচনেও এবার তাই হয়েছে। ইউপি নির্বাচনে এতো সংঘর্ষের বড় কারণই হচ্ছে দলীয় অন্তঃকোন্দল। এই দলীয় অন্তঃকোন্দল মূলত আওয়ামী লীগের মধ্যেই বেশি ছিল।
কেন্দ্র থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত রাজনীতির প্রতিটি স্তরেই আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল আর সক্রিয় রাজনীতিতে নেই। ফলে ইউপি নির্বাচনে অন্তঃকোন্দলও আওয়ামী লীগেই বেশি দেখা গেছে। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হওয়া ও আধিপত্য বিস্তারই এই কোন্দলের প্রধান কারণ। সেই সঙ্গে অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতা এই কোন্দলকে সহিংস করে তুলেছে।
জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ অনেক পুরনো। এখন সে বাণিজ্য ইউপি নির্বাচনেও শুরু হয়েছে। যেকোনো বড় রাজনৈতিক দলেই একাধিক শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা থাকেন। নির্বাচনে তারা প্রার্থী হতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সার্বিক দিক বিবেচনা করে প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়ে থাকে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনেও আমরা দেখি এমপি হিসেবে দলীয় স্বার্থের চেয়ে অর্থের লেনদেনের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। একই প্রবণতা এখন ইউপি নির্বাচনেও দেখা যাচ্ছে। অর্থ লেনদেন বা মনোনয়ন বাণিজ্য বিষয়টি এখন আরও বেশি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
দেশে বিরোধী কোনো রাজনীতি না থাকায় সরকারি দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই নির্বাচিত হওয়া। আর নির্বাচিত হওয়া মানেই উন্নয়ন তহবিল, ত্রাণ তহবিলসহ অসংখ্য তহবিলের মালিক বনে যাওয়া। দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ করা বা জবাবদিহিতা চাওয়ারও কেউ নেই। ভবিষ্যতে নির্বাচিত না হওয়ারও ভয় নেই। কারণ, টাকা থাকলে আবার মনোনয়ন কেনা যাবে। ফলে, এখন শোনা যায় কোনো কোনো ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কোটি টাকা পর্যন্ত লগ্নি করেছেন। নমিমেশন পাওয়া যেহেতু নির্বাচিত হওয়া তাও আবার বিনা ভোটই।
কাজেই, এর চেয়ে আর সহজ কি আছে! নির্বাচনে প্রচারণা বা অন্য কোনো খরচ না থাকায় প্রার্থীরাও মনোনয়নের পেছনে বেশি বিনিয়োগ করতে কার্পণ্য করেন না। মনোনয়ন যার হাতে থাকে তিনিও জানেন বিষয়টি। তাই মনোনয়নের মূল হোতা বা কর্তৃত্ব যার হাতে থাকে তিনি মনোনয়নের জন্য চড়া দাম হাকেন। এসব কারণে, মনোনয়নের বাজার মূল্য এখন অনেক। এই বাজার মূল্যেই মনোনয়ন কেনার জন্য ইউপিতে একাধিক প্রার্থীও রয়েছে।
যারা টাকা দিয়েও মনোনয়ন পান না তারাও ভোটের মাঠ ছেড়ে দিতে নারাজ। মাঠের রাজনীতিতে তারা আরও বেশি সহিংস হয়ে ওঠেন। নির্বাচনী এলাকায় কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য মনোনয়ন বঞ্চিতরা আরও বেশি মরিয়া হয়ে ওঠেন। ফলে সব ইউপি নির্বাচনই সহিংস রূপ ধারণ করেছে এবং সেটি একই দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা। আওয়ামী লীগ বহু বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। ফলে দলের মধ্যে ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বিরোধী রাজনীতি না থাকায় সব কোন্দলই এখনই আওয়ামী লীগে ভর করেছে। বিরোধী রাজনীতি থাকলে রাজনীতিতেও একটা ভারসাম্য বজায় থাকতো। নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও তাদের অনুসারীদের কেউ কেউ স্বতন্ত্রভাবে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগের কাছে যদিও তারা কোণঠাসা। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কোনো আশা না দেখায় তারাও আওয়ামী লীগের এক পক্ষের সঙ্গে গাটছড়া বেঁধেছেন। এতে সংঘাত আরও বড় আকার ধারণ করছে।
