গালি : প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য
‘ফাক ইউ’ চমকে উঠেছেন হয়তো। চমকানোর কিছু নাই। ধরে নিন, লেখকের স্বাধীনতা থেকে লিখছি। চাইলে ব্যক্তি আমাকে মনের এক পাশে সরিয়ে রেখেও পড়তে পারেন।
কিছুদিন আগে আমার মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলো। পাশে আমি বসা। পেছন থেকে আসা আরেকটা গাড়ির অসাবধানতার কারণে একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। শেষ মুহূর্তে গাড়ির চালক সতর্ক হওয়ায় কিছু হয় নাই। যথারীতি চালক মেজাজ খারাপ করে জানালার কাচ নামিয়ে আমার মেয়েকে এই গালিটি দিয়েছিলো। যেটা এই দেশে খুব স্বাভাবিক। লিঙ্গভিত্তিক গালি নয়। সবাই সবাইকে দেয় টাইপ অবস্থা। বিশেষ করে গাড়ি চালাতে গিয়ে।
আমিও খেয়েছি। হর্ন খেয়েছি। অশোভন আচরণ দেখেছি। কোনোদিন কোন প্রতিবাদ করতে পারি নাই। আমার বরকে দেখেছি প্রতিবাদ করতে। খুব মেজাজ খারাপ হলে পাল্টা গালি দিতে। কিন্তু আমি বাঙালি কুলটা নারী। আমি গালি দেই কেমন করে? প্রতিবাদও বা করি কেমন করে? পাছে আরও বেশি খারাপ কিছু বলে ফেলে। বললেই তো আমার জাত চলে গেলো।
মন খারাপ করে, ক্ষেত্র বিশেষে মাথা গরম করে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে এসেছি। বাসায় এসে অন্য কারো ওপর সেই ঝালও হয়তো ঝেড়েছি। আমাদের বাসায় গালাগালির কোন চল নাই। যতো রাগারাগি হোক গালি দেওয়ার অনুমতি নাই। কিন্তু গালাগালি না করলেও মানুষ মাত্র কিছু না কিছু গালি কিন্তু জানে। সেটাকে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবহার না করাটা ভদ্রতা এবং শিক্ষার অংশ। কিন্তু আমাদের পুরুষতান্ত্রিক প্রাচ্যের সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের লিঙ্গও (জেন্ডার) সেই ক্ষেত্র নির্ধারণ করে। একটা মেয়ের সাথে অপরিচিত কোন পুরুষ কোন অন্যায় করলে (পড়ুন গালি দিলে) , সেই মেয়ের পাল্টা গালি দেওয়ার স্বাধীনতা নাই। কারণ, আমাদের দেশে মেয়েদের ইজ্জৎ বড় ঠুনকো। কেউ তাকে মিথ্যা অপবাদ, রাগের মাথায় গালি দিলেও তাদের অসম্মান হয়। তাই, পরিবার, পরিজন, শুভাকাঙ্ক্ষীরা সারাক্ষণ তাদের সম্মান রক্ষার্থে ব্যস্ত। পুরুষ সঙ্গী থাকলে প্রয়োজনে সে প্রতিবাদ করবে, দুটো কথা শুনাবে, কিন্তু নারী নিজে নয়।
কেউ সঙ্গে না থাকলে চুপ করে সরে আসতে হবে, সম্মান হারানোর ভয়ে। বাবা, ভাই, স্বামী, বন্ধু, কলিগদের কাছ থেকে পাওয়া এই বর্ম আমরা খুশি মনে ধারণ করি, নিজেদেরকে সুরক্ষিত এবং ধন্য মনে করি তাদের এই বর্মের আড়ালে। তারাও সেই বর্ম হতে পেরে গর্বিত হয়।
এই আমি , আমার মেয়েকেও হয়তো এভাবেই বড় করতে চেষ্টা করেছি। আমার মেয়েকে যখন গালি দিলো লোকটা, আমার মনে হচ্ছিলো, গাড়ি থামিয়ে একটা কষে চড় দেই। কিন্তু ঐ মনে হওয়া পর্যন্ত। আমি টু শব্দও করি নাই। আমার মেয়ে কিন্তু ঠিকই কাচ নামিয়ে লোকটাকে পাল্টা গালি দিয়ে দিয়েছে। হতভম্ব আমার দুইটা রিঅ্যাকশন হলো একসাথে। এক, আমার মেয়ে কিভাবে গালি দিলো? তাও, আমার সামনে? আর দ্বিতীয়টা প্রচণ্ড ভয়। আজন্ম লালিত পুরুষ ভীতি, সম্মান খোয়ানোর ভীতি। পাশে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, সে নির্বিকার। গালি খেয়ে তার সম্মান যায়নি। প্রতিবাদ না করার কষ্টে তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে না। চোখে পানি নেই, ভয় তো দূরের কথা। সে কখনো আমার মতো নিজেকে অসম্পূর্ণ মানুষ ভাবে না, যার একটা পুরুষ বর্ম লাগে অনেক জায়গায়। বরং প্রয়োজনে সে অন্য নারী, পুরুষ অনেকের বর্ম হতে পারে।
নিজের মুখ দেখতে পেলে আমি নির্ঘাত দেখতে পেতাম একই সাথে বিস্ময়, ভয় এবং সবশেষে প্রশান্তি। আমি একটি ছেলে, একটি মেয়ে বড় করি নাই, আল্লাহর রহমতে আমি দুটো মানুষ বড় করেছি।
লেখক : আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী।
এইচআর/এমএস