লড়াই এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের?
দেশে মাঠের রাজনীতিতে উত্তেজনা নেই বছর কয়েক ধরেই। এরমধ্যে গত ২৬ অক্টোবর দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে গঠিত ‘গণঅধিকার পরিষদ' নামের এই নতুন দলটি দেশের রাজনীতির কোন প্রয়োজন পূরণের জন্য জন্ম দেওয়া হলো তা এখনও পরিষ্কার নয়। দলে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন ড. রেজা কিবরিয়া। তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার পুত্র। কিন্তু রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ। কিছুদিন ড. কামাল হোসেনের নাম সর্বস্ব দল গণফোরামের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
গণফোরামে তার সাফল্য হলো মাত্র জনা কয়েক মানুষের এই দলটিতেও বিভক্তি সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এখন এসেছেন গণঅধিকার পরিষদে। আর মূল উদ্যোগী নুরুল হক নুরের অভিজ্ঞতা কোটাবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়া। ডাকসুর ভিপি হলেই যে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয় না, এটা হয়তো নুর বুঝবেন। বাতাস দেওয়ার লোক পাওয়া গেলেও বিপদে পাশে পাওয়ার লোকের সংখ্যা যে কম, এটাও নুর টের পাবেন। রাজনীতি যদি এত সহজ হতো তাহলে দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৃত্ত বা বলয় ভেঙ্গে আগেই তৃতীয় শক্তির বিকাশ ঘটতো। হাতি ঘোড়া তল পায়নি এখন রেজা-নুরের সাঁতার দেখার পালা।
দেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। তারা মাঠ ছেড়ে দিয়েছে অথবা সরকার তাদের মাঠ ছাড়া করেছে। তবে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে প্রতিদিন চলছে কথার লড়াই। বিএনপির সব অভিযোগ সরকার তথা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আর আওয়ামী লীগের অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধে। রাজনীতির অবস্থা অনেকটা ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন, কেষ্টা বেটাই চোর'- এর মতো। আওয়ামী লীগ দুষে বিএনপিকে, বিএনপি দুষে আওয়ামী লীগকে। এই দোষারোপের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা কীভাবে সম্ভব হবে সেটা একটি বড় চিন্তার বিষয়।
এবার দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লা থেকে শুরু হয়ে দেশের কয়েকটি জেলায় যে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিমা, মন্দির, বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হলো তার জন্য দায়ী কে বা কারা সেটা ভালোভাবে তদন্ত না করে সবাই যার যার মনের মাধুরী মিশিয়ে অভিযোগের তীর এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে এদিকে নিক্ষেপ করা অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগ বা সরকার বলছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার কাজটি বিএনপি-জামায়াত ছাড়া আর কেউ করতেই পারে না। তাদের রাজনীতিই সাম্প্রদায়িক। তাদের অতীত রেকর্ডও তা-ই বলে। সরাসরি অথবা অন্য কাউকে ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াত ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালায়।
বিএনপি বলছে, যেসব ঘটনা ঘটছে তা সরকারই পরিকল্পিতভাবে করে বিরোধীদের ওপর দায় চাপাচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ বা এই দলের অঙ্গ সংগঠনের কারো কারো সম্পৃক্তার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না তা-নয়। বিএনপি ছাড়া অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি আস্থা-বিশ্বাস আছে এমন দল কিংবা ব্যক্তিরাও এখন আওয়ামী লীগের ওপর বিরক্ত বা রুষ্ট আছেন। আজকাল সাধারণভাবেই এটা মনে করা হয় যে, একসময় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পতাকাবাহী দল এখন আর আগের আদর্শিক অবস্থানে সেভাবে অবিচল বা দৃঢ় নেই। ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ আদর্শ বদল না করলেও আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীই এখন ধর্মকে রাজনীতির বর্ম হিসেবে ব্যবহারে আপত্তির কিছু দেখেন না। তাদের সহজ যুক্তি, আমরা মানুষের জন্য রাজনীতি করি, মানুষ অধিকহারে ধর্মমুখী হলে আমরা তা থেকে দূরে থাকলে তো আমরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো!
