ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মুহিবুল্লাহর হত্যা এবং গ্লোবাল রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ০৭ অক্টোবর ২০২১

বাংলাদেশে বসবাসরত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার তোড়জোড়, মাথাব্যথা নেই বিশ্ব মোড়লদের। তবে রোহিঙ্গাদের শীর্ষনেতা মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা খুব সোচ্চার হয়েছে এর বিচার নিয়ে। সেই সঙ্গে শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের অনিরাপত্তার বিষয়টি উঠে এসেছে কয়েকদিন ধরে বিশ্ব মিডিয়ায়। হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশের এটিকে এড়িয়ে যাওয়ারও উপায় নেই।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের অনিরাপত্তার বিষয়টি উঠে এসেছে। হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে এবং সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে. ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে হত্যাকাণ্ডের ‘পূর্ণ ও স্বচ্ছ’ তদন্ত পরিচালনার আহ্বান জানান। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে ঘটনার বিচার দাবি করেছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চার বছর পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ মংডুর সাবেক স্কুলশিক্ষক মুহিবুল্লাহ কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে বন্দুকধারীদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুহিবুল্লাহ মূলত বাংলাদেশে আসেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে যখন দ্বিতীয় দফা রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। এর মধ্যে তার মিয়ানমারে আসা-যাওয়ায় ছিল। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াসহ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুহিবুল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি `মাস্টার মুহিবুল্লাহ' নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বক্তব্য দেওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গাদের কথা বলা এবং রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ ঢলের আগমনের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ক্যাম্পের একটি ফুটবল মাঠে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার এক সমাবেশ আয়োজন করার পর রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে তার নামটি সামনে চলে আসে। রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়ও ছিলেন। ইংরেজি ভালো জানতেন বলে যে কোনো বিদেশি অতিথি ক্যাম্পে গেলে মুহিবুল্লাহর সঙ্গে দেখা হতোই।

ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠী এবং চরমপন্থি সশস্ত্র গ্রুপ ক্রিয়াশীল। যেমন- আরসা, আল ইয়াকিন, আরএসও, ইসলামি মাহাত। এর পাশাপাশি সিভিল রাইটস ও মানবাধিকার ইস্যুতেও আন্দোলন করছে এমন কিছু সংগঠনও আছে। তার মধ্যে অন্যতম মুহিবুল্লাহর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, মুহিবুল্লাহর মতাদর্শের বিরোধীরা তাকে হত্যা করতে পারে। মুহিবুল্লাহর ভাই হাবিবুল্লাহও এ হত্যাকাণ্ডের জন্য আরসার একটি সশস্ত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীদের দায়ী করেছেন।

একটা কথা এখন স্বীকার করতে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে যেসব সমস্যার সম্মুখীন তার মধ্যে বর্তমান রোহিঙ্গা সমস্যা একটা কঠিনতম সমস্যা। সমস্যা উত্তরণে বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে সত্য কিন্তু সেটা যে কাজে আসছে না সেটা এখন স্পষ্ট।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান শেষে দেশে ফিরে এসে যে সংবাদ সম্মেলন করলেন সেখানেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া নিয়ে হতাশার সুর ছিল তার। জাতিসংঘের বক্তৃতায়ও একই সুর ছিল তার। তিনি বলেছেন, আমরা তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সমাবেশে এবং আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আস্থা রেখেছিলাম। আমাদের কথা শোনা হয়নি, আমাদের আশা অপূর্ণই থেকে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী এটাও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রাখার ক্ষেত্রে বেশি উৎসাহী। কারণ এর সঙ্গে তাদের অনেকের চাকরি-বাকরি জড়িত। তারা রোহিঙ্গাদের জন্য আরাকানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কিছু করতে চাওয়ার চেয়ে বাংলাদেশে করতে চায় এবং প্রধানমন্ত্রীর তাতে সম্মতি নেই।

একই কথা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখেও শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনিও বলেন, ‘বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি লং টার্ম রিহাবিলেশনের চিন্তা করে। চার বছর ধরে রাখাইনে কোনো সংঘাত কোনো মারামারি নেই। কিন্তু ওরা ওদের বলে না ওখানে যাও। তাদের উদ্দেশ্য হলো এখানে অনেক দিন থাকলে তাদের চাকরি অনেক দিন থাকে। এদের জন্য অনেক অনেক টাকা আসছে। এই টাকা কীভাবে খরচ হয় আমরা ঠিক সেটা জানি না। এটা দুঃখজনক। আমাদের একমাত্র অগ্রাধিকার হচ্ছে রিপাট্রেশন। বাকি সবগুলো দ্বিতীয়।’

