পাবলিক বাসে চড়তে চাই, ফুটপাতে হাঁটতে চাই
ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চলছে শম্বুক গতিতে। মার্সিডিজ বেঞ্জ আর রিকশা-ঠেলাগাড়ির একই গতি। গাড়িতে কয়টায় উঠে গন্তব্যে কয়টায় পৌঁছাবেন তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কিছুদিন ধরে সেটা একেবারেই অসহ্য হয়ে উঠেছে। ঢাকার রাস্তায় কি ট্রাফিক পুলিশ কাজ করছে না!
অদ্ভুত ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা এখানে। সব মোড়ে সিগন্যাল আছে কিন্তু সংরক্ষিত এলাকা ছাড়া সিগন্যাল দেখে কোথাও গাড়ি চলে না। ট্রাফিক পুলিশকে দোষারোপ করবেন সেটাও পারবেন না, বিবেকে বাধে যে সারাদিন রোদে-বৃষ্টিতে কী যে পরিশ্রম করেন বেচারারা। আবার দোষ দিতে চাইলে সে সুযোগও আছে। মোড়ে মোড়ে যেখানে গাড়ি দাঁড়ানোর কথা সেখানে গাড়ি দাঁড়ায় না। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে মানুষ পার হতে চাইলেই গাড়িগুলো জেব্রা ক্রসিং কী জিনিস জানে না। আবার অনেক পথচারী জেব্রা ক্রসিংয়ের ধার ধারে না।
ট্রাফিক পুলিশের ওপর সবচেয়ে বেশি অভিযোগ মোড়ে মোড়ে ওরা চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। ট্রাক, বাস, প্রাইভেটকার, মাইক্রো ওদের প্রধান টার্গেট। হয়রানিতে ওদের তালিকার শীর্ষে আছে মোটরসাইকেল আবার এই মোটরসাইকেল যখন বেপরোয়া চলছে, রাইড শেয়ারিং যাত্রীদের জন্য যে মানের হেলমেট রাখার কথা সেটা রাখছে না- তা নিয়ে পুলিশের মাথাব্যথা নেই। হেলমেটের নামে কারখানার টুপি পরতে বাধ্য হচ্ছে মোটরসাইকেল যাত্রীরা। মোটরসাইকেলকে ট্রাফিক পুলিশ ধরে নানা ছুতায় মামলা দেওয়ার জন্য।
শুনেছি ঢাকায় মামলা দেওয়ার জন্য দৈনন্দিন একটা টার্গেট দেওয়া হয়েছে তাদের। সেই কোটা পূরণের জন্যও তারা মরিয়া। অ্যাপসে চলা উবার, পাঠাওসহ রাইড শেয়ারিং কোম্পানি মাঝে মাঝে ক্ষিপ্ত হয়ে স্ট্রাইক করে। কিন্তু রেজাল্ট কী আসে তারা জানে। দেশে ১১টি কোম্পানি মোবাইল অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং করছে। কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়ার তালিকা চালকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। তাই ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ানো রোধে আইন দরকার বলে মনে করেন রাইড শেয়ারিং করা মোটরচালক ও যাত্রীরা।
অতি সম্প্রতি রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোড এলাকায় রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের এক মোটরচালক ট্রাফিক পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের মোটরসাইকেলে নিজেই আগুন দিয়ে তো শোরগোল তুলেছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ সকালের দিকে এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, ওই মোটরসাইকেলচালক ট্রাফিক সংক্রান্ত কোনো মামলার বিষয় নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। ওই প্রতিক্রিয়ার একপর্যায়ে তিনি নিজের মোটরসাইকেলে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। আশপাশে থাকা লোকজন মোটরসাইকেলে পানি ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে এতে ওই চালক বাধা দেন। তিনি আরও পেট্রল ঢেলে দিলে মোটরসাইকেলটি দাউ দাউ করে পুড়তে দেখা যায়।
বাড্ডা থানা পুলিশ বলেছে, ওই ক্ষুব্ধ ব্যক্তি রাজধানীর লিংক রোড এলাকায় ট্রাফিক আইন অমান্য করায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ তার কাগজপত্র দেখতে চান। কথাবার্তার একপর্যায়ে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের গাড়িতে নিজে আগুন লাগান। যাই হোক, ওই চালককে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে দুপক্ষের সব মিষ্টি মিষ্টি কথা আসে মিডিয়ায়। পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।
এদিকে নিজের মোটরসাইকেলে আগুন ধরানো ‘পাঠাও’র সেই চালক শওকত আলীকে মোটরসাইকেল উপহার দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক জিএস গোলাম রাব্বানী। ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে শওকত আলীর বাসায় গিয়ে বাজাজ-১২৫ সিসির ডিসকভার মোটরসাইকেলটি উপহার হিসেবে সেই চালকের হাতে তুলে দেন। রাব্বানী বলেন, ‘শওকত আলীর বাইক পোড়ানোর ভিডিওটা দেখে নিজের কাছে খুব খারাপ লাগায় বাইকটি উপহার দিয়েছি।’
