ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচন কমিশন: সার্চ কমিটি বিশ্বস্ত হতে হবে আগে

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ১০:৩৬ এএম, ১৪ অক্টোবর ২০২১

রাজনীতিতে এই সময়ে সবচেয়ে বড় ইস্যু নির্বাচন কমিশন গঠন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই বছরের বেশি সময় থাকলেও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ফলে নতুন একটি কমিশন আগামী নির্বাচনের জন্য জরুরি এবং নির্বাচনের নিরপেক্ষতা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে আরও বেশি করে জরুরি। সেক্ষেত্রে সরকার আগের মতোই সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে চায়। বিরোধী দল নির্বাচন কমিশন নিয়ে এতোদিন সোচ্চার না হলেও এখন কথা বলতে শুরু করেছে। তবে তারা নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর জোর দিচ্ছে।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালে কেয়ারটেকার সরকার রাষ্ট্র চালানোর সুযোগ নেই, তবে চলমান সরকার নির্বাচনকালে কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব সীমিত করে বিরোধীদের সরকারে শরিক করার সুযোগ আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সুযোগ বিরোধী দলকে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বের ঐতিহাসিক ভুলের জন্য তা হয়নি। পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলেও আগের প্রস্তাবিত রূপরেখা অনুযায়ী সেই সরকার ছিল না, সরাসরি দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়েছে এবং তা ব্যাপক আকারে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এখন সবার দায়িত্ব গণতন্ত্রের স্বার্থে তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।

সেক্ষেত্রে সবার আগে আসে নির্বাচন কমিশনের কথা। কমিশন বর্তমানে সার্চ কমিটির মাধ্যমে হচ্ছে। আমার ধারণা আগামীতেও তাই হতে যাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত জোট ছাড়া সবাই সেটা মানতে রাজি থাকবে। যদিও সুধীমহল মনে করে ইসি গঠনের জন্য আইন করা জরুরি। কারণ আইন একটি কাঠামো ও বাধ্যবাধকতার নির্দেশ করে। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য কোনো সরকারই আইন করেনি। এক এগারকালের নির্বাচন কমিশন তাদের ব্যাপক কিছু সংস্কার সাধন ছাড়াও এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করেছিল। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন অভিযোগ করেন, এ টি এম সামশুল হুদা কমিশন নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ২০১১ সালে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের একটি খসড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলেন। সেটি এখনো ঝুলে আছে।

সাধারণের ধারণা নতুন কমিশনার খুঁজতে রাষ্ট্রপতি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সম্ভাব্য নাম চাইলেও চূড়ান্তভাবে তা কোনো ফল দেয় না। এই ক্ষেত্রে যিনি নির্বাচন কমিশন প্রধান হন, তিনি অবশ্যই সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করেন। কমিশনার হিসেবে বিরোধী দলের প্রস্তাবিত লোকও থাকে। সেটাও কোনো কাজে আসে না। আমার দৃষ্টিতে সার্চ কমিটি, আইন করে কমিটি- দুটির মধ্যে প্রার্থক্য শুধু চিন্তায় আর তর্কে। কাজ তাদের একটিই। কমিশন কতটা শক্তিশালী হবে সেটা নির্বাচনকালীন সরকারের চেয়ে নির্বাচন কমিশনে কারা যাচ্ছেন তাদের উপর নির্ভরশীল।

কিন্তু কী রাজনৈতিক দল, কী সুশীলসমাজ কেউ এটা বলছেন না যে, যে সার্চ কমিটি কমিশনার সার্চ করবেন তারা নিজেরা কতটা দক্ষ এই কাছে। পরপর দু’টি সার্চ কমিটির পারফরম্যান্স মানুষকে হতাশ করেছে। বিগত সময়ে দেখিছে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, অধ্যাপক বা সোসাইটিতে নাম আছে এমন কিছু ব্যক্তি নিয়ে এই সার্চ কমিটি করা হয়েছে- তার ফলাফল কি সেটা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট। সুতরাং সার্চ কমিটি হতে হবে তাদেরকে দিয়ে যাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য আছে, স্বাধীন ও নিজস্ব তথ্য আছে- গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য নয়।