সাম্প্রতিক ইউপি নির্বাচনে কোন্দলের যে ছিটেফোটা দেখা গেছে, ভবিষ্যতে হয়তো তা আর ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে জাতীয় নির্বাচনেও। এসব সহিংসতা দমনে নির্বাচন কমিশনের কোনো সক্রিয় ভূমিকা আমরা দেখিনি। উল্টো তারা নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়ার দাবি করেছেন। সংঘর্ষকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করে দায় এড়িয়ে যেতে চান। যেমন এই নির্বাচনের প্রেক্ষাপটেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘সংঘাতের দায় প্রশাসন, পুলিশ বা নির্বাচন কমিশনকে দিলে চলবে না। ঘরে ঘরে, মহল্লায় মহল্লায় পাহারা দিয়ে নির্বাচনী সহিংসতা ঠেকানো সম্ভব নয়।’
তিনি সঠিক কথাই বলেছেন, কিন্তু নির্বাচনে সহিংসতা হলে বা নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো অভিযোগ এলে সে বিষয়ে কমিশন যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা সেগুলো তারা নিচ্ছেন না কেন? এ দায় তারা কীভাবে এড়াবেন? কাজেই তাদের এই দায়সারা গোছের মন্তব্য তাদের পুরনো রুটিন কাজেরই অংশ। এভাবে কমিশন নিজের দায়ভার কখনো কখনো পুলিশের ওপর কখনো প্রশাসনের ওপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু সহিংসতা বা নির্বাচনে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখি না।
কমিশনের দাবি, তাদের কিছুই করার নেই। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে তাদের হাতে যে ক্ষমতা আছে সে ক্ষমতাও প্রয়োগ করতে দেখি না। কাজেই সরকার বা প্রশাসনের ওপর দায় চাপানো একটি অজুহাত মাত্র। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন-সংক্রান্ত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তারপরও একটি নির্বাচনে কমিশনের যে নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা তা দেখা যায় না। নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না।
এ সংঘাতময় নির্বাচনী অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য নির্বাচন কমিশনকেই এগিয়ে আসতে হবে। সাংবিধানিকভাবে তাদের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা প্রয়োগ করতে হবে। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রার্থিতা বাতিল করার এখতিয়ারও কমিশনের আছে। চাইলে তারা ভোটও বাতিল করতে পারে। এমনকি ভোটের পর ফলাফলও বাতিল করতে পারে। এসব করতে সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয় না, পুলিশ-প্রশাসনের ওপরও নির্ভর করতে হয় না। নিজেদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। এসব পদক্ষেপ নিলে এমনিতেই প্রার্থীরা সতর্ক হয়ে যাবেন। এসব দায়িত্ব পালন না করা মানে সংবিধানের লংঘন। এ দায়িত্ব পালন না করে তারা তাদের সাংবিধানিক শপথও ভঙ্গ করেন।
ইউপি নির্বাচনে প্রাণহানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘প্রকৃত পক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে।' এ দায় তিনি মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরই চাপাতে চান। কিন্তু কমিশনের কি কোনো দায়ই নেই। নির্বাচন যদি থাকে আইসিইউতে আর গণতন্ত্র যদি থাকে লাইফ সাপোর্টে' তবে সঙ্গত প্রশ্ন- নির্বাচন কমিশন কি নির্বাসনে নয়? কিন্তু কেন তাদের এ স্বেচ্ছা নির্বাসন?
লেখক : আইনজীবী ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস