সম্প্রীতির স্পৃহাই যেন চলে গেছে
সামাজিক মাধ্যমে, টেলিভিশনের টকশোতে, প্রবন্ধ আর কলামে সংবেদনশীল মানুষ বাংলার মাটিতে অনাদিকাল থেকে চলা ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা লিখছেন, বলছেন যদিও আমার কাছে মনে হয় এ অঞ্চলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও হাঙ্গামার ইতিহাস প্রাচীন। তবুও প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, এই বহুচর্চিত বিষয়সমূহ এখন আবার উঠছে কেন? কারণ একটাই- এক বিশাল ভয় বা আতঙ্ক ধীরে ধীরে গ্রাস করছে আমাদের সবাইকে।
দুর্গাপূজার সময় উন্মত্ত জনতা হামলা চালিয়েছে হিন্দু মন্দিরে। মন্দিরের উপর হামলার পাশাপাশি এলাকার হিন্দুদের বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে তারা। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হিংসা, বৈষম্য এবং নিপীড়ন নতুন নয়। কিন্তু এবার তার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে এবং হিন্দুদের উপর এই হামলা ঠেকাতে কেন আমরা পারলাম না সেই আলোচনা চলছে।
আমাদের ১৯৭২-এর সংবিধান একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ দলিল। এবং রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতির একটিও ছিল এই ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সংবিধান সংশোধন করে ধর্মীয় লেবাস লাগানো হয়। এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পঞ্চদশ সংশোধনী করেও রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহ নিয়ে থাকাকেই নিরাপদ মনে করেছে।
যারা ১৯৭২-এর সংবিধান প্রণয়নের সাথে জড়িত ছিলেন তারা চেয়েছেন এটাই প্রতিষ্ঠিত করতে যে, রাষ্ট্র যদি সব সম্প্রদায়কে সমান সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে, তবেই ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হবে সম্প্রীতি, যে সম্প্রীতির কথা বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন বারংবার। তারা জানতেন এবং মানতেন যে, অগণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি করলে কোন লক্ষ্যই অর্জিত হয় না। কিন্তু সেই দিন গত হয়েছে।
হ্যাঁ, এ জমিনে হিন্দু বিদ্বেষ পুরোনো, কিন্তু মোটামুটি এক সম্প্রীতির পরিবেশ ছিল, তা বজায় রাখার একটা তীব্র স্পৃহা মানুষের মধ্যে ছিল। সমস্যাটা হলো সেই স্পৃহাটাই এখন নেই, কেমন যেন এখন ঠুনকো হয়ে ভেঙে পড়ছে। আমাদের চারপাশের শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই যুক্তিকে পেছনে ফেলে বিক্রিত এবং বিকৃত আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিদ্বেষ চর্চা হচ্ছে নিয়মিত। এদের মধ্যে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি যারা ইসলাম ধর্মের মৌলিক অনুশাসনের কোনটিই মানেন না, কিন্তু প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে ধর্মীয় বিভেদ-কে লালন করেন। আমরা উত্তর পাইনা এর জন্য দায়ী কারা?
তাই যত কথাই আমরা বলি না কেন, যত দুঃখ পাই না কেন সত্যটা বলতেই হবে যে, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমাদের সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। বরাবরের মতোই চারদিকে রব উঠেছে – ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাইম, বা ‘এ মৃত্যূ উপত্যকা আমার দেশ নয়’ ‘প্রকৃত ধার্মিক এমন কাজ করতে পারে না’ কিংবা ‘আমরা লজ্জিত’। কিন্তু আসলে এ জাতীয় কথাবার্তা এখন পুরোই অর্থহীন।
রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের প্রসঙ্গ আসছে, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ছাড়ার দাবিও উঠছে। এগুলো সাময়িক আবেগ বা উত্তেজনা। আমরা সবাই জানি এসব দাবি পূরণ হবার নয়। বরং সব রাজনৈতিক নেতৃত্বই পরিষ্কার করে বলুক, তাদের ভোটের রাজনীতি, তাদের আপসের রাজনীতি, তাদের লোভের রাজনীতির ফল সব মানুষকে আর কতকাল ভোগ করতে হবে। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির শিকার আমাদের মানুষ, তাদের দুয়ারে বারবার আছড়ে পড়ছে অশান্তি। সম্প্রীতির শান্ত, স্নিগ্ধ বার্তা নিয়ে যারা ভাবেন, কাজ করেন তারা আজ ঘৃণা আর ভয়ের কালো থাবায় দিশেহারা।
সর্বত্রই এখন হতাশা। তবে হানাহানি যারা করে তারা উজ্জীবিত। যে পরিমাণ হিংস্রতা দেখা গেল এবং যেভাবে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা দেশ বিদেশ থেকে হচ্ছে, তাতে সভ্যতার অর্থটাই বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। ফেসবুক, ইউটিউব সভ্যতার মহাসড়ক। কিন্তু এসবে বড় আকারে এখন ঘৃণার চর্চা। উস্কানি দিয়ে দিয়ে এমনভাবে মগজধোলাই করা হয়েছে যে ধর্মের জিগির তুলে, কাউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে গা কাঁপছে না একটা জনগোষ্ঠীর।
শান্তি আমাদের প্রত্যাশা, কিন্তু বাস্তবতা হলো চারিদিকে শুধু ভয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের গোড়ামির ধাক্কায় একটা আতঙ্কের দেওয়াল ঘিরে ফেলছে মানুষকে। শিক্ষিত বিবেকের এখন বড়ই অভাব। যুক্তি দিয়ে সমস্যাকে বোঝা এবং তার সমাধানের চেষ্টা তাই এখন বিশেষ ভাবে জরুরি। পৃথকীকরণ ও বিচ্ছিন্নতার নানা নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে রাজনীতির আচরণে, এমনকি সংস্কৃতি চর্চায়ও। রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে ব্যবধান আর চাওয়াই যাচ্ছে না যদিও সবাই জানে, রাষ্ট্র যদি সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হয়, তবে কমবে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতা। কিন্তু কে চাইবে সেটা?
দুঃখজনকভাবে বলতে হয় এখন সেরকম নেতা নেই, সেই রাজনীতিও নেই যারা ষাটের দশকের মতো আবার একটা নবজাগরণের প্রচেষ্টা নিবেন। তারা কেউ বুঝতে পারছে না যে, রাজনৈতিক বিজয় শুধু ভোটের দামামা বাজিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব, কিন্তু তা টিকবে না যদি সমাজটি রয়ে যায় অ-সম্প্রীতির।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস