বিস্মৃতিপরায়ণতা ও সামাজিক পুঁজির সংকট
ড. মতিউর রহমান
বিজ্ঞজনেরা বাঙালিদের বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি হিসেবে অনেক আগেই উল্লেখ করে গেছেন। কারণ, আমরা অতি দ্রুত সব কিছু ভুলে যাই। ভুলে যাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা উভয় দিকই রয়েছে। তবে, কিছু কিছু বিষয় ভুলে যাওয়া কখনই উচিত নয়। কারণ, সেসব বিষয় ভুলে গেলে জাতি হিসেবে আমাদের অঅস্তিত্বের সংকট দেখা দিতে পারে, সৃষ্টি হতে পারে নানাবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক সমস্যা। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করলে মনে হয় আমরা করোনা মহামারি উদ্ভূত নানাবিধ দুর্যোগ ও বিপর্যয় ভুলে গেছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত একশ বছরে মানবজাতি করোনা মহামারির মতো মারণব্যাধির সম্মুখীন হয়নি। গোটা পৃথিবী এখন এই মারণব্যাধিকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
করোনা ভাইরাস রোগটি শনাক্ত হয় ২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে। বাংলাদেশে এটি সনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে। সে হিসেবে আজ পর্যন্ত অর্থাৎ ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বে এই রোগে ২৪ কোটিরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৪৯ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। এই রোগে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই মারণ ভাইরাসটি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বকে ব্যাপকভাবে পাল্টে দিয়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে চলা এই মহামারি আমাদের চিরচেনা জগৎটাকে সবদিক দিয়ে অপরিচিত করে দিয়েছে। মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এই রোগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যগত ও মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক গবেষণা হয়েছে। সেসব গবেষণায় ওঠে এসেছে পৃথিবীব্যাপী এই রোগের ব্যাপকতর অভিঘাত। বিভিন্ন বয়সি, শ্রেণি ও পেশার মানুষের জীবন ও জীবিকায় করোনা মহামারি নানা নেতিবাচক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত এই রোগ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন দেশে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল এবং এখনও হচ্ছে (যেমন, লকডাউন, মাস্ক পরা, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, ইত্যাদি)। করোনা ভাইরাসের মতো তীব্র সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে আমরা নিজেদের সমাজ থেকে যত দূর সম্ভব বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলাম। প্রায় সব রকম সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অচেনা মানুষদের সঙ্গে মেলামেশার তো প্রশ্নই ওঠে না। এর ফলে আমাদের অবস্থা কি হয়েছিল সেসব কি আমরা ভুলে গেলাম? আমরা কি ভুলে গেলাম, আকাশ পথ, সড়ক পথ, নৌপথসহ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আমরা কেমন বিপন্নবোধ করেছিলাম? দোকান পাট, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় আমাদের অবস্থা কি হয়েছিল সেসব কি আমরা ভুলে গেছি? সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকাতে আমাদের ছেলে মেয়েদের কী পরিমাণ ক্ষতি হলো, তাও কি আমরা ভুলে গেলাম? আমরা কি আরো ভুলে গেলাম করোনার প্রকোপ যখন বেশি ছিলো তখন সব ধর্মের উপাসনালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল? আমরা কি ভুলে গেছি শিল্প উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে সারা পৃথিবীতে কত মানুষ কর্মহারা হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে? কত পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর সেই পরিবারটির কি অবস্থা হয়েছে?
আমরা কি আরো ভুলে গেছি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর আইসিইউ ও অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করা ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া, তার স্বজনদের কান্নার আহাজারি, কবরস্থান ও শশ্মানে লাশের দীর্ঘ সারি এসবই কি আমরা ভুলে গেছি? আমরা কি এও ভুলে গেছি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দীর্ঘদিনের লকডাউনে আমাদের চার দিকের প্রকৃতি কেমন সজীব হয়ে উঠেছিল?
হ্যাঁ, আমরা সব ভুলে গেছি। আমরা আবার আগের অবস্থায় অর্থাৎ করোনা মহামারি পূর্ব অবস্থায় ফিরে গেছি। আমরা সেই সাম্প্রদায়িক উম্মাদনায় মেতে ওঠেছি। মাদক চোরাচালান, প্রতারণা, জালিয়াতি, হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, নারী ও শিশু পাচার, মানব পাচার, যৌন হয়রানি, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক ও জুয়া, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, ভেজাল খাদ্য/ পণ্য বিক্রি, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সংঘাত, হানাহানি, মারামারি, জখম, চুরি, ছিনতাই, কিশোর গ্যাং, ধর্মীয় উগ্রতা ছড়াতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার, ইত্যাদি সব কর্মকাণ্ডে আবার আমরা সক্রিয় হয়েছি। এসবের মাধ্যমে আমরা করোনা মহামারি উদ্ভূত দুর্যোগ ভুলে গেছি। আমরা যে বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি তা প্রমাণ করেছি।
বিস্মৃতিপরায়ণ না হলে আমরা এসব কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখতাম। আমরা চিন্তা করতাম বিশ্বব্যাপী করোনার আঘাতে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে কত মানুষ দরিদ্র হয়েছে, কত শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ ক্ষুধা পেটে দিন পার করছে। সামনে হয়ত ক্ষুধার মহামারি শুরু হবে। এই ক্ষুধার মহামারি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়েও আমাদের ভাবা দরকার ছিলো। আরো ভাবতে পারতাম আমাদের আরাম আয়েশের নিমিত্তে প্রকৃতির প্রতি যে বিরূপ আচরণ আমরা করেছি–তার ফলাফল কি হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী পঞ্চাশ বছরে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অবস্থা কি দাঁড়াবে– এসবই আমাদের ভাবনায় থাকত।
আমরা আরো ভাবতে পারতাম করোনা মহামারির অভিঘাত সত্ত্বেও আমাদের দেশ কিভাবে তার অর্থনৈতিক সাফল্য ধরে রাখতে পেরেছে। বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে ছোট এই ভূখণ্ডটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে কিভাবে নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প যেমন, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি ট্যানেল, এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে আমাদের দেশের অবস্থা আগামি বিশ-একুশ বছরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কারণ, এসবই আমাদের দেশের জন্য একেবারেই নতুন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নতশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে।
আমরা আরো ভাবতে পারতাম, কেনো এখন মানুষ ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যায় না। কারণ, অর্থনীতিশাস্ত্রের অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মানুষ যখন উন্নয়নের একটা স্তরে পৌছায় তখন তার মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি আকাঙক্ষা কমে যায়। মাথাপিছু আয় একটা নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করা না পর্যন্ত গণতন্ত্রের প্রতি কোনো আকাঙ্খা তৈরি করা সম্ভব হয় না। সুতরাং, গণতন্ত্রের জন্য তথাকথিত যে আন্দোলন সংগ্রাম হয় সেসব আসলে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও উন্নয়ন ব্যাহত করা ছাড়া আর কোনো কিছু নয়। সুতরাং, এবিষয় নিয়ে কি আমরা ভাবতে পারি না। আমাদের ভাবনা চিন্তাগুলো কি আগের মতোই থেকে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন যে, করোনাকালে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত বিরাট জনগোষ্ঠির মনোজগতে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে তার ফলে সমাজে সামাজিক পুঁজির সংকট হয়েছে। সাধারণভাবে মানুষের মনোগত অবস্থা বা মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে কোনো ধরনের বৈষয়িক স্বার্থে চিন্তা না করে কাউকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপৃত করতে পারাকেই সামাজিক পুঁজি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সামাজিক পুঁজির সংকট হলে আমাদের মতো দেশে নানা রকম সামাজিক অস্থিরতা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা মারাত্মক রূপ নিতে পারে। যা আমরা আবারো প্রত্যক্ষ করেছি।
সুতরাং, সামাজিক পুঁজি বাড়াতে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মত সামাজিক পুঁজির উন্নয়ন নিয়ে আমাদের কাজ করার সময় হয়েছে। শিক্ষা হলো সামাজিক পুঁজির অন্যতম উপাদান যার মাধ্যমে সমাজ অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামগ্রিকভাবে উন্নতি লাভ করতে পারে। এছাড়াও আমরা সম্মিলিতভাবে একটা সামাজিক উন্নয়ন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা সমাজ থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাস, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, মানব পাচার, মাদকাসক্তি, নারী নির্যাতন, নারী পাচার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার প্রতিরোধ করে একটি সুস্থ, সমৃদ্ধ ও উন্নত সমাজ বিনির্মাণ করতে পারি। এজন্য সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা।
এইচআর/এমএস