সরকার খুব ভালোভাবেই জানে, কোন কাজে কে দক্ষ। নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য কারা দক্ষ ব্যক্তি? নির্বাচন শুধু অবকাঠামো, জনবল দিয়ে হয় না। দরকার যোগ্যতা, দক্ষতা এবং ব্যবস্থাপনার কোয়ালিটি থাকা। এটি একটি বিরাট ব্যবস্থাপনা। সে কারণে আইন করে তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া বা সার্চ কমিটি দিয়ে খুঁজে বের করে দায়িত্ব দেওয়া- আমার কাছে গুরুত্বহীন। মেরুদণ্ড সম্পন্ন দক্ষ ব্যক্তিদের কমিশনার নিয়োগ, সরকারের সুষ্ঠ নির্বাচন করার সদিচ্ছা, আমলাদের সততা এখানে জরুরি। কমিশন দলীয় সরকারের না নির্দলীয় সেটাও গুরুত্বহীন অনেকটা। কারণ মেধাহীন মেরুদণ্ডহীন মানুষদের যদি সাংবিধানিক পদে বসানো হয় তাদের আচরণে, কথা বার্তায় জাতিকে সংকটের আবর্তে পড়ে হিমসীম খেতে হয়।

যে যেই ঘরনারই হউক না কেন সাংবিধানিক পদে থেকে কাজ করার সময় ঘরনার বিষয়টা তাকে প্রভাবিত না করলেই হলো। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ১৯৭০ এর নির্বাচনে চীফ ইলেকশন কমিশনার ছিলেন। তিনি মোহাজের ছিলেন। মোহাজেবরা আওয়ামী লীগকে, বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করতেন না। তারা মনে করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ক্ষমতায় আসতে চাইলে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু সাত্তার সাহেব এলএফও-এর বাইরে এক বিন্দু বিসর্গও যাননি এবং আওয়ামী লীগের জিতে যাওয়াকে ঠেকানোর কোনো চাতুরীর আশ্রয় নেননি। অথচ তিনি পাকিস্তানি ঘরনার লোক। ১৯৭০ এর নির্বাচন শতাংশে নির্ভেজাল হয়েছিলো।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনসহ অনেকের মনোভাব এই যে- নির্বাচনে ইসি কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে থাকলে, বা অন্যান্য দায়িত্বে থাকলে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশন বিগত কয়েকটি উপনির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কমিশনের লোক দিয়ে পরিচালনা করেছে, কিন্তু দক্ষতা দেখাতে পারে নি তারা। নিকট অতীতে নারায়নগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে একজন নারী ইসি কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসার ছিলেন। দক্ষতার সঙ্গে তিনি তা পরিচলনা করেছিলেন, যেখানে আইভি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর কারও সফলতার গল্প চোখে পড়েনি। অতি সম্প্রতি সিলেট-৩ আসনের নির্বাচনের ইসির একজন পদস্থ কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসার ছিলেন কিন্তু সেটাও ফেয়ার নির্বাচন হয়নি। ফলে এটা প্রমাণ করে না যে কমিশনের লোকরা দায়িত্বে থাকলে ভালো নির্বাচন হবে।

বর্তমান সময়ে নির্বাচন এখন একটি বৃহত্তর ইস্যু। এই নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য দরকার যোগ্যতা, দক্ষতা এবং মেকানিজম। আক্ষরিক অর্থেই একজন ডিসি ফেয়ার ইলেকশন করতে পারে। ইউপি নির্বাচনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে ফেয়ার নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু আমরা দেখি দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব ব্যক্তিরা শক্তিশালী প্রার্থীর কাছে, সরকারি আনুকূল্য আছে এমন প্রার্থীর কাছে নির্বাচন বেচে দেয়। বেচার ক্ষেত্রে সরকারি আমলা, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা সবাই ওস্তাদ।

তবে এটা দেখার দরকার আছে একজন ক্যাডার আর নির্বাচন কমিশনের নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মধ্যে কে দক্ষ। কার জবাবদিহিতা আছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা কারা? আমি মনে করি নিম্নমান সহকারী থেকে উচ্চমান সহকারি, উচ্চমান সহকারী থেকে থানা নির্বাচনী অফিসার হয়ে এদের সিংহভাগের দ্বারা নিরাপদ ও সুষ্ঠ নির্বাচন করা সম্ভব না। নামের পাশে সহকারি সচিব, উপসচিব লাগালে উপযুক্ত ভাবার কারণ নেই। দরকার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং ম্যানেজম্যান কোয়ালিটি। নির্বাচনি যজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য প্রজতন্ত্রের আমলাদের উপর নির্ভর করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের অবিশ্বাস করে গণতন্ত্র সুসংহত করা যাবে না। এদের মনোবল, সততা বাড়াতে হবে। মনোবলও সম্পদ। মনোবল যে কত বড় শক্তি সেটাতো আমরা যুদ্ধকালে সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেও দেখি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। [email protected]

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন