নতুন দামে পুরনো চাপে পাবলিক
৩ নভেম্বর রাতে জ্বালানি মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করেছে। আগে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম ছিল ৬৫ টাকা। বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেই দেশব্যাপী বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে যে কর্মসূচিটি পালন করা হয় হয় তা হচ্ছে পরিবহন ধর্মঘট। পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে এ সেক্টরের মালিক-কর্মচারী সবাই এক জোট হয়ে স্বতস্ফূর্তভাবে এ ধর্মঘট পালন করে।
গত শুক্রবার থেকে দেশে এই ধর্মঘট শুরু হয়েছে। রোববার রাতে পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে ডিজেলচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া সমন্বয় করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে একজন যাত্রীর জন্য প্রতি কিলোমিটার সর্বোচ্চ ভাড়া ১ টাকা ৪২ পয়সার স্থলে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটার ভাড়া যথাক্রমে ১ টাকা ৭০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ১৫ পয়সা ও ১ টাকা ৬০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়েছে।
বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভাড়া যথাক্রমে ৭ টাকার স্থলে ১০ টাকা ও ৫ টাকার স্থলে ৮ টাকা করা হয়েছে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। এদেশে যেকোন দাবি আদায় শতভাগ সফল করতে জনগণকে জিম্মি করেই তা আদায় করা যায় তা আরেকবার প্রমাণ হলো। রাজনৈতিক দাবি আদায় থেকে শুরু করে যেকোনো শ্রেণি পেশার মানুষই তাদের দাবি আদায় করতে জনগণ যাতে সর্বোচ্চ দুর্ভোগে পড়ে এমন কর্মসূচি দেয়।
চলমান ধর্মঘটের পেছনে গণপরিবহন মালিকদের দাবি ছিল- জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বর্তমান ভাড়ায় তাদের পোষায় না। আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক দাবি আদায়ের গণতান্ত্রিক রেওয়াজ উঠে গেছে। এই প্রবণতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সেজন্য সরকারকেও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই সঙ্গে অন্য যেকোনো কর্তৃপক্ষ বা সিন্ডিকেটের ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকারকেও আমরা বিভিন্ন সময়ে পরিবহন সেক্টরের কাছে জিম্মি হতে দেখেছি। এই জিম্মিদশা থেকে সরকার ও জনগণ আজও মুক্ত হতে পারেনি বাস ভাড়া বৃদ্ধি সে কথাই আবার মনে করিয়ে দিল।
কেন এই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। সরকারের তরফ থেকে প্রথমত আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কথাই বলা হয়েছে। এখন অবশ্য কিছু কিছু ভিন্ন কথাও শোনা যায়। তেল পাচার রোধেই এই দাম বৃদ্ধি এমন কথাও শোনা গেছে। এদিকে ৪ নভেম্বর থেকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির দামও বেড়েছে। দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পরে কয়েক দফা নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। একদিকে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে আরেকদিকে বেঁচে থাকার ডাল-ভাতের দামও বেড়েছে। করোনাকালে সবাই ভর্তুকি পেয়েছে। ভর্তুকি পায়নি শুধু প্রান্তিক জনগণ।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে তেলের দামে সমন্বয় করতে হয়। না হলে আন্তর্জাতিক বাজারে মানে প্রতিবেশি দেশে ওই তেল পাচার হয়ে যাবে। এটা স্বাভাবিক। একথা শুধু তেলের ক্ষেত্রে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে আমাদের তেলের দাম বেশি থাকলে এদেশে তেল পাচার হয়ে আসার কথা শোনা যায় না। এদেশে থেকে তেল, টাকা সব পাচারেই হয়ে যায়, পাচার হয়ে আসে না। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন অনেক কম ছিল, তখন আমাদের তেলের দাম কমানে হয়নি।
দেশে এ মুহূর্তে ডিজেল, কেরোসিন, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির দাম বাড়ানো যৌক্তিক কিনা অথবা দাম বাড়ানোর বিকল্প ছিল কিনা সে বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে জ্বালানি তেলের সঙ্গে যৌক্তিকভাবেই অনেক পণ্যের দাম নির্ভরশীল। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রভাব। আমাদের জীবনে এর প্রভাব অধিকাংশ সময়ই নেতিবাচক হয়ে থাকে। তেল বলি আর চাল-ডাল-পেঁয়াজ বলি এদেশে কোনো কিছুর দাম একবার বাড়লে তা আর সহসা কমে না। বিশেষ করে তেলের দামতো নয়ই। সমন্বয় করে শুধু বাড়ানো হয়, কমানো হয় না। তেলের দাম যদিও কিছুটা সমন্বয় করা হয়, কিন্তু তেলের অজুহাতে বাস ভাড়া বাড়ানো হলেও তেলের দাম কমলে ভাড়া আর কমানো হয় না। এদেশে বাস ভাড়া কখনো কমেছে বলে শুনিনি।
