ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বরিশাল: নিশি গোলমাল নিশিতেই অবসান

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ১০:২৬ এএম, ২৫ আগস্ট ২০২১

বরিশালে মেয়র আর প্রশাসনিক সংঘাতে ভালো পুলক পাচ্ছিল বিএনপি। এতে সরকারের পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে, এখন টোকা দিলেই সরকার পড়ে যাবে-এমন টাইপের কথাবার্তা শুরু করেছিলেন বিএনপিসহ বিরোধীমতের কয়েক নেতা। বরিশালের ঘটনার জেরে বাংলাদেশে কাবুলের ঘটনাও যেতে পারে বলে ওজনদার বাতকে বাতও চলেছে। সরকার থেকে দৃঢ়তার সাথে বিষয়টিকে মামুলি-ঠুনকা-নিছক ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা বলে চালান হয়েছে।

এমন ঘটনা ঘটেই থাকে বলে সরলীকরণে ফেলে সফলও হয়েছে সরকার। একরাতের ঘটনা দু-তিন পর আরেক রাতে খানাপিনা-মিলমিশে মিটিয়ে দেয়া হয়েছে। মাঝে দিয়ে কয়েকটা দিন টুকটাক মারপিট, কয়েকজন আহত, কিছু ক্ষয়ক্ষতি, মামলা-পাল্টা মামলা, হুমকি-ধমকি, প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে কাউকে ছাড় না দেয়ার হুঁশিয়ারি, মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর পদত্যাগের আওয়াজের সার্কাস চলেছে। ময়লা-আবর্জনা নিয়ে একঝলক দুর্ভোগ সয়েছে বরিশাল নগরবাসী। ইউএনওর বাড়িতে হামলার দুই মামলার এক নম্বর আসামি মেয়র সাদিক প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন বলে জানিয়েছেন সংবাদ সম্মেলন করে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এলে মেয়র নিজ থেকেই গ্রেফতার হবেন বলে জানান।

প্রধানমন্ত্রী বরিশালের গত ক’দিনের ঘটনা ও মেয়রের ভূমিকায় কী সিদ্ধান্ত নেবেন বা নিতে পারেন তা বেশ কয়েক দফায় দল ও সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তার কথার সারমর্ম হচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী কাউকে ছাড়বেন না। অপরাধী যেই হোক ছাড় নেই।

‘কাউকে’-টা কে? কাকে ‘ছাড়’ দেয়া হবে না, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা কারা?- তা ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ধারার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ডিসি-ইউএনও, এসিল্যান্ডকে ফরিদপুরের এমপি নিক্সন চৌধুরীর গালমন্দ-হুমকির পর কিছুটা বিরতি দিয়ে ঘটলো বরিশালের ঘটনা। সেখানকার মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহও প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের অন্যতম সদস্য। সাদিক আব্দুল্লাহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের রক্তের উত্তরাধিকার। নিক্সনও বঙ্গবন্ধু পরিবারের আরেক কৃতীমান।

ফরিদপুর ও বরিশালের ঘটনায় ভিন্নতা বেশি নয়। ব্যানার অপসারণ করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বুধবার রাতে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ইউএনওর বাসভবনে হামলা করেছে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তারা পুলিশের সঙ্গেও সংঘর্ষে মেতেছে। তার ওপর সিটি করপোরেশনের আবর্জনাবাহী ট্রাক দিয়ে রাস্তা বন্ধ করা, বর্জ্য ফেলে নগরীকে ভাগাড় তৈরির ক্রিয়াকর্মও ঘটেছে। এসব কাজের হুকুমদাতা হিসেবে এসেছে মেয়রের নাম। তাকে প্রধান বা হুকুমের আসামি করে মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে সেই দৃষ্টেই।

শোকের মাসে ১৫ ও ২১ আগস্টের মধ্যভাগে এমন ঘটনা ক্ষমতাসীনদের জন্য বড় বিড়ম্বনার। জনগণের প্রতিনিধি আর জনপ্রশাসনের প্রতিনিধির বিরোধ প্রশাসনের জন্যও অপমানের। বরিশালের প্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে ‘আমলাতন্ত্র’ ভার্সেস ’জমিদারতন্ত্রের’ ক্ষমতার প্রদর্শনী। এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন থেকে বিবৃতি দিয়ে ঘটনাকে আরও গুরুত্ববহ করে তোলা হয়েছে। ভুলে ভরা বানান ও বাক্যে বলা হয়েছে, বরিশালের মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ’র অত্যাচারে সমগ্র বরিশালবাসী অতিষ্ঠ। আরেক জায়গায় বলছে ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত’।

প্রশ্ন এসেছে তারা কি হঠাৎ তা জানলেন? তারা বা তাদের কলিগরা কি এতোদিন বরিশালে ছিলেন না? তারা কি সরকারের কাছে রিপোর্ট করছিলেন? নাকি নমস্যের সঙ্গে ‘দুর্বৃত্তের অত্যাচার’ মেনে নিয়েছিলেন? এখন কেন বলছেন, অতীতের গৌরবগাথা দিয়ে বর্তমানের অপরাধ আড়াল হয় না? অপরাধ তো অপরাধই, তার কোনো পারিবারিক পরিচয় থাকে না। কোনো রাজনীতিও থাকে না। প্রশাসনিক ক্যাডারের সমিতির বিবৃতির ভুল বানান ও ভাষা কি এবারই প্রথম? নিজেদের ঘাড়ে না পড়লে বোধ আসতে নেই? সরকারি কর্মকর্তাদের এমন ভাষার কোনটা আগে ব্যবহার হয়নি? নেতা-রাজনীতিক-মন্ত্রীদের প্রতিপক্ষের প্রতি নিয়মিত যে শব্দমালা ব্যবহার করেন- সেগুলো কী এর চেয়ে উত্তম কিছু? রাষ্ট্রের স্টিয়ারিংয়ে থাকা রাজনীতিকদের ভাষার চেয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভাষা কতোই বা উৎকৃষ্ট হবে?

উত্তরাধিকার যেমন যোগ্যতার মানদণ্ড নয়, তেমনি প্রশাসনের কে কবে ছাত্রলীগ করেছেন তাও বর্তমানের একমাত্র মাপকাঠি নয়। কারণ পৃথিবীর দেশে দেশে প্রশাসন স্বাধীনভাবেই কাজ করে। রাষ্ট্র যে আইন, যে বিধি তৈরি করে দেয়- সেই বিধি মোতাবেক আমলাতন্ত্র তথা প্রশাসন চলে। রাজনীতি বা দল দিয়ে প্রশাসন চলে না। সেই বিবেচনায় বরিশালের ঘটনা তাই হঠাৎ অবাক হওয়ার মতো নয়। বীজতলা নির্মাণ থেকেই চাষাবাদ শুরু, তারপর সেচ-সার, কতো যত্ন-আত্তি, কতো পাহারা। এরপর এখন ফসল দেখে কেন অবাক-হতবাক হওয়া? এটি অনিবার্য ফলন।

আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসনের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে যারা ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রের লক্ষণ’ বলতে চান তারাও তা এখনই টের পেয়েছেন? আরও আগে বরিশাল অঞ্চলে এক ইউএনওকে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধ- তার বিরুদ্ধে মামলা এবং জেলে পাঠানোর আদেশ আবার তাকে এজলাসে বসিয়ে রেখে জামিন দেয়ার ঘটনার সময় ব্যর্থ রাষ্ট্রের কথা মনে হয়নি? বছর কয়েক আগে পাবনায়ও কাণ্ড কম হয়নি। ডিসি-এসপিকে আক্রমণ করা হয়েছিল। ঘটনার ২০-২৫ দিন পর এইচটি ইমাম গিয়েছিলেন। কর্মকর্তারা অঝোরে কেঁদেছিলেন তার সামনে। তারপর সেখানের আওয়ামী লীগের কর্মীদের দাবির মুখে আমলাদের বদলি করা হয়। তাদের যেখানে কাজ করবেন সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতাদের মতামতের দিক খেয়াল রাখতে পরামর্শ দিয়েছিলেন এইচটি ইমাম।

এইচটি ইমাম প্রয়াত হয়েছেন। তিনি যে বার্তা-পরামর্শ পাবনায় দিয়েছিলেন বরিশালেও সেটাই হয়েছে। প্রশাসনের আওয়ামী লীগ আর মাঠের আওয়ামী লীগের রাতবিরাতের গোলমাল মিটিয়ে দেয়া হয়েছে। মামলা-পাল্টা মামলা সব চুকে যাবে। মেয়রও এখন আর দুর্বৃত্ত নন। ইউএনও-ওসিসহ প্রশাসনের লোকেরাও ভুল কিছু করেননি। গণমাধ্যমের ভাষায়, বরিশালবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। পিটুনিতে আহতদের ঘা-ব্যথার উপশমটা বাকি। ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া এবং নেয়ার বিষয় আশয়ও ফয়সালা হয়ে যাবে বলা যায়।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম