সাক্ষরতার আলো জ্বলে উঠুক ঘরে ঘরে
ইমরান হুসাইন
শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড, যা উন্নয়নের পূর্বশর্ত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংরক্ষণের রক্ষাকবচ এবং উন্নয়ন কার্যক্রম সফল ও সচল করার মৌলিক উপাদান। কারণ শিক্ষা ব্যতীত উন্নয়ন কার্যক্রম গতিশীল রাখা সম্ভব নয়। শিক্ষা ব্যতীত একজন ব্যক্তি পরম্পরা ভাবে ধনী হলেও সে দুর্বল। তাই দেশের অধিকাংশ জনসংখ্যাকে নিরক্ষর রেখে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা কখনোই সফলতা লাভ করতে পারে না। এই সত্য উপলব্ধি থেকেই মানব সমাজে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শিক্ষারক্ষেত্রে অত্যাবশকীয় কর্মসূচি। বর্তমান বিশ্বের উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরাও বস্তুগত উন্নয়নের ওপর প্রাধান্য না দিয়ে মানবসম্পদে প্রাধান্য দিচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন না করে উন্নয়নের কথা চিন্তা করাও বোকামি বা অজ্ঞতার পরিচায়ক হিসেবে প্রকাশ পাবে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা জনসংখ্যা যখন মানবসম্পদে রূপ নেবে তখনই দেশ এগিয়ে যাবে।
আজ ৮ সেপ্টেম্বর,‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’ জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। দেশে দেশে নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষর করার উদ্দেশ্যে গণজোয়ার সৃষ্টির লক্ষ্যে পালিত হয় এই আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। গতবার ‘বহুভাষায় সাক্ষরতা, উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে আজকের এই দিনে পালিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস।
১৯৬৬ সাল থেকে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ১৯৬৫ সালে ইরানের তেহেরান শহরে ইউনেস্কোর আওভানে বিশ্বের ৮৯ দেশের শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাবিদ ও পরিকল্পনাবিদরা একত্র হয়ে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, শিক্ষাজীবন ও জীবিকা পরস্পরকে সাথে ঘনিষ্ঠ সাথে জড়িত। এবং বয়স্ক মানুষের ব্যাপল নিরক্ষরতা দেশের উন্নতির প্রধান অন্তরায়। এ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই প্রত বছর ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্বে সব মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধ জাগ্রত করা এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণে সমাজের সব মানুষের মধ্যে নতুন এক উদ্দীপনা সৃষ্টির লক্ষ্যেই আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসটির মহত্ব।
দিবসটি পালনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষকে তারা বলতে চায়, সাক্ষরতা একটি মানবীয় অধিকার এবং সর্বস্তরের শিক্ষার ভিত্তি। প্রতি বছর একটি বিশেষ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সে বছর সাক্ষরতা দিবস পালন করা হয়। সাক্ষরতা আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত মানবীয় অধিকার হিসেবে বিশ্বে গৃহীত হয়ে আসছে। এটি ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ও মানবীয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণযোগ্য। এমনকি শিক্ষার সুযোগের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে সাক্ষরতার ওপর। শুধু তাই নয়, সাক্ষরতা মৌলিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবেও কাজ করে। দারিদ্র্য হ্রাস, শিশু মৃত্যু রোধ, সুষম উন্নয়ন এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি বিকশিতকরণের ক্ষেত্রেও সাক্ষরতা প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হয়। মূল কথা সবার জন্য শিক্ষা। এ স্লোগান বাস্তবায়ন করতে সাক্ষরতাকে ভিত্তি হিসেবে মনে করার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
একটি মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা মানুষকে সাক্ষরতা ও দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করতে সহায়তা করে। সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মা-বাবা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে প্রেরণে উৎসাহিত হন, অব্যাহত শিক্ষায় নিজেকে প্রবেশ করতে উৎসাহ পান এবং উন্নয়নের দিকে দেশকে ধাবিত করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট ও সরকারকে চাপ প্রয়োগে সাহায্য করে থাকেন।
দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার সরকারি হিসাবে দেশে প্রতি বছরই বাড়ছে সাক্ষরতার হার। যদিও সেটা খুবই ধীরগতিতে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের চেয়ে এ হার আরও প্রায় ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও দেশে এখনও মোট জনসমষ্টির ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ নিরক্ষতার অন্ধকারে নিমজ্জিত রয়েছেন। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস সামনে রেখে সোমবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ২০১২ সালে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার ছিল ৬০.৭ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ৫৮.৮ শতাংশ, ২০১০ সালে ৫৮.৬ শতাংশ। এবং ২০০৯ সালে ছিল ৫৮.৪ শতাংশ। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সাক্ষরতার হার আমরা বাড়াতে সক্ষম মাত্র ৩ শতাংশ। এভাবে চললে, দেশটি পুরো নিরক্ষরতামুক্ত করতে একুশ শতক পার করতে হবে।ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে আমরা যখন স্বাধীনতা লাভ করি, তখন দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে সাক্ষরতার হার দাঁড়ায় ২৫.৯ শতাংশ। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে সেই হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৫.৩ শতাংশ ও ৪৭.৯ শতাংশ। ২০১০ সালে সাক্ষরতার জরিপে ৫৯.৮২ শতাংশে পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছিল। এর পাশাপাশি যদি আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে তাকাই দেখব, ভারতে সাক্ষরতার হার ৭৪.৪ শতাংশ, নেপালে ৬৬ শতাংশ, ভুটানে ৬৪.৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৯৮.১ শতাংশ, আমাদের পেছনে আছে পাকিস্তান ৫৫ শতাংশ ও আফগানিস্তান ২৪ শতাংশ। আমাদের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাক্ষরতার হার ৮৯ শতাংশ।
বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার বাড়াতে বা নিরক্ষরতা দূর করতে আমাদের কিছু নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে চলতে হবে। কেননা নিরক্ষরতা একটি ভয়াবহ সমস্যা। দেশের উন্নয়নের পথে এটি হুমকিস্বরুপ। এজন্য সাক্ষরতার হার বাড়াতে বা নিরক্ষরতা দুর করতে আমাদের কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।এজন্য সকল শিশু বা নাগরিকদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রত্যেক শিশুকে স্কুলে পাঠাতে হবে। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সরকারি ও বেসরকারীভাবে সাহায্য দিতে হবে। বয়স্কদের জন্য বয়স্ক শিক্ষা ব্যাবস্থা চালু করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে।
সাক্ষরতা হার বাড়িয়ে তুলতে সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোও এগিয়ে এসেছে। সরকার ২০০০ সালে সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি পালন করেন। তাছাড়া বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা, বয়স্কশিক্ষা কার্যক্রম চালু করেন।১৯৯৩ সাল থেকে সরকার খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি চালিয়ে আসছেন। এছাড়া মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছেন সরকার।
ইউনেস্কোর “Global Monitoring Rreport on Education for All(2014)" অনুযায়ী দক্ষিণ এবং পশ্চিম এশিয়ার সাক্ষরতার হার ৫৮.৬ শতাংশ, এবং আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলে ৫৯.৭, আরব অঞ্চলে৬২.৭ শতাংশ। এবং সবচেয়ে কম সাক্ষরতার হার সম্পন্ন দেশ হলো নাইজেরিয়া ও মালি। যাদের সাক্ষরতার হার ১৪.৪শতাংশ এবং ১৯শতাংশ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সদা পরিবর্তনশীল এবং বিভিন্নরুপ শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয়ে গঠিত।আমাদের দেশের শিক্ষাব্যাবস্থা মূলত তিন স্তর বিশিষ্ট। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিচালিত হয় মূলত ৫ বছর মেয়াদি। এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হয় ৫ বছর ও ২ বছর মেয়াদি। এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ বিশেষত উন্নয়নশীল দেশসমূহের ন্যায় বাংলাদেশ সরকারও মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন থেকে শুরু করে কর্মসূচি বাস্তবায়নে গ্রহণ করছে নানারকম পদক্ষেপ। দেশের দরিদ্র ও অনগ্রসর পরিবারের শিশু কিশোর ও বয়স্ক নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি চালু হয়েছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের আওতায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ব্যবস্থায় সারা দেশে বিস্তার লাভ করেছে সার্বিক সাক্ষরতার কর্মসূচি।
১৯৯১ সালে শতকরা ৩৫ শতাংশ বয়স্ক সাক্ষরতা নিয়ে বাংলাদেশে সংগঠিত আকারে সাক্ষরতা শুরু হয়। এবং ২০১৪ সালের Bureau of Staatistics(BBS)এর রিপোর্ট অনুয়ায়ী বাংলাদেশের এই সাক্ষরতার হার পুরুষদের জন্য ৬৫.৮২শতাংশ এবং নারীদের জন্য ৫৫.৭১শতাংশ। বাংলাদেশের এই সাক্ষরতার হার বাড়িয়ে তুলতে সকলকে অধিক সচেতন হতে হবে। তাদেরকে বোঝাতে হবে শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য। মানব সম্পদ উন্নয়নে অব্যাহত শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিকল্প নেই। এখন পর্যন্ত সামাজিক কর্মকাণ্ডের লক্ষ্যদল হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু শিক্ষিত মানুষ। বাংলাদেশের মানুষকে সাক্ষর করে তুলে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত না করা পর্যন্ত এদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের গুরুত্বটা আমাদের জন্য অনেক বেশি।
লেখক : শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
এইচআর/এমএস