আবাসিক হল খুলে দিন তারপর পরীক্ষা নিন
প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী
মহামারি কোভিডের কারণে সারা বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও তছনছ হয়ে গেছে। দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর সরকারি সিদ্ধান্তে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে দেশের মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মান্য করার কথা বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু দেশের বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন।
দেশের সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোন সু-খবর নেই। কিন্তু দেশের ছোট-বড় প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিকভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা জোরালো ভাবে বলা হলেও তা যে পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। পরীক্ষার হলে হয়তো শিক্ষকদের চাপে শিক্ষার্থীরা মাস্ক পরতে বাধ্য হচ্ছে কিন্তু কক্ষের বাইরে এসেই তারা মাস্ক খুলে পকেটে রাখছে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে।
শারীরিক দূরত্ব প্রতিপালন করার কোন প্রকার আগ্রহ তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের এমন দায়িত্বহীন আচরণ করোনা ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে দেশের প্রায় সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিকভাবে পরীক্ষা চলমান থাকলেও আবাসিক হলগুলো এখনো বন্ধ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী স্থানীয় মেস মালিকের বিভিন্ন অন্যায় ও অন্যায্য দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে মেসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। মেস মালিকের বিভিন্ন আবদার ও অন্যায় শর্ত মেনে নিয়ে হলেও শিক্ষাজীবন দ্রুত শেষ করার জন্য তারা অত্যন্ত মানবেতরভাবে একেকটি কক্ষে গাদাগাদি করে বসবাস করতে অনেকটা বাধ্য হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দু'জনের কক্ষে চারজন, আবার চারজনের কক্ষে ৬-৭ জন অবস্থান করছে।
অভিযোগ রয়েছে ক্ষেত্র বিশেষে একজন ছাত্রের মেসে একমাস অবস্থান করার প্রয়োজন হলেও তিনমাসের কম সময়ের জন্য শিক্ষার্থীদের মেস ভাড়া দেয়া হচ্ছে না। এতে করে একদিকে তাদের যেমন শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে অধিকাংশ মেসের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শিক্ষার্থীদের স্বাস্ব্য ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তুলছে। আমরা জানি করোনায় গ্রামের মানুষের আয় রোজগার বহুগুনে কমে গেছে। ফলে তাদের সন্তানদের বাড়তি শিক্ষা ব্যয় অভিভাবকদের মাথা ব্যথার আরেকটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের আবাসিক হলগুলো খুলে দেয়া হলে অভিভাবকরা তাদের এই বাড়তি চাপ থেকে রক্ষা পেত।
অন্যদিকে যদি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের হলগুলো খুলে দেওয়া হতো তাহলে সেখানকার পরিবেশ নিঃসন্দেহে মেসের পরিবেশের চেয়ে অনেক উন্নত হতো। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা সহজ হতো। সামাজিক দূরত্ব মেনে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ছেলেমেয়েরা হলে বসবাস করতে পারত। কিন্তু হল সমূহ বন্ধ রেখে শারীরিকভাবে পরীক্ষা গ্রহণ কতটা যৌক্তিক? কতটা মানবিক? তা সচেতন অভিভাবকদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। শিক্ষক হিসেবে এ ভাবনা যে আমাকেও ভাবায়নি তা কিন্তু নয়।
তারপরও এটা ভেবে ভালো লাগে যে হল খুলে দিতে না পারলেও শিক্ষার্থীরা অন্তত দীর্ঘ সেশন জটের কবল থেকে রেহাই পাবে পরীক্ষা জট থেকে মুক্ত হবে। তবে এটা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে হলসমূহ বন্ধ রেখে শারীরিকভাবে পরীক্ষা গ্রহণ কোনভাবেই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যাশিত নয়। যদি হলসমূহ খুলে দেওয়া যেত তাহলে শিক্ষার্থীরা অন্তত স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তাদের হলে বসবাস করতে পারত।
হল বন্ধ রেখে যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের পরীক্ষা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা বেপরোয়াভাবে স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ করছে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। করোনা দেশ থেকে চলে গেছে বা করোনার ঝুঁকি কমে গেছে তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও আসেনি। এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা করোনার তৃতীয় ডেউ আসা নিয়ে বেশ শঙ্কিত। যা নাকি ডেল্টা ভেরিয়েন্টের চেয়ে অনেক ভয়ানক। আল্লাহ না করুন, যদি সেটা হয় তাহলে তা হবে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের
বিপর্যয়।
বলতে দ্বিধা নেই বিশেষজ্ঞ কমিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে যে সমস্ত শর্তের কথা বলেছিলেন তার অধিকাংশই বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে প্রতিপালন হচ্ছে না বা প্রতিপালন হতে দেখা যাচ্ছে না। গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা তুলনামূলক ভাবে ভালো। এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটকের সামনে অভিভাবকদের উপচে পরা ভীড় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। অভিভাবকদের এধরনের আচরণ কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি দ্রুত বন্ধ হওয়া উচিৎ।
দেশে এই মুহূর্তে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার নিম্মমুখী। তাই অনতিবিলম্বে হলসমূহ খুলে দিয়ে শারীরিক ভাবে ক্লাস এবং পরীক্ষা যত দ্রুত শুরু করা যাবে ততোই মঙ্গলজনক। সুখের কথা ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আবাসিক হলসমূহ খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মেডিকেল কলেজ সমূহের হোস্টেলও খুলে দেয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল খুলে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। একইসাথে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহও অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের আবাসিক হলসমূহ খুলে দিবে এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবে বলেই বিশ্বাস। তবে স্বাস্থ্যবিধি মান্য করার সাথে কোন প্রকার আপোস করা সমীচীন হবে না।
লেখক : অধ্যাপক, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম