ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

দাদাগিরির পরিণতিতে ব্রিক্স’র উত্থান

মোস্তফা হোসেইন | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১

জন পার্কিন্স এর ‘কনফেসনস অব অ্যান ইকোনমিক হিটম্যান’ বইয়ের বাংলা ভার্সন পড়েছিলাম কয়েক বছর আগে। দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক ফরহাদ মাহমুদ। অফিসে যাওয়ার পথে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বলেছিলেন, জন পার্কিন্স যা বলেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা শতভাগ মিলে যায়। ওই বইটির বাংলায় কি নাম দেওয়া হয়েছিলো ভুলে গিয়েছি। পড়ার সময় মনে হয়েছিলো,শক্তি-দাপট আর যত খুনের ভয়ই দেখানো হোক না কেন, সত্য চাপা থাকে না বেশিদিন। ইচ্ছা করলেও বেশিদিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা শক্তির দাপটে ক্ষতিগ্রস্তরাও একসময় না একসময় মেরুদণ্ড সোজা করতে চেষ্টা করে। সম্ভব হলে রুখেও দাঁড়ায়।

কথাগুলো মনে আসছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ব্রিক্স এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির সংবাদ দেখার পর। এটা কি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা নাকি রুখে দাঁড়ানোর উদ্যোগ? এমন প্রশ্ন কিন্তু আসতেই পারে। যাই হোক না কেন বাংলাদেশ ব্রিক্স এর সদস্য হতে পেরেছে, এখন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা বলা হলে হতেও পারে। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক পদক্ষেপ এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। যদিও ইতোমধ্যে ব্রিক্স-কে মানুষ বিশ্বব্যাংকের পাল্টা উন্নয়নব্যাংক হিসেবেই মনে করছেন। আর উদ্যোক্তা দেশগুলোর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে এবং ভূরাজনীতিতে তাদের অবস্থান ও লক্ষ্য পর্যবেক্ষণ করলে তার সত্যতা পাওয়া যায়।

জন পর্কিন্স এর বই পড়ে ভাবছিলাম, বাংলাদেশকে গরিব পেয়ে বিশ্বব্যাংক যে দাদাগিরি ফলাচ্ছে, সেই অবস্থা থেকে বাংলাদেশ কি পরিত্রাণ পাবে না? কোনো পথই কি পাওয়া যাবে না? নেতিবাচক ভাবনাটা বেড়ে গিয়েছিলো পদ্মাসেতু ঋণ দেওয়ার প্রাক্কালে যখন দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে বিশ্বব্যাংক ঋণদান স্থগিত করে দেয়। খুব বেশি মনে হচ্ছিলো বিশ্বব্যাংক এর মতো আরও কিছু উন্নয়ন সহায়ক ব্যাংক থাকা জরুরি। যদিও এর আগেই ব্রিক্স প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

পদ্মাসেতুতে দাদাগিরি করার সময় খুব খেয়াল করতাম আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদ কিংবা বিশ্লেষকরা কি মূল্যায়ন করেন। বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমও বিশ্বব্যাংকের সুরে সুর তুলেছিলো। স্বাভাবিক কারণেই মন ভেঙ্গে যাওয়ার কথা। কিন্তু যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন, যখন বললেন, পদ্মাসেতু হবে বাংলাদেশের নিজস্ব টাকায়, তখন বিস্ময় লেগেছিলো। বিস্ময় সৃষ্টির পেছনেও সেই পার্কিন্স এর বইয়ের প্রসঙ্গই এসেছিলো।

হুবহু উদ্ধৃত করতে পারছি না তবে সেখানে জেনেছিলাম, বিশ্বমোড়লরা খুনের ঘটনা ঘটাতেও পিছপা হয়নি। বৈশ্বিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। একইসঙ্গে ঋণের দীর্ঘস্থায়ী দেয়াল তৈরির বিষয়টিতো আছেই। কিন্তু বাংলাদেশের বলিষ্ট পদক্ষেপ এবং বিশ্বব্যাংককে প্রত্যাখ্যানই শুধু নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বব্যাংককে ভুল প্রমাণেও সক্ষম হওয়ার পর বুকে বল বেড়ে যায় সবার।