বাংলাদেশ ২০১৮ সালের নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের আগস্টে দু’দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, একজন রোহিঙ্গাও যেতে রাজি হয়নি। মিয়ানমারে আর কোনো নির্যাতন চালানো হবে না, এই মর্মে তারা মিয়ানমার থেকে কোনো আশ্বাস পায়নি। এখন পরিস্থিতির উন্নতি কবে হবে তার কোনো হদিস নেই। বরং সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক আশ্রয়দাতা দেশগুলোতে রোহিঙ্গাদের চাকরি করার, জমি কেনার বা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে।

সরকার স্বীকার না করলেও এটা সত্য যে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। চীন-ভারত এ সমস্যার সমাধান করবে আমরা এ আশায় বসে আছি, আবার এই দুই দেশ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে নেই। যখনই কোনো সিদ্ধান্ত মিয়ানমারের বিপক্ষে যাচ্ছে দেখেছে, চীন বার বার ভেটো দিয়েছে।

মুহিবুল্লাহর মৃত্যুর পর এখন আরেকটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে যে, বাংলাদেশ কেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি করতে সহায়তা করছে না? এত বড় একটি জনগোষ্ঠীর কোনো প্রতিনিধি না থাকলে সরকার জরুরি মুহূর্তে শরণার্থীদের কাছে বার্তা পৌঁছাবে কীভাবে! যেখানে নেতা নেই সেখানে তো বিশৃঙ্খলা হবেই, পাতি নেতাদের উৎপাত থাকবে, মাস্তানরা রাজত্ব করবে এবং সশস্ত্র তৎপরতা বাড়বে। সরকারের এটা বহু আগে থেকে ভাবা দরকার ছিল।

সেই সঙ্গে বাংলাদেশ কেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরা ত্বরান্বিত করতে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে না সেই প্রশ্নও উঠছে। মুহিবুল্লাহ নিজের গুণে উঠে আসা নেতা। তাকে রোহিঙ্গাদের নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সহায়তা করেনি বরং ২০১৯ সালের সমাবেশের জন্য পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল তাকে।

ইউরোপে অবস্থান করছেন এমন কয়েকজন বাংলাদেশি কূটনীতিক আমার সঙ্গে হতাশা নিয়ে বলেছেন তাদের কাছে দূতাবাসে গিয়ে সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা ওই দেশে জনমত গঠনে কাজ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তারা এ ব্যাপারে ঢাকায় যোগাযোগ করলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সাড়া পাননি। অনেক দেশের সরকারও রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রশ্নে সোচ্চার ছিল, সংবাদমাধ্যমেও বাংলাদেশের পক্ষে সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল, কিন্তু জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া তেমন দৃশ্যমান ছিল না। সে জায়গায় রোহিঙ্গাদের কাজ করার অনেক সুযোগ ছিল তখন।

রোহিঙ্গা নিয়ে এর আগে যতবার সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সমাধান হয়েছে মিয়ানমারের সামরিক শাসন থাকা অবস্থায়ই। বাংলাদেশ মিয়ানমারের বর্তমান শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে ভালোই কূটনৈতিক দক্ষতা দেখিয়েছে। কিন্তু সামরিক সরকারকে চাপে রাখার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে ভুল করেছে। সারাবিশ্বে বিশেষ করে উন্নত দেশে যেসব রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা ছড়িয়ে আছে, মিয়ারমারকে চাপ দিতে বাংলাদেশের তাদের কাজে লাগানো উচিত ছিল। উচিত ছিল বাংলাদেশে অবস্থানত রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বকেও স্বীকৃতি দিয়ে সারাবিশ্বে জনমত সৃষ্টিতে পাঠানো।

এখনো সারাবিশ্বে রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা সক্রিয় আছে, প্রবাসী রোহিঙ্গা নেতারা তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার আছে। আমার মনে হয় সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রশ্নে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি প্রবাসী রোহিঙ্গাদের কাজে লাগাতে পারে। দেশেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব প্রক্রিয়া গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রকৃত নেতাদের স্বীকৃতি দিতে পারে। তাতে রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেমন বাড়বে তেমনি তারা আন্তর্জাতিক মহলেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। নয়তো যতই দিন যাবে বিশ্ববাসীর সামনে একটার পর একটা সমস্যা আসবে, সিরিয়ান শরর্ণার্থীদের পর আফগানিস্তান শরণার্থী প্রাধান্য পাবে। ভুলে যেতে বসবে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিয়ে কী বিপদে আছে সেই বিষয়টি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]

এইচআর/এএসএম