ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ইশারার বাহাস থেকে পেশাদার টক শো

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:২৭ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২১

এক সময় ঢেঁড়া পিটিয়ে আয়োজন করার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে বাহাস হতো। বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ে নানা বিতর্ক নিয়ে। শহর তো বটে, গ্রাম-গঞ্জে সাড়ম্বরে বাহাসের আয়োজন চলতো। এখন বাহাস করা সুদূর অতীত। বর্তমানে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স পেরিয়ে বাহাসের ডিজিটালাইজেশন হয়েছে। বাহাসের জায়গা দখল করে নিয়েছে টিভি এবং ইন্টারনেটের ভিডিও কনফারেন্সিং করার জুম ওয়েবিনার প্রভৃতি।

বাহাস আরবী শব্দ। এর সরল বাংলা অর্থ মুখোমুখি বিতর্ক করা। শুরুতে নানা কথোপকথন করা, তারপর যুক্তি, পাল্টা যুক্তি প্রদর্শন, বিদ্রুপ, ঝগড়া, রাগারাগি, ক্ষোভ। শেষে সমঝোতা করার চেষ্টা করা ছিল বাহাসের কাজ। বাহাসের মাধ্যমে জনক্ষোভ নিয়ে তুমুল আলোচনা শেষে অনেক সময় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পাওয়া যেত। তাই অতীতের বাহাসকে অনেকে মুখোমুখি গবেষণা বলে থাকেন। কারণ, তখন বাহাস শুনে সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করে কোন জনমতের প্রতিফলন দেখে বিতর্কিত বিষয়ের মীমাংসা করা হতো।

অতীতে সাত গ্রাম মিলে মাত্র একটি বড় মসজিদে মানুষ নামাজ আদায় করতে আসতো। এখন গ্রামে ভীষণ কুৎসিত রাজনীতি ঢুকে গেছে। দলাদলি থেকে রেষারেষি, মারামারি ও পাড়া-মহল্লায় নানা ইস্যুতে বিভাজন তৈরি হয়েছে। গ্রামে মানুষ কিছুটা বেড়ে গেলেও দু’একটি মসজিদের প্রয়োজন থাকলেও তার জায়গায় ৭-৮টি মসজিদ তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কারণগুলো খুবই ঠুনকো। ধরুন, গ্রামে জমিজমা নিয়ে বৈরিতা দুই পরিবারের মধ্যে। তাদের এক পরিবারের বাড়ির উঠানের কাছে মসজিদ। সেখানে অন্য পরিবারটি নামাজে না গিয়ে দূরের কোন মসজিদে শুক্রবারের জুম্মা নামাজে যায়। অথবা কোথাও বলা হয়, অমুক মসজিদের ইমাম উচ্চারণে ভুল করে। সে নকল করার দায়ে দাখিল পরীক্ষায় একবার বহিষ্কার হয়ে পরেরবার পাস করেছে। তার পিছনে নামাজ আদায় করা ঠিক হবে না। আবার কেউ হয়তো ছড়িয়ে দিল- ওমুক ব্যক্তি নতুন মসজিদে ঘুষের টাকা দান করেছে। সে তো চাকুরিতে কম বেতন পায়, সে দান করার এত বেশি টাকা কোথায় পেল? - ইত্যাদি।

অতীতে মুখামুখি বাহাস ছাড়াও নিজের কেরামতি জাহির করার জন্য ইশারায় বাহাসের আয়োজন করা হতো। একজন বাহাসকারী আঙ্গুল বা হাতের ইশারায় নানা ভঙ্গির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতেন। তা দেখে অন্যজন উত্তর দিত। সেসব উত্তরের ব্যাখ্যা উপস্থিত জনগণের মনমত হলে সেটা গ্রহণ করা হতো। তবে এসব গ্রাম্য বাহাসে ধর্মীয় জ্ঞানের রেফারেন্সিংসহ ব্যাখ্যার চেয়ে সিংহভাগ ক্ষেত্রে বাক্যবাগিশ উপস্থিত বুদ্ধিওয়ালা বাহাসকারী জয়যুক্ত হতো।

এ নিয়ে কিছু গল্পও প্রচলিত রয়েছে। এ গ্রামে একবার ইশারায় বাহাসের আয়োজন করা হলো। ১ম বাহাসকারী মুখ বুঁজে তার হাতের একটি শাহাদৎ অঙ্গুলি প্রদর্শন করলেন। তারপর চুপ থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে তার পুরো হাত কয়েকবার ঘুরিয়ে বুঝাতে বললেন এর অর্থ বলতে পারলে তিনি তার সাথে আর বাহাস করবেন না।

একজন প্রতিযোগী উত্তর দিলেন এক আল্লাহ, আরেকজন বললেন এক সূর্য, এক চন্দ্র, ইত্যাদি। কিন্তু তার হাত ঘুরানোর ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারলেন না। শেষে সেখানে উপস্থিত থাকা একজন স্কুলছাত্র বলতে লাগলো- আপনাদের এক আল্লাহ, এক সূর্য, এসব কথা ঠিক আছে। কিন্তু আমি বলছি- তিনি জানতে চাচ্ছেন, আজ যার বাড়িতে বাহাস করা হচ্ছে তার একটি সরিষার তেল মাড়াইয়ের ঘানিকল আছে। সেই ঘানিকল একটি মাত্র মহিষ দিয়ে টানা হয়। সেটার জোয়ালে ওজন বাড়ানোর জন্য আরেকজন মানুষ বসে ওজন ভারী করে এবং মহিষটাকে তাড়া দেয় আর মহিষটা দ্রুত ঘুরতে থাকে এবং তাড়াতাড়ি তেল মাড়াই করে।

আসলে বাহাসকারী সেটাই ভেবে ইশারায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ছেলেটির উত্তর ঠিক। বাহাসে উপস্থিত সবাই সে ব্যাখ্যাটাকে সত্য বলে মেনে নিল। কারণ, সেটাতে যুক্তির সাথে বাস্তবতার মিল রয়েছে। অর্থাৎ, উপস্থিত বুদ্ধি মানুষের সবচেয়ে বড় উপকার করে, জীবনও বাঁচাতে পারে।

আজকাল টিভি চ্যানেল শতশত। সেগুলোতে নিয়মিত টক-মিষ্টি কথোপকথন প্রদর্শিত হয়। এসব বিতর্ক ও আলোচনা মাঝে মাঝে রাগারাগি, হাতাহাতি, চেয়ার ছোড়াছুঁড়ি, ওয়াকআউট, বয়কট পর্যন্ত গড়ায়। যা দর্শকদের জন্য খুবই দৃষ্টিকটু। এছাড়া টক শোর জন্য আলোচকদের সম্মানী দিতে হয়। কেউ কেউ সেই সম্মানীর টাকা আয়করের রিটার্নেও প্রদর্শন করে থাকেন! অর্থাৎ বিষয়টি মোটেও সামান্য নয়। এট একটা উপার্জনমূলক পেশা অথবা বৃত্তিতে পরিণত হয়েছে।

এছাড়া ইউটিউবের সুবাদে ধর্মীয় বিষয়সহ সকল ধরনের কবিগান, বিতর্ক ও বক্তৃতার ভিডিও ইন্টারনেটে দেখা যায়। সেখানে টিভির চেয়েও বেশি বিভক্তি, উষ্মা, ক্ষোভ চোখে পড়ে। কেউ আন্দোলনের ডাক দেয়, কেউ বিদ্রুপ করে, কেউ অপরের চরিত্র হনন করে কথা বলে। কেউবা আবার ঘৃণা ও অপবাদ ছড়ায়, সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়। তবে কেউ কেউ সৎ কথা বলে, চিকিৎসা, ও সদুপোদেশের বাণী শোনায়। ঘুষ-দুর্নীতি, জালিয়াতি, মাদক নির্মূলের কথা প্রচার করেন।

একথা সত্যি যে, মন্দ জিনিস চিরদিনই মন্দ। খারাপ মানুষ চিরকালই খারাপ। মুর্শিদাবাদের মীরজাফরের বাড়ির রাস্তা চিনতে চাইলে ‘নিমক হারাম দেউড়ী’ দেখিয়ে দেয় যে কেউ। হিরোশিমা বা নাগাসাকি দেখতে যাওয়া ভ্রমণকারীদেরকে সেখানকার গাইডরা প্রতিদিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার নিষ্ঠুরতার কথা শুনিয়ে চোখে পানি এন দেয়। পর্যটকরা কেঁদে কেঁদে আমেরিকাকে ঘৃণা করে, বদদোয়া করে।

পৃথিবীতে যত ঐতিহাসিক নিদর্শন বা ঘটনা রয়েছে সেগুলোর ধারা বর্ণনায় হাজার হাজার গাইড প্রতিদিন তাদের কুকীর্তি বা সুকীর্তির কথা শোনায় পর্যটকদেরকে। তাদের কথায় কেউ ধিকৃত হয় কেউবা ধন্য হয়। যেখানেই বাহাস হোক বা টক শো হোক সেখানেই আমরা সবাই সতর্কভাবে ঠিক কথা বলি ও সততার চর্চা করে মানুষের নৈতিকতাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে শানিত করে তুলি।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক।
[email protected]

এইচআর/এমএস