এসব আসলে সুবিধাবাদী প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ। সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলা, পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনা থেকে আধুনিক-বিজ্ঞানমনস্ক মানসিকতার তালিম দেওয়া তো রাজনৈতিক দলেরই কাজ। সব সময় যদি মানুষ যা চায় তার পেছনে রাজনৈতিক সব দল একভাবে ছুটতো তাহলে কোনো দেশেই বড় কোনো পরিবর্তন সংঘটিত হতো না। অন্যসব বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতক জীবন এবং আওয়ামী লীগ দলটির বিভিন্ন বাঁক বদলের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা কি দেখি?
মানুষের চেতনায় নতুন অভিঘাত তৈরি করে, তাদের সামনে নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে তাদের পরিবর্তনের জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুত করার কাজটিই কিন্তু আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু করেছেন এবং আওয়ামী লীগও সেই ধারায় অগ্রসর হয়েছে। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান থেকে জয় বাংলায় পৌঁছানোর কাজটি আপনাআপনি হয়নি। একদিনেও হয়নি। জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে তো ব্যঙ্গবিদ্রুপ কম হয়নি। ‘জয় বাংলা জয় হিন্দ লুঙ্গি খুলে ধুতি পিন্দ’ বিদ্রুপ শুনে কি বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা স্লোগান ছেড়ে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণে আওয়ামী লীগের সব স্তরের সব নেতাকর্মী এখন সমান উৎসাহ বোধ করেন বলে মনে হয় না।
দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বিনষ্ট করার মতলববাজির জন্য বিএনপি-জামায়াতের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে এখন আওয়ামী লীগের উচিত নিজেকে আয়নায় দেখা। বিএনপি-জামায়াত থেকে যারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে তারা কি তাদের অতীত রাজনীতিকে বাদ দিয়ে এসেছে, নাকি ওই রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে রাঙিয়ে তুলতে এসেছে? নিজ দলের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো খতিয়ে দেখা এখন আওয়ামী লীগের জন্য একটি ফরজ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়। অনেকেই মনে করেন, টানা লম্বা সময় ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগের শরীরে ‘চর্বি’ জমেছে। চর্বি জমা কিন্তু সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। চর্বি কমিয়ে আনার জন্য যেমন কিছু শারীরিক কসরত করতে হয়, আওয়ামী লীগকেও এখন দলের ভেতরের আবর্জনা দূর করার জন্য কিছু জরুরি সাংগঠনিক উদ্যোগ নিতে হবে।
একটু ভালোভাবে লক্ষ করলেই এটা স্পষ্ট হবে যে, একটি কার্যকর, সক্রিয়, দায়িত্বশীল বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই শুধু ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছেনি, বরং আওয়ামী লীগ দলটিও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বড় কোনো ধাক্কা বা চাপ সামলানোর অবস্থায় আওয়ামী লীগ আছে কিনা তা নিয়ে দলটির শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যেও সংশয় তৈরি হয়েছে। এবার সাম্প্রদায়িক বিভেদকামীদের বিরুদ্ধে কিন্তু আওয়ামী লীগ কোথাও তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। কেন্দ্রীয়ভাবে শান্তি সমাবেশ করতেও ৬ দিন লেগেছে। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি দলের কাছে এমন গা ছাড়া ভাব প্রত্যাশিত নয়। কেন এমন হচ্ছে? কেউ কেউ মনে করেন, সরকারের মধ্য যেমন সরকার থাকে, আওয়ামী লীগের মধ্যও তেমনি আওয়ামী লীগ তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ আর এক বা ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ নেই।
নেই যে তার প্রমাণ পাওয়া যায় যেকোনো নির্বাচন এলে। নির্বাচন এলে অনেকেই প্রার্থী হতে চান। জনসমর্থন আছে কিনা সেটা ভাবার দরকার আছে বলে কেউ মনে করেন না। কারণ সবাই ধরে নেন যে, ভোটে জিততে এখন আর জনসমর্থন লাগে না, লাগে প্রতীক- নৌকা। নৌকা তীরে ভেড়ানোর দায়িত্ব প্রার্থীর নয়, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার। তিনি তো সবার তরী পারের দায়িত্ব নিয়েছেন! এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগে যে ‘ব্যারাছ্যারা' দেখা যাচ্ছে তা দলের জন্য খুব ভালো নয়। হুমকি ধমকি দিয়েও বিদ্রোহী প্রার্থী বসানো বা দমানো যাচ্ছে না।
বিএনপি সরাসরি ভোটে নেই। তবে বেনামে কোথাও কোথাও আছে। এক অর্থে মাঠ ফাঁকা। তারপরও বিভিন্ন জায়গায় সংঘাত সংঘর্ষ হচ্ছে। অনেক জায়গায় আবার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জপতার খায়েশ থেকেও মারামারি করা হচ্ছে। প্রার্থী হিসেবে যাদের মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে তাদের নিয়েও কোনো কোনো জায়গায় ক্ষোভবিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। ত্যাগীদের বাদ দিয়ে ভোগীদের, অন্য দল থেকে আসা ‘কাউয়া'দেরও নৌকা দেওয়া হচ্ছে। আগে চেয়ারম্যান হয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন, মামলার আসামি হয়েছেন, চেয়ারম্যানগিরি স্থগিত হয়েছে – এমন ব্যক্তিরাও নতুন করে নৌকা পেয়ে বগল বাজাচ্ছেন। দলীয় শৃঙ্খলা না মানার যে প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠছে তা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে? বিরোধী দল নেই মনে করে আওয়ামী লীগই যদি বিরোধী ভূমিকায় নামে তাহলে বিষয়টি কি দলের শক্তির পরিচয় বহন করবে?
শেষ করছি কবি নির্মলেন্দু গুণের ফেসবুক পেজের একটি পোস্ট হবহু তুলে দিয়ে। নির্মলেন্দু গুণকে নিশ্চয়ই কেউ আওয়ামী লীগ বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরোধী বা অকারণ সমালোচক বলে মনে করেন না। তিনি আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার একজন সুহৃদ হিসেবেই পরিচিত। কবি লিখেছেন :
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা মনে হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চাইছে। তাই যেখনে পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে সেখানে জনসমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠ ছাড়া করার জন্য তারা প্রতিপক্ষের ওপর প্রকাশ্যে হামলা করছে। আমার নিজ উপজেলা থেকে পাওয়া এরকম চিত্রই সারা দেশের চিত্র কি-না জানি না। হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হয়। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা আমার উপজেলায় অধিকাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করছে। স্থানীয় প্রশাসন নৌকা প্রতীক পাওয়া "ধোয়া তুলসিপাতা"-দের আক্রমণ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণকারী স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না, বা চাইছে না। আমি খালি মাঠে গোল দেওয়ার এই বদভ্যাস পরিত্যাগ করার জন্য নৌকা প্রতীকপ্রাপকদের প্রতি সবিনয় আহ্বান জানাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে আপনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আপনার মনোনীত প্রার্থীদের সহিষ্ণু হবার নির্দেশ দিন। তাদের রাজশক্তির দম্ভ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে বলুন। মাঠ পর্যায়ের জনগণের রায় নিয়ে তাদের জয়ী হতে বলুন। স্থানীয় প্রশাসনকে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের সুরক্ষায় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের জন্য সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিন। সেটাই আপনার জন্য এবং দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে।
দেখা যাক, কবির আহ্বান কারো কাছে পৌঁছে কিনা!
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/জেআইএম