ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শিশুর জন্য বিনিয়োগ, এসডিজি এবং শিশুশ্রম

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ০৬ অক্টোবর ২০২১

মো. আকতারুল ইসলাম

‘শিশু’ শব্দটির মাঝে লুকিয়ে আছে মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন, বাবার প্রতিচ্ছবি, বাবা-মায়ের অস্তিত্ব এবং আগামী প্রজন্ম। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় শিশুকে আগামীর প্রতিনিধি হিসেবে এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রেখে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন-‘এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান… এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’। এ ক’টি চরণের মর্মকথা- বিশ্বময় মানবজাতির হৃদয় উদগত।

সময়ের পরিক্রমায় ব্যক্তির নিজের, সমাজের এবং দেশের আগামী ন্যস্ত হবে আজকে যে শিশু তার ওপর। একটি জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির বীজ সুপ্ত অবস্থায় লুকায়িত থাকে শিশুর মধ্যেই। একটি শিশু জন্ম নেওয়া মানে যে শুধু সেই শিশুটির মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে, এমনটা কিন্তু নয়; বরং একটি জাতির উন্নতির সঞ্চার হয় সুষ্ঠু পরিবেশে বিকশিত হওয়া সেই শিশুর দ্বারা। আজকের শিশুদের হাতেই ন্যস্ত হবে আগামী দিনের নেতৃত্ব।

একটি মহৎ জাতি গড়ে তোলার মূল পন্থা এটাই, আর তা হলো উন্নত চরিত্র এবং সুগঠিত বিকাশপ্রাপ্ত শিশুর সমন্বয় অনুকূল পরিবেশ, উপযুক্ত শিক্ষা। দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে শিশুদের গুরুত্ব, শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সব মানুষকে আরো সচেতন করা এবং শিশুরা যাতে সঠিক শিক্ষা পায় সে বিষয়ে সমাজের সকলের নিকট বার্তা পৌঁছানোর জন্য প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব শিশু দিবস এবং শিশু অধিকার সপ্তাহ’ পালন করা হয়। বিশ্ব শিশু দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে“শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ি”।

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শিশুর জীবন’ কবিতায় বলেছেন, ‘সম্ভাবনার ডাঙা হতে, অসম্ভবেরউতল স্রোতে, দিই না পাড়ি স্বপন তরী নিয়ে’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়তে সম্ভাবনার ডাঙায় বসে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার সেই শিশুদের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েস্বপ্ন তরী নিয়ে মহান স্বাধীনতার পরে সংবিধানে শিশুদের সকল বিষয়কে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন।

জাতির এ স্বপ্নপূরণে তিনি গরিব, মেহনতি, কৃষক ও শ্রমিকের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করেন। এজন্য ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন।১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে তিনি সুস্পষ্ট কিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন। তাঁর প্রথম প্রস্তাবই ছিল শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ। ‘সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।’ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বিশ্ব শিশু দিবসের প্রতিপাদ্যে সেই বিনিয়োগের কথাই উঠে এসেছে।

বিশ্বের সব দেশের সামনে জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন (এসডিজি) আর আমাদের সামনে এসডিজি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ঘোষিত রুপকল্প-২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন। লক্ষ্য দু’টিকে সামনে রেখে এবারের প্রতিপাদ্য বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী হয়েছে নিঃসন্দেহে বলা যায়। এসডিজির মূল থিম হচ্ছে- leave no one behind. এসডিজির মূল কথা চারটি জাদুকরী শব্দ 'কাউকে পেছনে না ফেলে'। সমাজের কাউকে পিছিয়ে রেখে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন পূর্ণতা পাবে না। অন্যদিকে রুপকল্প-২০৪১ মানে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ মানে সেখানে থাকবে না কোনো দারিদ্র্য এবং মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।

দরিদ্রতা শূন্যে নামিয়ে আনতে হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতি লভ্যাংশকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। আজকে যারা শিশু, বিশ বছর পরে তারা পূর্ণ কর্মক্ষম যুবক। এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মধ্যেই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন নির্ভর করছে। সঠিকভাবে ব্যবহারের মানে হলো কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলে কাজে লাগানো। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষা সংস্কার ও বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মস্থান। একটি জাতি এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর সুযোগ একবারই পায়। যে কোনো দেশে এই সুযোগটি দুই বা তিন দশকব্যাপী বহাল থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনমিতি বোনাস প্রাপ্তির স্বর্ণযুগ চলছে। সবাই মিলে এখনই এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে হবে।

এসডিজি এবং রুপকল্প-২০৪১ এর প্রবাহমান ধারা একই মোহনায় মিলিত হয়েছে। দু’টি লক্ষ্য পূরণেই প্রয়োজন সমাজের সকলকে একই তরীতে মোহনায় পৌঁছানো। এজন্য সরকার নিরলস কাজ করছে। সমাজের এসব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদাভাবে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আর্থিক সহায়তা, শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা, দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আইটি বেইজ প্রশিক্ষণ, শিশুশ্রম নিরসন কর্মসূচি, চাকরির সুযোগ, সরকারি সুযোগে অন্তর্ভুক্তি এবং তাদের পণ্য বিক্রয়সহ মূলধারায় আনার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এসকল উদ্যোগের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসন কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসডিজির অভিক্ষা ৮ হচ্ছে- ‘স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই প্রবৃদ্ধি ও শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শিশুশ্রম নিরসন করা। ২০২৫ সালের মধ্যে সকল প্রকার শিশুশ্রম নিরসন করতে হবে।

শিশুর সুরক্ষা, বিকাশ ও উন্নয়নশিশুদের অধিকার। সুরক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশু, পথশিশু, শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর অধিকার নিশ্চিতে শেখ হাসিনার নির্দেশে শ্রমও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি প্রনয়ন করে এবং ২০১৩ সালে ৩৮টি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত শিশুশ্রমের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ কে ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়। ২০১৮ সালে শ্রম আইন সংশোধন করে বলা হয়- ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না, তবে ১৪ থেকে ১৮ বছর পযর্ন্ত শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন হালকা কাজ করতে পারবে। শুধু তাই নয়, এবছরের মধ্যেই চাকরির সর্বনিম্ন বয়স সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন- ১৩৮ অনুস্বাক্ষর করবে বাংলাদেশ। এ কনভেনশন অনুস্বাক্ষরের মাধ্যমে আইএলও এর ৮টি কোর কনভেনশন অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হবে বাংলাদেশ।

ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ের কার্যক্রম বাস্তবায়ন চূড়ান্ত অবস্থায় রয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনা হবে। তাদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের এ সময়ে শিশুর বাবা-মাকে মাসিক সম্মানী ও দেয়া হবে। সাথে সাথে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রমও গ্রহণ করা হবে।

সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এবং দাতা সংস্থাগুলোও শিশুর উন্নয়ন, বিকাশ এবং শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সফলতার সিঁড়ি বেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র রূপকল্প - ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়বো - এই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।

লেখক : তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

এইচআর/জেআইএম