তালেবান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে তো?
গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তালেবানের বিজয় এবং আমেরিকার পরাজয় ঘোষিত হলেও পুরো আফগানিস্থানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এখনও সম্পন্ন করতে পারেনি তালেবান। কাবুলের উত্তর-পূর্বের পানশির প্রদেশ দখলের জন্য মরিয়া চেষ্টা চালিয়েও সফল হওয়ার খবর এখন পর্যন্ত জানাতে পারেনি তালেবান। সেখানে নিয়ন্ত্রণ আছে তালেবানের বিপক্ষ গ্রুপের নেতা আহমেদ শাহ মাসুদের বাহিনীর। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের চেষ্টাও এখনও সফল পরিণতি পায়নি।
গত ৩ সেপ্টেম্বর বাদজুমা মন্ত্রিসভা ঘোষণার কথা থাকলেও তা করা সম্ভব হয়নি। মতানৈক্য না হওয়াতেই এই বিলম্ব বলে ধারণা করা হচ্ছে। আফগানিস্তানে বিভিন্ন আঞ্চলিক, নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক যে বিভাজন আছে তাতে সমন্বয় সাধন খুব সহজ কাজ নয়। ৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের মহাপরিচালক লে. জে. ফাইজ হামিদের কাবুল সফর এবং তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাতের খবরে অনেকেরই চোখ কান সজাগ হয়ে উঠেছে। তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানি এই গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা আছে।
তালেবান কাবুলে ফিরেছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে ও তাদের দেওয়া শর্ত মেনে। বাগদাদ থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর ইরাকে একটি শিয়া সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়েছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন হয়েছে বাগদাদে। আফগানিস্তানেও তালেবানের এমন একটি সরকার গঠন হতে পারে যেখানে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতৈক্য থাকবে। কিন্তু সেখানে অনেক ‘কিন্তু’ রয়েছে। আফগানে তালেবানকে সরকার গঠন করতে গেলে নিজের দেশ ও বহির্বিশ্ব সংশ্লিষ্ট নানা ইস্যুকে মাথায় রাখতে হবে।
তালেবান ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেছিল আফগান মুজাহিদিন সমর্থিত বোরহানউদ্দীন রাব্বানিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। অথচ এই মুজাহিদিনরাই সোভিয়েত বিতাড়নের মূল হোতা ছিল। তালেবানের ক্ষমতাগ্রহণ সহজ হয়েছিল কারণ মানুষ মুজাহিদিনদের কট্টরতা ও রাষ্ট্র পরিচালনার অদক্ষতা নিয়ে মানুষ বিরক্ত ছিল। তালেবান এসে দুর্নীতি দমন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারলেও তাদের শরীয়া আইন ছিল বাড়াবাড়ি পর্যায়ে। টেলিভিশন, সিনেমা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিল, নারীদের কঠোরতার ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
বর্তমানে তালেবানের মুখপাত্ররা মুখে বর্তমান সময়ে এসে পরিবর্তনের কথা বললেও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। ইতিমধ্যে সঙ্গীত নিষিদ্ধের কথা বলছে তালেবান। ভিন্নমত অবলম্বনকারী ও সাংবাদিকদের আত্মীয়ের উপরও আক্রোশ চালিয়েছে তালেবান। কোনো একটি রাষ্ট্র কাঠামো কীভাবে চলবে তার সাথে জনগণের সংস্কৃতির একটা প্রভাব রয়েছে। এই সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া যায় না। আফগান জনগণের উপর মার্কিন সংস্কৃতি ও বোরহানউদ্দীনের কঠোরতা চাপানো যায়নি। ফলে তালেবানের কঠোরতাও মানুষ মানবে না। আফগানিস্তানের অতীত ইতিহাস বলে জনগণ কঠোরতাকে মন থেকে গ্রহণ করেনি।
গত ২০ বছরে কাবুলে একটি শিক্ষিত, তরুণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি দাঁড় হয়েছে। এই তরুণদের মধ্যে রয়েছে তালেবান ভীতি, তারা জানে না তালেবান ক্ষমতায় এসে আসলে কি করতে যাচ্ছে। ফলে অনপকের মধ্যেই এ্কটা অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। আশরাফ ঘানি সরকারের পতন নিয়ে আফগানিস্তানে আফসোস করা মানুষের সংখ্যা কম। কারণ তারা একটা বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল, যেখানে জনগণের সমর্থন ছিল না। ফলে আশরাফ ঘানি সরকার, বোরহান উদ্দীন সরকার ও তালেবান সরকারের অতীত পতনের ইতিহাস থেকে তালেবানের শেখার অনেক কিছু আছে ।
আফগানিস্তানে তালেবান সরকার গঠন করলে সে সরকারকে পশ্চিমা বিশ্ব স্বীকৃতি দিবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়। মানবধিকার, শরীয়া আইন ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে তালেবানের প্রতিশ্রুত পরিবর্তনের দিকে নজর রাখছে তারা। তবে বর্তমান আফগান তরুণদের বড় একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। ফলে তালেবান চাইলেও কাবুলকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারবে না।
তালেবানের আন্তর্জাতিক মুখপাত্ররা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন নিজ দেশের বাইরে কোনো গোষ্ঠীকে সমর্থন না নিজেদের মাটি অন্য দেশের বিরুদ্ধে কাউকে ব্যবহার করতে দিবে না। আফগান নাগরিক ও বিশ্ববাসী সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দিকে চেয়ে আছে। তবে এরমধ্যই একজন তালেবান মুখপাত্র কাশ্মীরসহ পৃথিবীর সব জায়গায় নির্যাতনের শিকার মুসলমানদের পাশে থেকে তাদের পক্ষে লড়াইয়ের যে কথা বলেছেন তা থেকে মনে হয় তারা সমর্থন আদায়ের জন্য যেসব নরম কথা বলেছে, সেসব অনুসরণ না-ও করতে পারে।
ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কাছে। আফগানিস্তানে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে প্রচুর বিনিয়োগও দরকার। চীন বিনিয়োগের সুযোগ ও এর নিরাপত্তা চায়। এছাড়া ওয়াখান করিডোর হয়ে স্থলপথে আফগানিস্তানের মাটির উপর দিয়ে ইরান যাওয়ার উচ্চাভিলাস তো চীনের রয়েছে। এই পথে করিডোর তৈরি করতে পারলে চীনের আরব সাগর ও ভারত সাগরে আসতে পাকিস্তানের সিপিইসি করিডোরের উপর নির্ভরতাও কমবে। এছাড়া আদর্শে কট্টর সুন্নি ও সশস্ত্র তালেবান উইঘুর অসন্তোষকে উস্কে দিবে কিনা তাও বেইজিংয়ের চিন্তার বিষয় ছিল। তালেবান নেতা আব্দুল গনি বারাদারের নেতৃত্বে তালেবানের উচ্চ পর্যায়ের টিমের চীন সফরে বেইজিং এই নিশ্চয়তা সমূহ আদায় করেছে বলেই মনে হয়। পাকিস্তানের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আফগানিস্তানকে নিয়ে চীন যে স্বপ্ন দেখছে তাতে আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটাও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে ভূরাজনীতির মেরুকরণ সম্পন্ন হতে আরও সময় লাগবে।
কাবুলের সব কলকাঠিই যুক্তরাষ্ট্র সেনাপ্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে হাতছাড়া করেছে বলেও মনে হয় না। তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আল কায়েদা ও অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীর ঘাঁটি হিসাবে আফগানিস্তানকে ব্যবহৃত হতে দিবে না, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শান্তি আলোচনা অব্যাহত রাখবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেন, ' আফগানিস্তানে তাদের জাতি গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে'। তার মানে কাবুলের উপর একেবারের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিচ্ছে না হোয়াইট হাউস।
সফট পাওয়ার চর্চায় বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের জুড়ি নেই। ফলে ভবিষ্যতে তালেবান সরকারের উপর যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তালেবানকে জাতিসংঘ , মানবধিকার সংগঠন ও পশ্চিমা বিশ্বেও স্বীকৃতি পেতে গেলে প্রতিশ্রুতি সংস্কার করে দেখাতে হবে। এছাড়া গতমাসে উজবেকিস্তান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নিয়ে নতুন একটি কোয়াড গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। নিঃসন্দেহে এই ইস্যুতে তালেবানের সাথে একটা দেন দরবারে রয়েছে হোয়াইট হাউস।
কিন্তু ইতিমধ্যে একটি জঙ্গি সংগঠন কাবুল বিমানবন্দরে বিমান হামলা করেছে। এই ধরনের আরও হামলার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এটা স্পষ্ট কাবুলে এখনো জঙ্গি সংগঠনগুলো সক্রিয়। এখন প্রশ্ন এই জঙ্গি সংগঠনগুলো দমনের জন্য ক্ষমতা তালেবান বা আফগান সরকার রাখে কিনা! অথবা মার্কিন বা বহুরাষ্ট্রীয় বিদেশী সৈন্য বিশ বছর কাবুলে কি করল!