এখন ব্রিক্স এর সদস্য হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর মনে হচ্ছে- বাংলাদেশের আরেকটা বড় অর্জন এটা। অন্তত বিশ্ব বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের অভিভাবকরা বুঝতে পারছে, গরিব ভেবে বাংলাদেশকে আন্ডার এস্টিমেট করার পরিণতিটা সর্বোতভাবে তাদের পক্ষে যায়নি। বাংলাদেশও যে মেরুদণ্ড সোজা করার চেষ্টা করতে পারে, সেটা তাদের বোধ হওয়ার কথা।

বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের দাদাগিরির খড়গের নিচে পড়ে থাকলে বাংলাদেশ লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। আর তাদের ওপর নির্ভরশীল হতে গেলে স্বাধীন স্বত্বাও আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। বাংলাদেশকে আত্মসন্মান রক্ষা করেই লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সেই কারণেই ব্রিক্স এর সদস্য হওয়া, উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে তাকে পাশে পাওয়ার প্রয়োজন আছে।

ব্রিক্স এর কয়েক বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে তাদের সক্ষমতার বিষয়টি ইতিবাচক বলেই মনে হয়। ইতোমধ্যে তারা সদস্য দেশগুলোর ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো এবং নগর উন্নয়ন সংক্রান্ত ৮০টি বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দাদাগিরি ফলানোর সুযোগ এখনও তাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। অনুমান করা যায়,‘কনফেসনস অব অ্যান ইকোনমিক হিটম্যান’ বইয়ে উদৃতি অনুযায়ী ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শর্ত কিংবা অর্থনৈতিক প্রভুত্ব কায়েমের মতো কোনো ভূমিকা তারা পালন করবে না।

এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ব্রিক্স এর উদ্যোক্তা দেশগুলো রাজনৈতিক প্রভুত্ববাদের বিষয়টিকে পাশে রেখেই এগিয়ে এসেছে। কারণ উদ্যোক্তদের মধ্যে ভারত ও চীনের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য খেয়াল করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। রাজনৈতিক দূরত্ব থাকার পরও দেশ দুটি এক টেবিলে বসা নিশ্চিত করেছে। সেখানে পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন চিন্তাই নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। সুতরাং রাজনীতি এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে না বলেই ধারণা করা যায়। উদ্যোক্তা দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে দেখা যায়, উন্নয়ন সহযোগিতা। যদিও রাজনীতি একবারেই থাকবে না এটা মনে করা যায় না, কিন্তু তারা যে বিশ্বব্যাংকের মতো মোড়লগিরি ফলানোর চেষ্টা করবে না তা এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রমে জনক্ষতির শর্তগুলো অবশ্যই ব্রিক্স এর মাথায় আছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির অনুসরণে নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ পরিচালনা করলেও জনগণকে চুষে নেয়ার নীতিমালা যেন গ্রহণ না করে সেটুকু আশাবাদ করা অমূলক নয়। বিশ্বব্যাংক যেমন আমেরিকার বণিকশ্রেণির ছায়া বাড়াতে তৎপর তেমন কিছু কি তারাও করবে? যেহেতু দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের এমন অপচেষ্টার শিকার, তাই তারা ওই পথ মাড়াবে না এটাও মনে করা যায়।

বাংলাদেশ উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করেছে-বিশ্বব্যাংকের ক্ষতিকর শর্তগুলো কিভাবে যাত্রাপথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ দেখেছে, বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে- গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, সরকারি ব্যয় সংকোচন করা, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতগুলো থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয়ার শর্ত । নিন্ম আয়ের দেশ বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য তারা শ্রমিকের পারিশ্রমিক সংকোচনের প্রস্তাব করে, জনসেবা খাতগুলোকেও বেসরকারিকরণে তাদের আগ্রহ বেশি থাকে।

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় এসব শর্ত বড় ধরনের বাধা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এতে করে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি ছাড়া কমার কোনো কারণ নেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা থাকবে, ব্রিক্স হয়তো জনহিতকর উদার চিন্তাভাবনাকে ধারণ করেই বিশ্বব্যাংকের দাদাগিরি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। আর তেমন হলে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান দেশগুলোর পথ প্রশস্ত হবে। এবং বাংলাদেশের উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার যে স্বপ্ন লালন করছে সেদিকেও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

লেখক : সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন