ই-কমার্সের নামে ই-প্রতারণা!
যে কোনো ভালো সম্ভাবনাকে নিমেষেই ধ্বংস করে দিতে আমাদের জুড়ি নেই। ইন্টারনেটের দ্রুত বিস্তারে এখন আমরা সবাই জানি গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। ছাপা পত্রিকা বা ট্র্যাডিশনাল টেলিভিশনের জায়গা দখল করে নিচ্ছে অনলাইন বা ডিজিটাল নানা প্লাটফর্ম। ছাপা পত্রিকার মোহটা আমার এখনও কাটেনি। সব খবর জানা থাকে, তারপরও সকালে ঘুম ঘুম চোখে পত্রিকা হাতে না নিলে দিন শুরু হতে চায় না। কিন্তু আমি জানি, একদিন না একদিন সবকিছু পেপারলেস হয়ে যাবে।
অনলাইনেই যে ভবিষ্যৎ, সেটা আমরা অনেক দেরিতে বুঝেছি, কিন্তু আলমগীর হোসেন বুঝেছিলেন প্রায় দুই দশক আগে। তিনি যখন প্রথম বিডিনিউজ২৪ডটকম নিয়ে এলেন, তখন আড়ালে আবডালে আমরা অনেক হাসাহাসি করেছি- কার ঠেকা পড়েছে, কম্পিউটারে গিয়ে খবর পড়ার। এখন সবারই ঠেকা। সবার হাতে স্মার্ট ডিভাইস। খবর পেতে এখন আর কাউকে পত্রিকা পড়তে হয় না, টিভিও দেখতে হয় না। স্মার্ট ফোনে এক ক্লিকেই সব খবর পেয়ে যান সবাই।
গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ তাই অনলাইন আর ডিজিটাল মাধ্যমে। কিন্তু যখন আমরা বুঝতে পারলাম, অনলাইনেই ভবিষ্যৎ, তখন আমরাও আমাদের ভবিষ্যৎ গড়তে অনলাইনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। একই সঙ্গে ধ্বংস করে দিলাম অনলাইনের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সম্ভাবনাও। বাংলাদেশে এখন কটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে, সেটি তথ্য মন্ত্রণালয় তো নয়ই, সম্ভবত কেউই জানেন না। এখন আসলে ঘরে ঘরে অনলাইন, ঘরে ঘরে সাংবাদিক। স্বামী সম্পাদক, স্ত্রী প্রকাশক; ব্যস হয়ে গেলো একটি ডটকম, আর ধান্ধাবাজি বেশি। ফসল বুনলে কিছু আগাছা হবেই। কিন্তু আগাছা বেশি হয়ে গেলে ফসলের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায়।
অনলাইনের স্রোতে এত কচুরিপানা এসেছে, এখন স্রোত বন্ধ হওয়ার দশা। এই অনলাইনের জোয়ারে সত্যিকারের অনলাইন সাংবাদিকতা এখন হুমকির মুখে। ব্যাঙের ছাতার মতো ঘরে ঘরে গজিয়ে ওঠা এসব ভুঁইফোঁড় অনলাইনের ভিড়ে অনলাইন সাংবাদিকতার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পরে কখনো কখনো। অনলাইনের পর এলো ডিজিটাল প্লাটফর্ম। ব্যস, সবাই এখানেও ঝাঁপিয়ে পড়লো।
বাংলাদেশে এখন সরকার অনুমোদিত স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সংখ্যা গোটা চল্লিশেক। কিন্তু আইপিটিভি নামে অনলাইন টিভির সংখ্যাও আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। কোনো কোনো উপজেলায়ও গোটা বিশেক আইপিটিভি আছে। প্রায় সবার একটি করে ইউটিউব চ্যানেল আছে। হিট বাড়াতে তারা সাংবাদিকতার নামে যা খুশি করে। এসব ভুঁইফোঁড় অনলাইন, আইপিটিভি বা ইউটিউব চ্যানেলের দাপটে মূলধারার সাংবাদিকতাই এখন কোণঠাসা।
শুরুতে সরকার এ সমস্যায় নজর দেয়নি। এখন নজর দিয়েও সামলাতে পারছে না। কারণ অন্তর্জালের বিশাল জগতে হাজার হাজার অনলাইন, আইপিটিভি বা ইউটিউব চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করা সত্যি কঠিন। কিন্তু কঠিন হলেও সাংবাদিকতার স্বার্থে কঠোর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। একটা শৃঙ্খলা থাকতেই হবে। যাতে মূলধারার অনলাইনকে আলাদা করে চিনতে পারে মানুষ।
অনলাইনের সম্ভাবনাকে যেমন আমরা গলা টিপে হত্যা করেছি, এখন হত্যা করে বসছি ই-কমার্সকেও। অনলাইনের মতো ই-কমার্সও দারুণ এক সম্ভাবনার নাম। শুধু সম্ভাবনা নয়, ই-কমার্স এখন বাস্তবতা। বিশেষ করে করোনা যখন গোটা বিশ্বকে কাবু করে ফেলে, তখন ই-কমার্স পৌঁছে যায় ঘরে ঘরে। করোনার ঝুঁকি এড়াতে মানুষ যখন ঘরবন্দি, তখন ই-কমার্স মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়েছে তাদের নিত্যপণ্য।
যেহেতু ই-কমার্স ব্যবসার দোকান ভাড়া লাগে না, তাই তারা প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে কিছুটা কম দামেও পণ্য বিক্রি করতে পারেন। সব মিলিয়ে ই-কমার্স হতে পারতো আমাদের স্বস্তির জায়গা। কিন্তু সেই ই-কমার্সকে ধ্বংস করতে আমরা এখন উঠে পরে লেগেছি। ই-কমার্সের বিরুদ্ধে এখন অভিযোগের পাহাড়। বাংলাদেশে ই-কমার্সের বিস্তার হয়েছে রীতিমতো রকেট গতিতে।
প্রয়োজনই আসলে চাহিদার সৃষ্টি করে। কিন্তু বিস্তারের সাথে বেড়েছে অভিযোগও। এক পণ্য দেখিয়ে আরেক পণ্য গছিয়ে দেয়া, মান ঠিক না রাখা, সময়মতো ডেলিভারি না দেয়া ইত্যাদি অভিযোগ ছিল এন্তার। তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মামলা করে এর কিছু প্রতিবার পাওয়াও সম্ভব।
এমনিতে সরাসরি বাজারে গিয়ে নিজে দেখেও কিনলে পচা মাছ গছিয়ে দিতে পারে। ব্যবসায়ীদের এ নৈতিকতার সঙ্কট ই-কমার্স যুগের আগে থেকেই। তবে ই-কমার্স ব্যবসায় ধ্বংসের সাইক্লোন নিয়ে আসে ইভ্যালির সাইক্লোন অফার। এক ইভ্যালি বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসার যতটা ক্ষতি করেছে, আর কারও পক্ষে ততটা করা সম্ভব হবে না কখনো। ইভ্যালির হাওয়াই ‘সাফল্য’ দেখে একই ধরনের আরও অনেকগুলো ই-কমার্স সাইট গজিয়ে ওঠে।
ইভ্যালির ফাপা বেলুন ফুটে গেছে, ফুটে গেছে ই-অরেঞ্জও। সরকারের নজরদারিতে আছে ধামাকা, বুমবুম, সিরাজগঞ্জশপ, আলাদিনের প্রদীপ, কিউকম, আদিয়ান মার্ট, নেটডটকম, আলিশা মার্টএ। তবে সরকার অনেক দেরিতে নজর দিয়েছে। ইভ্যালি কিন্তু সবার চোখের সামনেই বেড়ে উঠেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, এমনকি জাতীয় ক্রিকেট দলেরও স্পন্সর হয়েছে তারা। মোটা টাকায় বড় বড় তারকাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানিয়েছে। কিন্তু এই পুরো টাকাটাই সাধারণ জনগণের। আজ যখন ইভ্যালির রাসেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ততক্ষণে তার দায় ছাড়িয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। ই-অরেঞ্জও সাধারণ জনগণের হাজার কোটি টাকা হাওয়া করে এখন মালিকরা জেল খাটছে।
মালিকদের জেলে নিলেই তো সমস্যার সমাধান হলো না। সাধারণ জনগণের টাকা ফেরত দেবে কে? এর আগে যুবক, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠান জনগণের টাকা মেরে দিয়েছে। সেই টাকাও জনগণ ফেরত পায়নি। ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জের টাকা কে ফেরত দেবে? যতদূর জানা যাচ্ছে, তাদের কাছেও টাকা নেই। তারাও টাকা স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে। সরকার এতদিন ব্যবস্থা নিলো না কেন? কেন দিনের পর দিন সবার চোখের সামনে এমন হাওয়াই ব্যবসা চলতে পারলো। সরকারের আইন কোথায়, নজরদারি কোথায়? তাই সরকারকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। এতদিন তারা ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জকে আটকালো না কেন?
মাথাব্যথার সমাধান মোটেই মাথা কেটে ফেলা নয়। এটা নিশ্চিত অনলাইন আর ডিজিটাল প্লাটফর্মেই গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ। তাই ভুয়া নিউজ পোর্টাল আর আইপিটিভি বন্ধ করে এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে হবে। তেমনি ই-কমার্সের সামনেও বিপুল সম্ভাবনা।
ই-কমার্স খাত ঘিড়ে গড়ে উঠেছে বিশাল বাজার আর সাপ্লাই চেইন। গড়ে উঠেছে হাজারো উদ্যোক্তা। কৃষকের সাথে ভোক্তার সরাসরি সংযোগ ঘটিয়েছে ই-কমার্স। তাই ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ বা এমন কয়েকটি হাওয়াই কোম্পানি দিয়ে ই-কমার্স খাতকে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। ই-কমার্স মানেই প্রতারণা এমনটি মনে করারও কোনো কারণ নেই।
ই-কমার্স সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এ খাতেও শৃঙ্খলা আনতে হবে। কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের যে বিশাল বাজার তাতে এখানেও আমাজন বা আলিবাবার মতো সফল ই-কমার্স সাইট বেড়ে ওঠা অসম্ভব নয়। সম্ভাবনাকে যেন আমরা ‘সম্ভব না’য় বদলে না দেই।
এইচআর/জেআইএম