বিশ্ববাজারে আগে তেলের দাম কমলেও এখান তেলের দাম না কমিয়ে গত সাত বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তখনতো সমন্বয়ের কথা ভাবা হয়নি। লিটারপ্রতি ১৫-৪০ টাকা বাড়ানো হয় আর কমানো হয় ৩ টাকা এ কেমন সমন্বয়। বলা হচ্ছে, আমাদের তেলের দাম বাড়ানোর পরও ভারতের চেয়ে এখনও কম আছে। তাহলে ভারত থেকে এদেশে তেল পাচার হয়ে আসে না কেন? কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়া এক অজুহাত বা সুযোগ মাত্র। কারণ, আমরা দেখি আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম না বাড়লেও দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনগণের ওপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়। করোনাকালেও দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সরকারের আয় বাড়ানোর একটা সহজ পথ হচ্ছে গ্যাস, তেল বিদ্যুতের দাম বাড়ানো।
আমরা শুধু বাস ভাড়া বাড়ানো নিয়েই কথা বলি। কারণ এটি দৃশ্যমান ও তেলের সঙ্গে রয়েছে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব। কিন্তু অদৃশ্যমান আরও অনেক পণ্যের দামই যে বেড়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।। তেলের দাম বাড়া মানে কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। কৃষি উৎপাদন খরচ বেড় যাওয়া মানে বাজারে নিত্যপণ্যর দাম বেড়ে যাওয়া। মানে শেষমেষ ওই প্রান্তিক জনগণ। কৃষক অনেক সময় ন্যায্য মূল্য পান না, মধ্যস্বত্বভোগী ও ফরিয়ারা এমনকি সরকারও কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনে না। ফলে কৃষকের খেয়ে পড়ে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ে। এদেশে বাস মালিকের পোষায় না, ঘাট ইদারাদের পোষায় না, সরকারেরও পোষায় না-পোষায় শুধু কৃষক আর জনগণের। যেভাবেই হোক তাদেরকে পুষিয়ে নিতে হয়।
মন্ত্রণালয় বলছে আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বেড়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, ভারত পেট্রল ও ডিজেলের দাম লিটারে যথাক্রমে ৫ ও ১০ রুপি কমিয়েছে। ৪ নভেম্বর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা দেয়, আসন্ন রবি মৌসুমে কৃষকের সুবিধার জন্য জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভোক্তাদের সুবিধার্থে রাজ্য সরকারগুলোকে জ্বালানি তেলের ওপর ভ্যাটও কমানোর অনুরোধ করেছে। আর আমাদের দেশে সব বোঝা চাপানো হয় ওই কৃষক ও জনগণের ওপর।
গত সপ্তাহে নিত্যপণ্যের দাম আরেকদফা বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে গণমাধ্যমে কয়েক দিন চাউর হয়, এরপর অন্য ইস্যুর ভীরে হারিয়ে যায়। মানুষেরও গা সহা হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ যে জিম্মি। প্রতিবাদ করার ভাষা নেই। প্রতিকারও নেই। তাই মেনে না নিয়ে তাদের উপায় নেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়া মানে স্বাভাবিকভাবেই অন্য অনেক কিছুর ওপরই এর প্রভাব পড়বে। সীমিত আয়ের মানুষরা আরেকদফা বিপদে পড়বেন। জ্বালানি তেলের বর্ধিত দামের প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়। ফলে, খুব তাড়াতাড়িই গ্রাহকের ওপর আরেকদফা বর্ধিত বিদ্যুৎ বিল চাপিয়ে দেয়া হবে। এছাড়া যে সব পণ্য উৎপাদনে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় সেগুলোর দামও বাড়বে। উৎপাদন ও তৈরিতে বিদ্যুৎ লাগে না এমন পণ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন।
তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনমানুষের পরিবহন ভাড়া, পণ্য পরিবহন ব্যয় ও পণ্য উৎপাদন ব্যয় কতটা বাড়া উচিৎ সে বিষয়ে কোনো নীতিমালা আমাদের নেই। তেলের দাম লিটার প্রতি বাড়ার সঙ্গে ভাড়া কত বাড়া উচিত সে বিষয়ে কোনো যৌক্তিক হিসাব নিকাশ আমাদের নেই। বাস ও লঞ্চ মালিকরাতো ভাড়া দ্বিগুণ করার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে বাস ও লঞ্চ ভাড়া যতোটা সম্ভব বাড়িয়ে নেওয়ার এই চাতুরি মানুষের সঙ্গে এক প্রতারণা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানি করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেত। পরিববহন ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রেও আমরা জনগণ বা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কোনো সংশ্লিষ্টতা দেখিনি। জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল বা বাস-লঞ্চের ভাড়া সবকিছুতেই চলছে এক তেলেসমাতি। শেষমেষ জনগণের ওপরই সব বোঝা চাপানো হয়।
লেখক : আইনজীবী ও কলাম লেখক।
এইচআর/এএসএম