এখন পর্যন্ত আফগানিস্তান ইস্যুতে পাকিস্তান ও তুরস্কের একটা রহস্যময় ভূমিকা রয়েছে। লিবিয়া বা সোমালিয়ার মতো একচেটিয়া প্রভাব তৈরির সুযোগ তুরস্ক কাবুলে পাচ্ছে না। তাদের বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ চেষ্টাও সফল হয়নি। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালের তালেবান সরকারের সমর্থক ছিল পাকিস্তান আর সৌদি আরব। আফগানিস্তানের যে পশতুন জাতি তালেবান নিয়ন্ত্রণ করে তার বড় একটি অংশ বাস করে পাকিস্তানে। পাকিস্তানেও তালেবানের প্রভাব রয়েছে। মালালা ইউসুফের উপর হামলা ও পেশওয়ারের স্কুলে তালেবানি হামলা এখনো দগদগে। ফলে কাবুলে তালেবানের ফেরা পাকিস্তানি তালেবানকে আরও শানিত করতে পারে। তালেবানের সাথে নয়াদিল্লির সম্পর্ক কখনোই উষ্ণ ছিল না।
এছাড়া কাশ্মীর ইস্যুতে তালেবানের মতাদর্শিক অবস্থানও নয়াদিল্লির মাথাব্যথার কারণ। আফগানিস্তানে নয়াদিল্লির বিনিয়োগ রয়েছে। তার নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত নয়াদিল্লি। তবে অদূর ভবিষ্যতে তালেবান-নয়াদিল্লি সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। তালেবানের মধ্যে থাকা দেওবন্দ গ্রুপ নয়াদিল্লিকে সে সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে কেউ কেউ মনে করলেও তালেনানের ওপর পাকিস্তানে প্রভাব সব আশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে দেবে।
তালেবান নারীদের অধিকারে ‘কোনো সমস্যা করবে না ‘ ঘোষণার একদিন পর সমঅধিকারের দাবিতে নারীদের মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে ফাঁকা গুলি ও কাঁদানেগ্যাস নিক্ষেপ করে। গত ৪ সেপ্টেম্বর এক অন্তঃসত্ত্বা পুলিশ কর্মকর্তা বানু নেগারকে তাঁর স্বামী ও সন্তানের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। কিন্তু তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহিন আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার ও দেশটির সংস্কৃতি নিয়ে নাক না গলানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ২০ বছর আগের এবং ২০ বছর পরের তালেবান এক নয় বলে যারা আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন, তাদের জন্য এগুলো ভালো খবর নয়।
নিজেদের আদর্শের সংস্কার, দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত, শান্তি আলোচনায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার চ্যালেঞ্জও তালেবানের সামনে আছে। এছাড়া তালেবান যোদ্ধাদের হাতে হাতে থাকা অস্ত্র কোষাগারে জমা নেওয়া না হলেও বড় সমস্যা তৈরি হতে পারে। বিশৃঙ্খলা কমাতে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। তালেবানের মধ্যে কয়েকটি উপগ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। সালাফি, দেওবন্ধ মতাদর্শের দ্বন্দ্ব প্রকট হতে পারে।
এছাড়া যে আফিমের টাকা নিয়ে তালেবান নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে সে মাদক ব্যবসা তারা বন্ধ করবে কিনা সেটাও প্রশ্ন। যদি বন্ধ করে তাহলে মাফিয়াদের রোষানলে পড়তে পারে আবার না করলে তাদের শরীয়া আইন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে । অন্যদিকে গুহায় বসে হামলার পরিকল্পনা আর রাষ্ট্র পরিচালনা এক বিষয় না। স্টেট অ্যাক্টর ও নন-স্টেট অ্যাক্টর পরিচালনায় ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তারা বিশ্বাসী নয়।
গত তিন সপ্তাহে তাদের কার্যক্রম ও আচরণ এটা স্পষ্ট করছে যে, তারা স্বৈরতান্ত্রিক আদর্শ থেকে সরেনি, তাদের চিন্তায় বহুত্ববাদের কোনো স্থান নেই। মাদুর পেতে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ চালাতে চাইলে তাদের পরিণতি কী হবে এখন দেখার বিষয় সেটাই। জনগণের আস্থার ঘাটতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দক্ষ ও মেধাসম্পন্ন জনবলের সংকট এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে পিছিয়ে পড়া অবস্থান তালেবানের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। অস্ত্র উঁচিয়ে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব হবে না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
এইচআর/জিকেএস