রাব্বানীসহ অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় মতামত দিয়েছেন যে, করোনাকালীন দেশের অনেক মানুষ অসহায় জীবনযাপন করছেন। পরিবারের হাল ধরতে অনেকে অ্যাপভিত্তিক মোটরবাইক চালানোর কাজ করেন। একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেলে, কতটা অসহায়ত্ব তাকে গ্রাস করলে ক্ষোভে-দুঃখে উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন, মোটরসাইকেলটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়, মানবিক হৃদয় দিয়ে সেটা সবাইকে অনুধাবন করা উচিত। এই মহামারির মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও মানবিক দিক বিবেচনা করে কাজ করা দরকার।
২৯ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে খবর বেরিয়েছে, প্রতিদিন রাজধানীতে বিভিন্ন বাস কোম্পানি, ব্যক্তি, সংগঠন ও সমিতির নামে টার্মিনাল এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্টপেজ থেকে মোটা অংকের টাকা উঠানো হচ্ছে। গণপরিবহনের মধ্যে শুধু বাস থেকেই ওঠে অন্তত ৫০ লাখ টাকা চাঁদা। সেই হিসাবে মাসে এই অংক দাঁড়ায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা। পরিবহন সেক্টরে এটা জিপি বা চাঁদা হিসেবে পরিচিত। কেবল বাস থেকেই চাঁদা উঠছে, তা নয়। মোটা অংকের চাঁদা ওঠানো হয় ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লেগুনা, টেম্পোসহ অন্যান্য যানবাহন থেকেও।
এ ধরনের চাঁদা আদায় না করতে ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। এরপরও বন্ধ হয়নি চাঁদাবাজি।
কীভাবে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে এবং জনগণ ঢাকার যানজট থেকে রক্ষা পাবে সে বিষয়ে কোনো আশার আলো দেখছি না। কেউ বলছেন, শহরে মানসম্মত এসি/নন-এসি বাসের ব্যবস্থা করা। ঢাকায় রাস্তা কম কিন্তু প্রতিদিন প্রাইভেটকার বাড়ছে। না বাড়ার বিকল্প হচ্ছে পায়ে হাঁটা, নয়তো পাবলিক বাসে চড়া। কিন্তু এ শহর তার কোনোটারই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। ফলে মানুষ অনেক সময় বাধ্য হয়ে প্রাইভেটকার কিনছে।
অনেকের মতো, সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়াটাও এর প্রধান কারণ। যমুনা সেতু হওয়ার পর ঢাকার জনসংখ্যা ব্যাপক বেড়ে যায়, সামনে পদ্মা সেতু হলে পরিস্থিতি কী হবে কেউ জানে না। পূর্বাচল নামে একটি শহর বানাতে সরকার দুই যুগ পার করে দিয়েছে কিন্তু সেখানে জনবসতি করার কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এখন ভালো চাকরির আশায়, ভালো পড়াশোনার আশায়, চিকিৎসার আশায়- সবাই ছুটে আসছে রাজধানীতে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি জেলায় জেলায়।
ঢাকার যানজট নিয়ে ৯ জুলাই ২০১৯ আমি ফেসবুকে কিছু মতামত রেখেছিলাম। আমার মনে হচ্ছে সেসব এখনো প্রযোজ্য। তখন রাজধানীর কয়েকটি রাস্তায় রিকশা নিষিদ্ধ করার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলাম, ‘আমি চাই ঢাকা সিটির প্রধান সড়কগুলো হবে রিকশামুক্ত, ফুটপাত হকারমুক্ত। শহরে চলবে অত্যাধুনিক এসি বাস, ব্যক্তিগত গাড়িওয়ালারা দেবেন চারগুণ ট্যাক্স। অতিরিক্ত গাড়ির জন্য অতিরিক্ত ট্যাক্স।
ইন্টারসিটি বা আশপাশের এলাকার সব গাড়ি সিটি করপোরেশন এলাকায় ঢুকতে পারবে না। অতিপ্রয়োজনীয়গুলো ঢুকবে। শহরের সব লক্কর-ঝক্কর যানবাহন শহর থেকে তাড়ানো নয় শুধু, দেশকে জঞ্জালমুক্ত করতে ধ্বংস করতে হবে। পুরোনো গাড়ি নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট নতুন নীতিমালা করতে হবে।
শহরের নামিদামি প্রত্যেক স্কুলের থাকতে হবে নিজস্ব পরিবহন। তাদের স্কুলে বাচ্চাদের আনা-নেওয়ায় জন্য শুধু গাড়ি, সময় বা অর্থের অপচয় নয়, অভিভাবকের জীবন এখন দুর্বিষহ। পৃথিবীর কোনো শহরে সন্তানের পড়াশোনার পেছনে অভিভাবককে এত অর্থ এবং সময় ব্যয় করতে হচ্ছে না।
শহরে সব শ্রেণির লোকের প্রয়োজন। ট্যাক্স দিলে বসবাসের অধিকারও আছে সবার। তার মানে এই নয় যে শুধু রিকশাওয়ালা এবং ফেরিওয়ালার কর্মসংস্থানের কথা বলে আপনি অন্যদের কর্মসংস্থানের বারোটা বাজাবেন। এদের নিয়ে ভোটের খেলার রাজনীতি, চাঁদাবাজি অনেক হয়েছে। এসব ছদ্মবেশী জনদরদি সাজার দিন এখন শেষ। চোখ খুলে দুনিয়া দেখুন, প্লিজ। আসুন, সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। দু-চারদিন কষ্টের পর সবাই সুফল পাবো আশা করি। আশা করতে দোষ কী!
আর হ্যাঁ আমার ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। আমি পাবলিক বাসে চড়তে চাই। ফুটপাতে হাঁটতে চাই।’
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]
এইচআর/এএসএম