কপ-২৬ সম্মেলন এবং আমাদের প্রত্যাশা
মর্তুজা হাসান সৈকত
বর্তমানে পৃথিবীর আলোচিত এবং সংকটময় বিষয়গুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম প্রধান। যুক্তরাজ্যে দাবদাহ, অস্ট্রেলিয়ার দাবানল থেকে মস্কোতে তুষারপাতের অনুপস্থিতি অথবা চীন ও জার্মানিতে মারাত্মক বন্যা- প্রতিদিনের এইসব সংবাদ শিরোনাম আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ আজ আগের থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী।
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীব্যাপী বাড়ছে তাপমাত্রা। আর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন ঘটছে। এ কারণে বিপদ সীমা অতিক্রম করছে সমুদ্র ও নদীর পানির উচ্চতা। তলিয়ে যাচ্ছে নিম্নাঞ্চল। ফলে, বসতবাড়ি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী তিন দশকে ২১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবে। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং সম্পদের ব্যবধান কমিয়ে আনার মতো জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা উন্নত বিশ্বের তুলনায় ভিন্নতর এবং আরও জটিল।
বাংলাদেশ মূলত একটি গ্রাউন্ড-জিরো দেশ হিসেবে নিজের কোন দোষ ছাড়াই জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। এটি বিপুল জনসংখ্যার দেশ, দক্ষিণে সাগরবিধৌত। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি ১ মিটার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের অন্তত ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে, ভূমিহীন ও জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে বিপুল সংখ্যক মানুষ। ফলে একদিকে যেমন জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়ে যাবে তেমনই উদ্বাস্তু সমস্যা দেশীয় সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রূপ নিতে পারে।
এই নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অন্য একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু অভিবাসীর অর্ধেকই হবে বাংলাদেশ থেকে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবনাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, বন্যা ও খরার প্রভাব ছাড়াও ১১ লাখ রোহিঙ্গা জোরপূর্বক মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ গুরুতর জলবায়ু প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। জরুরি উদ্যোগ এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বন্যা ও ফসলের উৎপাদন নষ্ট হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশর প্রায় দুই কোটি মানুষ অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকিতে যাবে। তবে এসব ঝুঁকি নিয়েই বাংলাদেশ গত দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি এবং দুর্যোগের প্রভাব প্রশমনে দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি দেখিয়েছে।
তবে আশঙ্কা কেবল বাংলাদেশকে নিয়েই নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াই জলবায়ু সৃষ্ট অভিবাসনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক সক্রিয় অঞ্চল হিসেবে পরিণত হতে যাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে এখানে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বর্তমান সময়ের চেয়ে তিনগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। এর কারণ হলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বৃহৎ নগর কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির আশঙ্কায় থাকা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে।
তবে এত এত উদ্বেগের সংবাদের মাঝেও স্বস্তি হচ্ছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর একটি। চুক্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরার দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি বেশ কয়েকটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তার সঙ্গে তখন যুক্তরাজ্য ও ইতালির রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে দেখা গেছে। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তখন জানিয়েছিলেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে ট্রাম্প প্রশাসন সরে যাওয়ার ফলে যে সময় নষ্ট হয়েছে তা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে যুক্তরাষ্ট্র। এই কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের ৪০ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে নিয়ে ‘ক্লাইমেট লিডারস সামিট’ নামের একটি ভার্চুয়াল সম্মেলনের আয়োজনও করে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তিতে ফিরে আসায় ২০২১ সালের নভেম্বর মাস জলবায়ু ইস্যুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, ওইসময়ে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত হবে কপ-২৬, যা এই দশকের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক শীর্ষ জলবায়ু সম্মেলন। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, উদ্যোক্তাসহ প্রায় ৩০ হাজার মানুষ একত্র হবে।
এই শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিকভাবে একটি শীর্ষস্থানীয় কণ্ঠস্বর। কারণ, ৪৮টি দেশ নিয়ে গঠিত জলবায়ু বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক ফোরাম সিভিএফ এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ। এই দেশগুলো যারা বিশ্বের ১ শতাংশের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী, অথচ নিঃসরণজনিত কারণে সৃষ্ট জলবায়ু সংকটের শিকার- তাদের মুখপাত্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন।
এবারের সম্মেলন কপ-২৬ মূলত হচ্ছে, প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর জন্য নিজ দেশের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার পরিকল্পনা হালনাগাদের বিশ্বমঞ্চ। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করতে ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির নিচে রাখার জন্য এই নতুন হালনাগাদকে হতে হবে আগের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী। এর পাশাপাশি গত বছরের জলবায়ু সম্মেলনের কিছু অসম্পূর্ণ কাজ রয়েছে, এবারের সম্মেলনে তাও সম্পূর্ণ করতে হবে। বস্তুত এ ক্ষতির দায়ভার ধনী দেশগুলো কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
বর্তমানে বৈশ্বিক তাপমাত্রা যে অবস্থানে রয়েছে সেটা বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের শিল্পায়ানের ফলাফল। এ কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে দাবি উঠেছে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বেশিরভাগ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে পশ্চিমা বিশ্বকে এবং তাদেরকে কার্বন নিঃসরণও কমাতে হবে। তবে এবারের সম্মলনে চীন কী প্রতিশ্রুতি দেয় সেটাও খুব গুরুত্ব বহন করে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে এ মুহূর্তে তারাই এক নম্বর কার্বন নিঃসরণকারী দেশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর বিপুল সংখ্যাক মানুষ ভূমিহীন ও জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে নাকি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এখনকার চেয়ে আরও ভালো এবং সুস্থ স্বাভাবিক পৃথিবীতে বসবাস করবে- এ সিদ্ধান্তটি আসন্ন বিশ্ব সম্মেলনেই নিতে হবে। আগামী কয়েক বছরে আমরা যা করব তার প্রভাব শত শত বছর ধরে থাকবে। মাত্র ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে একটি উষ্ণ বিশ্বের বিপর্যয়কর প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি; কিন্তু এই উষ্ণতা বৃদ্ধি যদি ২ বা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে পৌঁছায়, তাহলে কী ঘটবে? পরিবেশবিদ ও জলবায়ু পণ্ডিত বিল ম্যাককিবেন জলবায়ু বিষয়ে বলেছেন, ‘ধীরে ধীরে জেতাও হেরে যাওয়ার সমান।’ তাই ধীরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ভুল এখানে করা যাবে না।
আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যত রেখে যেতে আসন্ন বিশ্ব সম্মেলনেই দ্রুত ডিকার্বনাইজেশনের পদক্ষেপ অপরিহার্য করাসহ সার্বিক বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে বিশ্বনেতাদের। এ প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২২ এপ্রিল জলবায়ুবিষয়ক ‘লিডারস সামিটের’ উদ্বোধনী সেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলা ও পুনর্বাসনে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার ফান্ড নিশ্চিত ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে অধিক মনোযোগী হওয়াসহ যে চারটি পরামর্শ দিয়েছিলেন, বিশ্বনেতাদের সেটি উপেক্ষা করা মোটেই উচিত হবে না।
এইচআর/এমএস