প্রবাসী নারী শ্রমিকদের কথা ভাবতে হবে
করোনার শুরু থেকেই স্থবিরতা বিরাজ করছে সব দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রম বাজারে। এর প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারেও। বিশ্বের বেশি কিছু শ্রম আমদানিকারক দেশ শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক দেশই প্রবাসী শ্রমিকদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে, দেশে ফিরে আসা শ্রমিকরা নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছেন ফিরে আসা নারী শ্রমিকরা। দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে আমাদের দারিদ্র্য কাটেনি। অর্থনীতি বড় হওয়ার পেছনে যাদের অবদান সর্বাগ্রে স্মরণীয়, তারা আমাদের প্রবাসী শ্রমিক। এই শ্রমিকরা জীবিকার টানে দেশ থেকে পাড়ি জমান অজানা গন্তব্যে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও কর্মের জন্য বিদেশে যান। পরিবারে একটু সচ্ছলতা আনার জন্য গরু, বাছুর, জমি-জমা বিক্রি করে বিদেশে যান অনেকে।
এক-দেড় লাখ থেকে শুরু করে চার পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকরা যান। দালাল ধরে বৈধ-অবৈধ সব পথেই পাড়ি জমান তারা। সাগর পথে অথবা আকাশ পথেও হতে পারে এই ভ্রমণ। যাওয়ার পরে অনেকেই হারিয়ে যান অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। যারা বৈধ পথে যান, তাদের অনেকের জীবনেও নেমে আসে সেই একই অন্ধকার। বিদেশে গিয়েও তাদের কাটাতে হয় দুর্বিষহ জীবন। আর অবৈধ পথে যারা যান, তাদের অবস্থাতো আরও শোচনীয়।
একজন নারী শ্রমিক এক কাজের প্রতিশ্রুতি পেয়ে বিদেশে গিয়ে অন্য কাজ করতে বাধ্য হন। পান না তার প্রতিশ্রুত মজুরিও। এক পরিসংখ্যান বলছে, মজুরি না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন ২৩ শতাংশ শ্রমিক। মোট ৫৫ শতাংশ নারীকে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ- বিলস্-এর তথ্য মতে ২ শতাংশ নারী শ্রমিক বিদেশে জবরদস্তিমূলক শ্রমের শিকার হয়েছেন। অবৈধ পথে যারা বিদেশে গেছেন, তাদের কথা বাদই দিলাম, বৈধ পথে গিয়েও প্রতিশ্রুত কাজ ও বেতন না পাওয়া চরম অন্যায়। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপে নেওয়ারও যেন কেউ নেই। বৈধ পথে বিদেশে গিয়ে এভাবে প্রতারিত হওয়ার পরেও তাদের আবার জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
বৈধ অথবা অবৈধ, যেভাবেই যাক না কেন, নারী শ্রমিকরা এই ধরনের জবরদস্তিমূলক শ্রমের শিকার হচ্ছেন, প্রতিশ্রুত বেতন ও কাজ পাচ্ছেন না। আর যারা থাকতে পারছেন, তারাও নানা নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। মোদ্দা কথা, বিদেশে গিয়ে এক মানবেতর জীবন যাপন করছেন অনেক নারী শ্রমিক। এমনকি খাদ্য ও পানির অভাবেও জীবন কাটছে অনেকের। ৬১ শতাংশ নারী শ্রমিক বিদেশে খাদ্য ও পানির অভাবে ভুগেছেন। তার ওপর আছে শারীরিক নির্যাতন। প্রায় ৩৮ শতাংশ নারী নানাভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার। বিদেশের মাটিতে তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই।
এই যে নারীরা এতো টাকা খরচ করে বিদেশে যান, তাদের অনেকেই বিদেশের মাটিতে থাকার খরচ মিটিয়ে আর দেশে টাকা পাঠাতে পারেন না। যে ধার-কর্য করে বিদেশে যান, সে টাকাও শোধ করতে পারেন না অনেকে। গড়ে ৭৭ হাজার টাকার ঋণের বোঝা রয়েছে একেক জনের কাঁধে। এদিকে যে স্বামী-সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে বিদেশে যান, সেই স্বামীও দেশে আরেকজনকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। এভাবেই সব হারান প্রবাসী নারী শ্রমিকরা। বেঁচে থাকার জন্য সব স্বপ্নের মৃত্যু হয়।
করোনা প্রবাসী শ্রমিকদের, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের জীবনকে করেছে আরও কঠিন। করোনাকালীন শ্রম পরিস্থিতি ও জব কাটের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন নারীরা। কিন্তু দেশে ফেরার পরেও কি তারা ফিরতে পেরেছেন স্বাভাবিক জীবনে? কেউ কেউ হয়তো পেরেছেন। কিন্তু অনেকে তো সব হারিয়ে হতাশায় ডুবে গেছেন চিরদিনের জন্য। বিলসের এক পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশ ফেরত ৮৫ ভাগ নারী শ্রমিকই হতাশায় ভুগছেন। তার মানে, যে আশা নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন, অধিকাংশ নারীই তার দেখা পাননি।
হতাশা কাটিয়ে কাজে ফেরার মতো সহায়ক পরিবেশও তাদের জন্য নিশ্চিত করা যায়নি। বিদেশফেরত নারী শ্রমিকদের প্রতি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট নেতিবাচক। সব বিদেশে ফেরত নারীদেরই আমরা মনে করি, তারা বাসা বাড়িতে কাজ করেছেন। আমরা মনে করি যে বিদেশে গিয়ে সব নারীই বুঝি যৌনদাসী বা পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত হন অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। ফিরে আসা অনেক নারীকেই সমাজ চরিত্রহীন মনে করে। কিন্তু বিষয়টি মোটেই সে রকম নয়। কারণ পরিসংখ্যানই বলছে, মাত্র ৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন, তারা ভিকটিম। এটি মূলত নারীর প্রতি আমাদের যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, তারই বহিঃপ্রকাশ। আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। দেশে ও বিদেশে সুবিধা বঞ্চিত এসব নারী শ্রমিকরা সবাই আসলে কোনো না কোনোভাবে ভিকটিম।
একদিকে তারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হচ্ছেন, অন্যদিকে দেশে ফিরেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না। প্রায় ৬০ শতাংশ নারী কাজেই ফিরতে পারেন না। ফলে, অনেকেই শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন, যার চিকিৎসাও তারা করাতে পারেন না। হিসাব মতে, ৮৭ শতাংশ নারী শ্রমিকই মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পান না। কাজেই, বোঝাই যাচ্ছে যে ফিরে আসা শ্রমিকরা হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। বিদেশে যাওয়ার পর, দেশ তাদের কথা ভুলে যায়। ফিরে আসার পরও দেশকে তাদের পাশে পান না। পান না পরিচিত মানুষগুলোকেও। তাদের সমস্যার কথাগুলো শোনারও যেন কেউ নেই। বিদেশে আমাদের নারী শ্রমিকরা কি কি সমস্যায় পড়েন, সে অনুযায়ী ওই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা থাকলেও তার ফল আমরা দেখি না।
প্রবাসে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে তারা কথাও বলে। সরকার বা দূতাবাসগুলোর পক্ষ থেকে এমন দাবির কথা আমরা শুনি। কিন্তু তারপরও কেন নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন হয় কেন তারা অধিকার বঞ্চিত হয়, কেন তারা উপযুক্ত চিকিৎসা পায় না- এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সবাইকেই ভাবতে হবে। এমন নয় যে দূতাবাসগুলো কাজ করছে না। হয়তো তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু সে সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলোও সামনে আসতে হবে।
বিদেশের মাটিতে যেমন নারী শ্রমিকদের প্রত্যাশিত জীবন নিশ্চিতে সরকারকে কাজ করতে হবে। তেমনি ফিরে আসার পরও তাদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিতে পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এখনও ন্যূনতম দক্ষতা উন্নয়ন না করেই অনেক নারী শ্রমিককে বিদেশে পাঠানো হয়। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অধীনে যে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো রয়েছে তার আওতা আরও বাড়াতে হবে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ভিশন হচ্ছে, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, দক্ষতা উন্নয়ন ও অভিবাসী কর্মীদের অধিকতর কল্যাণ ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা।
এ কাজ করতে হলে তাদের আরও বেগবান হতে হবে। আর মিশনে বলা আছে, বিশ্ব বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে যথাযথ কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সুষ্ঠু ও সুসংহত অভিবাসন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কর্মপ্রত্যাশী জনগোষ্ঠীর বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা, অধিকতর কল্যাণ ও অধিকার নিশ্চিত করা। প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যুরো তার কাজ কতটা করতে পারছে। তার সীমাবদ্ধতা থাকলে সেগুলোও সমাধান করতে হবে। বিদেশে আমাদের ৩০টি শ্রম উইং আছে। কিন্তু গণমাধ্যমে আমরা প্রায়ই দেখি, বিদেশি শ্রমিকরা তাদের প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ এর ২৪ ধারায় এসব উইং-এর যে কাজ ও দায়-দায়িত্বের কথা বলা আছে তার কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে? এই উইংগুলোকে আরও সক্রিয় করার সুযোগ আছে কিনা তাও ভাবতে হবে।
প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্র সমতার নীতি প্রয়োগ করবে এটাই কাম্য। এই সমতার নীতি শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসার পরেও প্রয়োগ হবে, এটাও প্রত্যাশিত। দেশে ফিরে আসার পর প্রবাসী শ্রমিকরা আইনে তাদের প্রাপ্য সেবা থেকে তারা বঞ্চিত হন। নারীরা এক্ষেত্রে আরও বেশি বঞ্চিত। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩ এর ৬ ধারার বলা হয়েছে এক্ষেত্রে কোনো প্রকার বৈষম্য করা যাবে না।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর দায়িত্ব অনেক বেশি। আইনানুযায়ী প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করিবে এই ব্যুরো। কাজেই ব্যুরো সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন হলেও তাও করতে হবে। একজন প্রবাসী শ্রমিকের তথ্যের অধিকার থেকে শুরু করে আইনগত সেবা পাওয়ার অধিকারসহ নানা অধিকারের কথা বলা আছে আইনে। কাজেই প্রশ্ন আইনের নয়, আইনের কার্যকারিতা নিয়ে। প্রবাসী নারী শ্রমিকদের অধিকার, দাবি, পুনর্বাসন, চিকিৎসাসহ নানা সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোসহ সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব রয়েছে তাদের পাশে দাঁড়ানোর।
লেখক : আইনজীবী ও কলাম লেখক।
এইচআর/এএসএম