ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি এবং বর্তমান পদস্খলিত সমাজ ব্যবস্থা

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:০৯ এএম, ২৬ আগস্ট ২০২১

মনিরা নাজমী জাহান

গত ২৪ আগস্ট ছিল ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কতিপয় পুলিশ সদস্য দ্বারা ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন কিশোরী ইয়াসমিন। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সামু, সিরাজ, কাদেরসহ পাঁচ জন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন অনেকে। পরে আন্দোলনের মুখে জড়িত তিন পুলিশ সদস্যদের বিচারে ফাঁসির রায় হয় ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট। এরপর ২০০৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে রায় কার্যকর হয়। সেই থেকে দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসলেও ঘটনার এত বছর পরেও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে নারী-শিশু নির্যাতন কমেছে নাকি বেড়েছে?

একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে আমরা শিউড়ে উঠতে বাধ্য কারণ এই ধর্ষণ তো কমেই নি বরং ভয়াবহভাবে বেড়েছে। শুধু তাই নয় এই ভয়াবহভাবে সমাজের প্রতিটি স্তরে বিস্তার লাভ করেছে। ধর্ষণ হয়ে পড়েছে আজকের সমাজের এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। যে ব্যাধি সমাজকে প্রতিদিন কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। আর ভয়াবহ ব্যাধিটি যাদের মাধ্যমে বিস্তার ঘটছে সেই সব ধর্ষকরা একেকটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানব।

এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবদের হাত থেকে রক্ষা নেই সমাজের যে কোন বয়সী মহিলাদের। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না এই ধর্ষক নামক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবদের।বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে এমন কোনো একটি দিন পাওয়া যাবে না, যে দিন বাংলাদেশের কোনো না কোনো প্রান্তে কোনো না কোনো নারীকে প্রতিহিংসার শিকার হতে হচ্ছে না। এই ভয়াবহ জঘন্য অপরাধটি যেন আমাদের যাপিত জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই অপরাধ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথাও নেই।সমাজ যেন মেনেই নিয়েছে যে নারীর প্রতি হিংসা খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। নারীর জন্মই যেন হয়েছে প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার জন্য।মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশে ১ হাজার ৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৫১ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন ৫৫৪ জন নারী, যাদের মধ্যে ২৪০ জনকে তাদের স্বামী হত্যা করে। অথচ এই ২০২০ সালে করোনা নামক ভয়াবহ ভাইরাস যা স্তব্ধ করেছিল গোটা পৃথিবীকে। এই ভাইরাইসের কবলে পড়ে পৃথিবীতে এমন কোনো সেক্টর নেই, যে সেক্টরের চাকা থমকে যায়নি। কিন্তু এই ভয়াবহ করোনা ভাইরাসও পারেনি নারী নির্যাতনকে থামাতে। করোনা নামক মহামারি বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে মানবসভ্যতার আলো, মানুষ যখন প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে তখন থেমে থাকেনি নারী নির্যাতন। নারী শুধু ঘরের বাইরে নয়, নিজ ঘরেও নিরাপদ ছিল না এই করোনাকালে। ২৪০ জন নারীকে তাদের স্বামীর হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে।

আমরা যদি গত কয়েক বছরের পরিস্থিতি লক্ষ করি, তাহলে দেখব, গণমাধ্যমে প্রকাশিত উচ্চ আদালতে দাখিলকৃত পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রেরিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে থানাগুলোতে ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩৩১টি, ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৬৮৩টি, ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৬৯৫টি, ২০১৯ সালে ৬ হাজার ৭৬৬টি ও ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৬ হাজার ২২০টি মামলা দায়ের করা হয়। প্রতি বছর এই মামলার পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে। এত গেল দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা কিন্তু এর চেয়ে আরো অনেক গুণ বেশি ঘটনা ঘটে থাকে, যেসব সহিংসতার ঘটনাগুলো মামলা পর্যন্ত যেতেই পারে না। তার আগেই ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্নভাবে ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়।

ডিজিটাল বাংলাদেশের নারীরা অনলাইনেও নিরাপদ নয়, সেখানেও তাদের শিকার হতে হয় বিভিন্ন রকম সহিংসতার। বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ২০২০ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন।সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীদের জেন্ডার ভিত্তিক পার্থক্য করলে দেখা যায় ,ভুক্তভোগীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৪৩.৪৫% এবং নারীদের সংখ্যা ৫৬.৫৫%।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় নারীকে ভোগ্যপণ্য ভাবার ক্ষেত্রে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যেন এক প্রকার স্বর্গসুখ অনুভব করে। সমাজ জীবনের এমন একটি জায়গা পাওয়া যাবে না যেখানে নারী নিরাপদ, যেখানে নারীকে যৌন হয়রানির স্বীকার হতে হয় না। নারীর জীবনে এমন কোনও সম্পর্ক বোধহয় পাওয়া দুষ্কর যার দ্বারা নারীর জীবনে নিগৃহীত হওয়ার উদাহরণ নেই।পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ষণ সমাজকে নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ধর্ষণ এবং ধর্ষণের ভয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এবং লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। এই সমাজে এখনও নারীকে দুর্বল ও অবলা হিসেবে ধরা হয় যেখানে তার প্রধান কাজ হচ্ছে সন্তান জন্ম দেওয়া। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এইসব আধিপত্যবাদ এবং আগ্রাসীমূলক আচরণ পুরুষদেরকে নারীদের যৌন নির্যাতনের বিষয়ে এক ধরনের উৎসাহ প্রদান করে।

অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে কোন অপরাধী অপরাধ সংগঠিত করার আগে সেই কৃত অপরাধের কারণে প্রাপ্ত আনন্দ এবং সেই অপরাধ কারণে প্রাপ্ত শাস্তিকে মাথায় রেখেই সেই অপরাধ সংগঠিত করে। যেহেতু ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সুতরাং একজন ধর্ষক এমন ভয়াবহ শাস্তির ভয়ে ধর্ষণ থেকে নিজেকে বিরত রাখার কথা এবং সমাজে ধর্ষণের হার কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রকৃত চিত্র তার উল্টো, ধর্ষণের হার তো কমেইনি বরং উদ্বেকজনক ভাবে বেড়ে চলছে। কিন্তু কেন? এর কারণ হচ্ছে লজ্জাজনকভাবে, বহু বছর ধরে, "ধর্ষণ"কে একটি সম্পত্তিগত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পুরুষরা মহিলাদেরকে নিজেদের ভোগ্যপণ্য বা নিজের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করে এবং সেই বিকারগ্রস্ত বিবেচনা বোধ থেকে তারা আগ্রাসী হয়ে মহিলাদের দমন করার জন্য তাদের লিঙ্গকে মহিলাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। যতক্ষণ না পর্যন্ত পুরুষেরা মহিলাদেরকে নিজ্জস্ব সম্পত্তি বা ভোগ্য পণ্য ভাবা বন্ধ না করবে ততক্ষণ এই জঘন্য অপরাধ সমাজ থেকে নির্মূল সম্ভব নয়।

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আইন রয়েছে; তবে একমাত্র আইনই এই অমানবিক অপরাধকে নির্মূল করতে পারে না। ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির বিচারের রায় ও কার্যকর করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও সমাজ থেকে এই ভয়াবহ ব্যধিকে নির্মূল করা যায়নি। নির্মূল করতে হলে অবশ্যই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দেশে নারীজাগরণ নিশ্চিত হবে। এই নারীজাগরণ নিশ্চিত করতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি নারীদের মধ্যে। আর এই নারী জাগরণের লড়াইয়ে প্রতিটি নারীকে অবশ্যই শামিল হতে হবে। কারণ নারীর জাগরণ ছাড়া একটি সমাজে নারীমুক্তি আসতে পারে না।

লেখক : শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন