ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আপ-ডাউন ইউনিভার্সিটি: উচ্চশিক্ষায় নিম্নগতি

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ১০:০৬ এএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

বিনা ভোটে নেতা নির্বাচিত হওয়া অনেকটা গাসহা হয়ে গেছে। বিনা পরীক্ষায় পাসও আর তেমন ঘটনার পর্যায়ে নেই। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা পরীক্ষায় ৩৫ জনকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ভর্তি করা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তামাদি হয়ে গেছে সেই কবেই। উচ্চশিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-উপাচার্যরা একের পর এক নৈতিকতা বা যোগ্যতার মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে সেই সমালোচনাকে মামুলি করে দিয়েছেন। আমাদের উচ্চশিক্ষার শিক্ষার পাঠ-পঠনের দশা আন্তর্জাতিক কোনো র‌্যাংকিংয়ে কেন আসছে না- এ নিয়ে আলোচনাও অবান্তর হয়ে গেছে।

পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে মানুষের কষ্টার্জিত করের টাকায়। শিক্ষা প্রদানের আর্থিক দায়িত্ব সরকারের। আর পরিচালনার দায়িত্বে শিক্ষক-শিক্ষাবিদরা। ছাত্ররাজনীতির সহিংস রূপের পাশাপাশি শিক্ষক রাজনীতির কদর্য চেহারাও বিকশিত। ক’দিন এই শ্রেণির শিক্ষকদের ধুয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

ছাত্রনেতাদের কথা মতো চলা, দলের কর্মীর মতো নানা রং-বর্ণে ব্যবহৃত শিক্ষকদের তিনি দায়ী করেছেন শিক্ষাঙ্গন কলুষিত হওয়ার কারণ হিসেবে। শিক্ষাগুরুদের কারো সাহস হয়নি তার কথার প্রতিবাদ বা দ্বিমত করার। পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি, ছাত্রনেতাদের উন্নয়ন কাজের জন্য অর্থ দেওয়ার মতো কাজের বিরোধিতা প্রথমেই আসা উচিৎ ছিল শিক্ষকমহল থেকে। কিন্তু তা আসেনি। এটাই বাস্তবতা।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র ভর্তি এবং শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায় একইরকম। শিক্ষক নিজে উঁচু মানের হবেন, ছাত্রছাত্রীর মধ্যে উঁচু মানের জ্ঞান বিতরণ করবেন-এমনটাই তো স্বাভাবিক আশা। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিনে দিনে যে দশায় এসে ঠেকেছে-ভালোমন্দ বিচারের পর্ব আর তেমন অবশিষ্ট নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরো করুণ। হাতে গোনা দুয়েকটি বেসরকারি বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা বলার অবস্থা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত র‌্যাংকিং প্রতিষ্ঠান টাইমস হাইয়ার এডুকেশনেও পাঠদান, গবেষণা, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম ও জ্ঞানের স্থানান্তরের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ওই র‌্যাংকিংয়ে, পাঠদান ও শিক্ষণের পরিবেশ, গবেষণা ভলিউম, আয় ও সুনাম, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম ও উৎপন্ন জ্ঞানের সূচকে কী করুণ দৈন্যদশা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাংকিংয়ে প্রথম ইনডিকেটর হলো রেপুটেশন, যা বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে যাচাই করা হয়ে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রেপুটেশন কোন পর্যায়ে। অথচ সরকার থেকে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রতিনিয়ত দিকনির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এরইমধ্যে শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প দিয়েছেন। ফলাফল কী?

দেশে প্রায় অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই। যার অধীনে রয়েছে অসংখ্য কলেজ। পাবলিক, প্রাইভেট মিলিয়ে বছর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী বাড়ছে। সাথে পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষিত বেকার বাড়ছে কোনো অনুপাত ছাড়াই। হণ্যে হয়ে চাকরির বাজারে ঘুরছে তারা। এভাবে বেকার তৈরির দায় কে নেবে? উচ্চশিক্ষায় দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসির তথ্য মতে, দেশের ২৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কারও কারও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। কেউ কেউ আদালতের স্থগিতাদেশে পরিচালিত।

কেউ কেউ আবার অনুমোদিত শিক্ষা প্রোগ্রামের বাইরেও কিছু প্রোগ্রাম চালাচ্ছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ক্যাম্পাস অনুমোদন ছাড়াই আছে। ইউজিসি এসব তথ্য দিয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। দেশে চলতে থাকা উচ্চশিক্ষাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিম্নমান নিয়ে কথাবার্তা থাকলেও গা মাখতে চান না সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনোটির নামে মানুষকে তুষ্ট করার এন্তার চেষ্টা।

নামের ধার-ভারে অনেকে ঝোঁকে এগুলোতে। কামের চেয়ে নামের আকর্ষণে তাড়িত হয়ে পরে বোবা বনে যেতে হয়। স্বজনদের কাছেও বলতে পারেন না কষ্টের কথা। আপ-ডাউন ছাড়া দেশে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমসহ প্রায় সবদিকের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি। এদিক, সেদিক, অন্যদিক কোনো দিকই আর বাদ নেই।

আবার রয়েছে দুইদিক মিলানো নামও। নর্থ সাউথ আছে অনেকদিন থেকেই। পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিও রয়েছে। আর দক্ষিণ-পূর্ব মিলিয়ে সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি। নর্দার্ন, সাউদার্ন, ইস্টার্ন ইত্যাদির বাজারও মন্দ নয়। এখন পর্যন্ত মোটা দাগে বাকি রয়েছে উপর-নিচ বা আপ ডাউন ইউনিভার্সিটি। দেশ-মহাদেশ এমনকি বিশ্বও টেনে আনা হয়েছে।

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ- নামটি শুনে বাংলাদেশ কি কোনো ফেডারেল রাষ্ট্রের স্টেট বা অঙ্গরাজ্য-এমন প্রশ্ন করে পাত্তা পাবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এরকম নামের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি, ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটি, নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির মতো কিছু করে দুধের স্বাদ আমরা ঘোলে মিটাচ্ছি।

চার-পাঁচটি বিভাগ বা অনুষদ ও দুই-আড়াই হাজার ছাত্রছাত্রী নিয়ে স্টেট শব্দ লাগিয়ে ছুটে চলা। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি নামের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। শুধু কি দেশ? বিশ্ববিদ্যালয় আছে উপমহাদেশ, মহাদেশ, আন্তদেশ, এমনকি আন্তমহাদেশের নামেও। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি নামকরনে বাধা আসেনি। রাজা-রানীর নামে ব্রিটিশ কালচারে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর ঘটনাও রয়েছে। রানীর নামে রয়েছে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, রাজকীয় বিশ্ববিদ্যালয় (রয়্যাল ইউনিভার্সিটি), রানীর বিশ্ববিদ্যালয় (কুইন্স ইউনিভার্সিটি)।

দেশের বিভিন্ন এলাকার নামকরণ নিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যের কিছু বিষয় রয়েছে। কোনো কোনোটিতে রয়েছে মিথ, কিচ্ছা-কাহিনীও। হোক না তথ্য-প্রমাণহীন, গোজামিল বা মনগড়া। তারপরওতো যুক্তি বা জবাবদিহিতার পর্ব রয়েছে। কোনো কোনোটি শুনতেও ভালো লাগে। আবার এ নিয়ে রসিকতাও আনন্দময়। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণে যথার্থতা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামকরণে বাংলা নেই বললেই চলে। ইংরেজিরও তো অর্থ-সৌন্দর্য আছে।

নামকরণের আসলে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম বা ব্যাকরণ নেই। অন্ধ মেয়ের নাম সুনেত্রা রাখা যায়। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখতে দোষ নেই। রং, ধরন, গঠন সব কিছুতে কুৎসিত হওয়ার পরও সুন্দর আলী নাম রাখতে বাধা দেয়ার কোনো নিয়ম নেই। যে কারণে বাদশা, রাজা, প্রিন্স, সম্রাট, মার্শাল, বিউটি, নন্দিনী, ডায়নাদের কিলবিল ঠেকবে না কখনো। তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও?

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম