শেখ হাসিনা : দৃঢ়সংকল্প নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি
সাজ্জাদুর সিরাজ নিবিড়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার তরী কবিতার মূল ভাব বিশ্লেষণ করলে বোধগম্য হয় যে মহাকালে স্থান পায় প্রতিটি মানুষের কর্ম। কর্ম’ই মানুষের পরিচয়, কর্ম দ্বারাই একজন মানুষ বেঁচে থাকে সহস্র বছর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্ম ব্রত এবং হিমায়লয় কঠিন দৃঢ়তা তাঁকে স্থান দিয়েছে মহাকালের অনন্ত যাত্রায়।
একবার চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন ২০০৫ সালের বাংলাদেশ এবং ২০২১ সালের বাংলাদেশ! উন্নয়নের যে ধারা এই বাংলাদেশে এখন দৃশ্যমান, এই ধারা কেবলই শেখ হাসিনার অবদান। হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়িকে যেই জহুরী উন্নয়নের তীর্থস্থান হিসেবে রূপান্তরিত করেছে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ তনয়া শেখ হাসিনা। আজ ২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সবুজে ঘেরা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা (বঙ্গবন্ধুর প্রথম সন্তান মারা যায়)। শৈশব থেকেই তিনি দেখেছেন বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য বাবার সংগ্রাম, বাবার কারাভোগের সময় মায়ের সংকল্প, স্পৃহা এবং দৃঢ়তা। জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে ধারণ করেছেন বাবা-মায়ের গুণ ভাণ্ডার। গ্রামের সরল তরুণী থেকে হয়ে উঠেছেন বিশ্ব নন্দিত সরকার প্রধান।
সুযোগ্য সন্তানের যথার্থ সমার্থক শেখ হাসিনা। তেইশ বছর দ্বিধাহীন সংগ্রাম, সহস্র যন্ত্রণা ও নিপীড়ন সহ্য করে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার। ত্রিশ লক্ষ শহিদ এবং দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিল লাল-সবুজের পতাকার বাংলাদেশ। পাকিস্তানী শাসকেরা এবং তাদের দোসররা মিলে সুজলা-সুফলা বাংলাকে বানিয়েছিল মৃত্যুপুরী।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের মত ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়েছিল বাংলার মাটিতে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা এবং খাদ্য গুদাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ ধ্বংস করে সমগ্র যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রস্তর যুগের মত দুর্গম করেছিল হানাদার বাহিনী। সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন সোনার বাংলা গড়ে তোলার। সোনার বাংলা গড়ার জন্য সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এ’যেন সুদীর্ঘ সোনার বাংলা উপন্যাস লিখতে যেয়ে লেখকের অকাল মৃত্যু। তবে থেমে থাকেনি বাংলার অগ্রযাত্রার উপন্যাস লেখার কাজ। বাবার সহজাত গুণাবলি ধারণ করে বাংলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের উপন্যাস লিখতে বসেন শেখ হসিনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞে শেখ হাসিনা বাবা-মা, ভাই, ভাইয়ের বউ, চাচা-ফুপা সহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হারান। শোকে মুহ্যমান শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনা বাবা-মাকে শেষ দেখাটা পর্যন্ত দেখতে পারে নি। এই শোক যেন শেখ হাসিনার শক্তিতে রূপান্তরিত করেন। ছয় বছর প্রবাসে বন্দী জীবন কাটিয়ে বাবার অসমাপ্ত সোনার বাংলার স্বপ্ন পূরণ করতে এবং বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে বাংলার মাটিতে পা রাখেন শেখ হাসিনা।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেন সমগ্র বাংলার মানুষকে এবং নেতৃত্ব দেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় বসেই বাংলাদেশের সংবিধানের কলঙ্ক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেন। শেখ হাসিনার প্রথম সরকার ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি চুক্তি সম্পাদন করেন, অশান্ত পার্বত্য অঞ্চলকে শান্ত করতে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেন, উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক দ্বার বঙ্গবন্ধু সেতু চালু করেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী (দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের জন্য শান্তি নিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প) সূচনা করেন। এরপরে আসে ২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন। সম্প্রীতির বাংলাদেশে শেকড় গড়ে মৌলবাদ এবং জঙ্গিবাদ।
