সফল বার্ধক্যায়ন সময়ের দাবি
ড. মো. আমিনুল ইসলাম
যে প্রক্রিয়ায় মানবশিশু বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হয় তাকে বলা হয় বার্ধক্যায়ন। কোনো ব্যক্তি প্রবীণ জীবনে পৌঁছার পর যদি রোগমুক্ত থেকে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে ভালো অবস্থায় থাকে তখন তাকে বলে সফল বার্ধক্যায়ন। বার্ধক্যায়ন মানবজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অলঙ্ঘনীয় প্রক্রিয়া। জন্মের পর থেকে নানা ধাপ অতিক্রম করে দীর্ঘায়ু লাভ করলে এ অবস্থাকে বরণ করতে হয়। কিন্তু সবার বার্ধক্য একই রকম হয় না। বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জন্ম ও মৃত্যুহারের তাৎপর্যপূর্ণ হ্রাস, উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি, শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি, গণমাধ্যমের প্রচারসহ নানা কারণে মানুষের জীবন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি হওয়ায় মানুষের আয়ুষ্কাল বা জীবনকাল বৃদ্ধি পেয়েছে।
উল্লিখিত বাস্তবতায় তাদের বার্ধক্যায়ন সফল করা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। বয়োবৃদ্ধির সক্রিয়তা তত্ত্বেও মনে করা হয়, জীবন মানে কর্ম এবং কর্ম মানে জীবন। অন্যদিকে বিযুক্ত তত্ত্বে মনে করা হয় যে, কর্ম থেকে বিযুক্ত হওয়া- প্রবীণ এবং সমাজ উভয়ের জন্যই ভালো। বিপরীতমুখী অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সমাজে দেখা যায় যে, কোনো ব্যক্তি বার্ধক্যে পৌঁছার পরে কর্মে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ যেমন কম, আবার গ্রামপ্রধান দেশে নানা বাস্তবতায় প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ভাবনার ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন হিসেবে কাজ করছে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুর দিকে জন্ম ও মৃত্যুহার ছিল উচ্চমাত্রায়, ফলে প্রবীণদের অনুপাত ছিল কম। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রবীণদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের বিশ্ব জনসংখ্যা বিবরণী ২০১৯ অনুসারে ২০৫০ সালে বিশ্বে ছয়জনে একজন ৬৫ এর বেশি বয়স্ক ব্যক্তি হবে; অথচ ২০১৯ সালে ছিল ১১ জনে মাত্র ০১ জন। একই ধারা বাংলাদেশেও লক্ষণীয়।
পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে আমরা দেখবো, ১৯১১-৫১ পর্যন্ত প্রবীণ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শূন্য চার ভাগের কাছাকাছি ছিল, ১৯৬১-৯১ পর্যন্ত ছিল প্রায় শূন্য পাঁচ ভাগের মতো; এরপর থেকে দেশে প্রবীণের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ মোট জনসংখ্যার প্রায় শূন্য আট ভাগ এবং সংখ্যার দিক থেকে প্রায় দেড় কোটির মতো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগের বেশি ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ থাকবেন; অর্থাৎ সংখ্যায় প্রায় সাড়ে শূন্য চার কোটির কাছাকাছি।
যখন বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, মানুষের মধ্যে সচেতনতার মাত্রা কম ছিল, দুরারোগ্য ও ছোঁয়াচে ব্যাধিতে পরিবারের পর পরিবার এমনকি গ্রামের বহু লোক একসঙ্গে মারা যেত; তখন মানুষ এ বিষয়টি নিয়ে ততোটা ভাবার অবকাশ পায়নি। কিন্তু বিষয়টি অতীব জরুরি। এ কারণেই প্রবীণদের জীবনের গুণগত দিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে সফল বার্ধক্যায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গত জানা জরুরি সফল বার্ধক্যায়ন শুধু রোগমুক্ত থাকা নয় বরং মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিকভাবে ভালো থাকা, যা একটি সামগ্রিক বা সামষ্টিক বিষয়। পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিবেশে এটি অর্জনই মূলকথা।
বার্ধক্যায়ন ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, পরিবার থেকে পরিবার, সমাজ থেকে সমাজ, গ্রাম থেকে শহর, উন্নত, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল বিবেচনায় ভিন্ন হয়। সমাজতাত্ত্বিক এবং নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে প্রবীণদের যথেষ্ট মর্যাদা ছিল। হিব্রু সমাজে অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো প্রবীণদের পরামর্শ ছাড়া সম্পন্ন হতো না। শিকার ও সংগ্রহভিত্তিক সমাজে প্রবীণদের বোঝা মনে করা হলেও পশুপালন, উদ্যান চাষ এবং কৃষিভিত্তিক সমাজে প্রবীণদের খুবই সম্মানজনক মর্যাদা ছিল। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের মিশরীয় সমাজেও প্রবীণরা তরুণদের জন্য শিক্ষাবিদ ও পরামর্শকের ভূমিকায় দেখা যেত।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকান সমাজে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল মাত্র শতকরা ২ ভাগ এবং আমেরিকান জনগণ প্রবীণদের গভীর শ্রদ্ধা করতো। বর্তমানে সে সমাজে প্রবীণদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করা হয়। চীন, জাপান, ভারত এবং বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দেশেই প্রবীণদের মর্যাদা সন্তোষজনক ছিল। মধ্যযুগেও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চার কারণে প্রবীণদের সম্মানের চোখে দেখা হতো। বর্তমানে প্রবীণদের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তারা নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর কারণ সমাজব্যবস্থার জটিল রূপ। অবাধ ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার এ যুগে মানুষ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হয়ে উঠেছে। যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ফলে বাবা-মা এবং সন্তানরা খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রসরতার কারণে বর্তমানে যারা প্রবীণ তাদের অধিকাংশই এসবের সাথে মানিয়ে চলতে পারছেন না। ফলে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের ব্যবধান বাড়ছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, শারীরিকভাবে নির্ভরশীলতা, সঙ্গি-সঙ্গিনীর মৃত্যু, পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অবহেলাসহ নানা সমস্যায় প্রবীণরা জর্জরিত। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সম্মুখীন না হলে আজকের আমরা যারা নবীন তারাও এক সময় প্রবীণ হবো। কাজেই আমাদের সবার বার্ধক্যকে সফল করা এখন সময়ের দাবি।
সুতরাং এখন থেকেই ভাবতে হবে প্রবীণ বয়সের স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা; আর্থিক স্বাধীনতার কথা। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্য উপযোগী খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। শক্তিশালী করতে হবে সামাজিক সম্পর্কের বেষ্টনী; যেন নিজেকে কখনও নিঃসঙ্গ মনে না হয়। পারদর্শী হতে হবে প্রযুক্তিতে যেন কেউ সময় না দিলেও মোবাইল, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, ফেসবুকে সময় কাটানো যায়। বিনির্মাণ করতে হবে নিজের সামাজিক জগৎকে। চর্চা করতে হবে ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধ, যাতে প্রবীণ জনগোষ্ঠী নিজেদের মর্যাদাবান ভাবতে পারেন।
সুতরাং সফল বার্ধক্যায়ন কোন বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, আবার রাতারাতিও অর্জন করাও সম্ভব নয়। এর নির্দেশকগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি একটি সামগ্রিক এবং জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। নিজের বার্ধক্যকে সফল করা এবং বার্ধক্য অনুকূল সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লব; যা ঘটাতে হবে মানুষের চেতনায়। এজন্য সরকার, গণমাধ্যম ও শিক্ষানীতিসহ সর্বক্ষেত্রে বিষয়টি তাৎপর্য অনুধাবন করে গুরুত্ব দিতে হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে সংবিধানে ১৫ (ঘ) ধারা সংযুক্ত করেন (সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার)। পরে ১৯৮২ সালে ভিয়েনায় প্রবীণবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার প্রবীণ বিষয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে এবং ১৯৮৫-৯০ সালের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রবীণদের গুরুত্ব দেয়া হয়।
জাতির পিতার অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী প্রবীণকল্যাণ চিন্তাকে ত্বরান্বিত করতে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে তৎকালীন সরকার বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি প্রবর্তন করেন। প্রবীণকল্যাণে আওয়ামী লীগ সরকার যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন (পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, শান্তিনিবাস স্থাপন, জাতীয় প্রবীণ কমিটি গঠন, চাকরিজীবী প্রবীণদের জন্য ভবিষ্যৎ তহবিল, গ্রাচ্যুইটি, কল্যাণ তহবিল, যৌথ বিমার সুবিধাসহ নানামুখী উদ্যোগ) তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে এগুলোর যথোপযুক্ত তদারকি ও প্রয়োগের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে বেসরকারি সংগঠন যেমন- প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র, মাদারস হোম এবং আরও কিছু সেবাকেন্দ্র। এসব কার্যক্রম আরও বেগবান ও ত্বরান্বিত করতে হবে।
গত ১ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব প্রবীণ দিবস। প্রবীণদের সুরক্ষা, অধিকার নিশ্চিত এবং বার্ধক্য বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৯০ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের পাশের প্রবীণদের পাশে দাঁড়াই; নিজের বার্ধক্যকে সফল করার চেষ্টা করি। সফল বার্ধক্যায়নবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে সফল বার্ধক্যায়নের নির্দেশকগুলো মেনে চলি ও অন্যকে উৎসাহিত করি। অদূর ভবিষ্যতে এ সমস্যার তীব্রতা অনেকটা কমানো সম্ভব। সফল বার্ধক্যায়ন বাস্তবায়নে সম্ভাবনার সব দুয়ার উন্মোচন করি একসাথে, আন্তরিকতা-ভালোবেসে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
এইচআর/এএসএম