সকল প্রতিবন্ধকতা সাহসের সাথে মোকাবিলা করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার পরিচালনার চেয়ারে বসেন শেখ হাসিন। এর পরেই দ্রুত বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো, নাগরিক সুবিধা। বর্তমানে বাংলাদেশের ৯৯.৫% মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করছে। শিক্ষিত নাগরিকের হার ৭৪% এর উপরে। মাথাপিছু আয় ২,২২৭ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৪১ তম অর্থনীতির দেশ। এইচএসবিসি এর গবেষণা বলছে, ২০৩১ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫ তম অর্থনীতির দেশ। বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। শিশু মৃত্যু হার এবং মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসে বাংলাদেশ বিশ্বে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। এমনকি করোনা মহামারীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করেছে তা ঈর্ষান্বতি করেছে বিশ্ব নেতাদের। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল মাত্র ২০.৫ শতাংশ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যেসকল দেশ আমাদের কটাক্ষ করেছে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে আজ সেই সকল দেশ আমাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এবং সেই দেশগুলো আমাদের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে চাইছে।
অবকাঠামোখাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন যেন রূপকথাকে হার মানায়। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী টানেল আজ কল্পনা নয় বাস্তব। গ্রামীণ বাংলার মেঠো পথে আজ কংক্রিটের ছোঁয়া লেগেছে। শহরের সকল সুবিধা ধীরে ধীরে পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামে। ভারত-মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা জয় শেখ হাসিনার বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতির সুফল। শেখ হাসিনার জন্য লাল-সবুজের পতাকা আজ মহাকাশের অবস্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু- ১ স্যাটালাইটের মাধ্যমে। বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে মানানসই দক্ষ শ্রম শক্তি গড়তে দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে ১২ টি। সমুদ্র সম্পদ গবেষণার জন্য স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, মহাকাশ গবেষণার জন্য স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন ২০০৮ সালের নির্বাচন ইশতেহারে প্রকাশিত হয়েছিল তা আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষে যাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরী হয় সেই জন্য দেশ জুড়ে স্থাপন করা হচ্ছে ডিজিটাল এবং হাইটেক পার্ক। সরকারের কৃষি গবেষণায় বরাদ্দের ফলে অবিষ্কার হচ্ছে উন্নত বীজ, সেই সাথে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনার সুদক্ষতায় বাংলাদেশ আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে চীন তার বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশকে কাছে চায়। আবার মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের কোয়াড-এ বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত হতে অহ্বান করা হয়। শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতার ভিত্তিতে সুনিপুণ ভাবে সকল পরাশক্তির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। পূর্বে বিশ্ব ব্যাংকের অনুদানে চলা বাংলাদেশ আজ অন্য দেশকে ঋণ দিচ্ছে।
বাংলাদেশের যত উন্নয়ন তা শেখ হাসিনার অবদান। শেখ হাসিনা তাঁর পিতার মত অন্তর দিয়ে এ দেশের মানুষকে ভালবাসে তাই যে কোনে অর্জন শেখ হাসিনা বাংলার মানুষকে উৎসর্গ করেন। শেখ হাসিনার অধীনেই বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
আজ শেখ হাসিনার জন্মদিন। মহীয়সী এই সরকার প্রধানের জন্মদিনে, তাঁর সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করি। দেশ-বিদেশের সকল ষড়যন্ত্র শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নে পাদপৃষ্ঠ হবে বলে বিশ্বাস করি। শুভ জন্মদিন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনার হাত ধরেই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে থাকবে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা।
লেখক : অফিসার (সুপারিশ প্রাপ্ত), জনতা ব্যাংক লিমিটেড।
এইচআর/জেআইএম