মর্যাদার ইন্ক ৫ হাজারে আমেরিকান-বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান
যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস ম্যাগাজিন ইন্ক ( Inc) প্রতিবছরের ন্যায় প্রকাশ করেছে ৫ হাজার ব্যবসায়ীদের তালিকা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ম্যাগাজিনে ব্যবসায়ী হিসেবে স্থান করে নেয়া অনেক মর্যাদার। আমেরিকার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে কে ‘ Inc. 5000 ‘ প্রতিবছর নতুন নতুন নাম প্রকাশ করে থাকে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ইতোপূর্বে এই ম্যাগাজিনের তালিকায় মাইক্রোসফটসহ Intuit, Zappos, Under Armour, Patagonia তথা পৃথিবীর খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানগুলো জায়গা করে নিয়েছিল। এরই ক্রমধারায় বাংলাদেশি বংশদ্ভোত এক দম্পতির প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এসজে ইনোভেশন এই ম্যাগাজিনের ৪৪৪২ নম্বর তালিকায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে ২০২১ এ। গত ১৮ আগস্ট ম্যাগাজিনটি এই তালিকা প্রকাশ করে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইন্ক (Inc, www.inc.com ) ম্যাগাজিনটি পৃথিবীর অন্যতম প্রধান একটা বিশ্বস্ত বিজনেস-মিডিয়া ব্র্যান্ড, যা ব্যবসায়ীদের এবং উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় আরও অভিজ্ঞ করে তুলতে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ-ফিচার-নিবন্ধ তথা একটা ব্যবসায়িক নির্দেশনা হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। খ্যাতি পাওয়া এ ম্যাগাজিনের ম্যাটেরিয়েল কিংবা টুলস প্রতি মাসে ৫০ মিলিয়নেরও বেশি পাঠক-দর্শকদের কাছে পৌঁছে তাদের ওয়েবসাইট, নিউজলেটার, সোশ্যাল মিডিয়া, পডকাস্ট এবং প্রিন্টসহ বিভিন্ন চ্যানেল জুড়ে। খ্যাতি পাওয়া এই ম্যাগাজিনটি মর্যাদপূর্ণ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের একটা তালিকা প্রকাশ করে প্রতি বছর, যা Inc 5000 নামে পরিচিত। প্রেস্টিজিয়াস এই তালিকাটি ১৯৮২ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্টের ক্রমবর্ধনশীল কিংবা ব্যক্তি উদ্যেগে পরিচালিত আমেরিকার জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় নিয়ে ১৯৮২ সাল থেকে প্রকাশ করে আসছে।
বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী নিউহয়র্কে বসবাসকারী শাহেদ ইসলাম এবং বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের ম্যানচেষ্টারে বেড়ে উঠা শাহেরা চৌধুরী ২০০৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭ বছরের ক্লান্তিহীন কাজের মধ্য দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানের (SJ Innovation) দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ব্যবসাক্ষেত্রে এক দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেছেন। সিলেট পাইলট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে আমেরিকায় পাড়ি দেয়া শাহেদুর রহমান এবং যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টারে বেড়ে উঠা সাহেরা চৌধুরী দু’জনই সফটওয়ার প্রোগ্রামিং এর উপর স্নাতক, শাহেদ নিউইয়র্ক এবং সাহেরা পড়েছেন ম্যানচেষ্টারের বিশ্ববিদ্যালয়ে। সতেরো বছর আগে প্রতিষ্ঠা করা এ প্রতিষ্ঠান তিল তিল করে এগিয়ে নিচ্ছিলেন তারা। উত্থান-পতন ছিল তাদের কোম্পানিতেও। কিন্তু তারপরও তাঁদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানের একটি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
শাহেদ-সাহেরা দম্পতির পতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত SJ Innovation আমেরীকা ভিত্তিক বিভিন্ন কোম্পানিকে ওয়েব সেবা দিয়ে যাচ্ছে। গত ১৭ বছরে তারা ৩ হাজারেরও বেশি ওয়েব সাইটের ওপর কাজ করেছে। পৃথিবীর পাঁচটি দেশে ছড়িয়ে থাকা এসজে ইনোভেশন’র অফিস এবং টিম মেম্বারদের মাঝে বাংলাদেশে আছে তাদের ঢাকা এবং সিলেট অফিস, যেখানে তারা ৭০ টি বিশ্বমানের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে তাদের বিশাল টিম । নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য, ইউক্রেন, ভারতের গোয়া, ঢাকা সিলেটে এই টিমে কাজ করছেন দেড় শতাধিকেরও বেশি উদ্যমী মানুষ।
শাহেদ ইসলাম এবং বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের ম্যানচেষ্টারে বেড়ে উঠা শাহেরা চৌধুরী
ইন্ক ৫০০০ এ তাদের তালিকাভুক্ত হওয়া এসজে ইনোভেশনের জন্য একটা বিশাল প্রাপ্তি । এ সাফল্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী (সি ই ও) এবং প্রতিষ্ঠাতা শাহেদ ইসলাম বলেন,"আমরা একটি সাধারণ মিশন দিয়ে কাজ শুরু করেছি, " কর্মচারীর সুখী রাখার মধ্য দিয়েই ক্লায়েন্টদের সফলতা তথা কোম্পানির সাফল্য নিয়ে আসা'' এই ধারায় কোম্পানিটি আরও গ্রহণযোগ্য এবং মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে আমাদের কাজ করতে হয়েছে গত ১৭ বছর, এখনও আমরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি।
এসময়ে আমাদের জন্য আরও সুখকর এবং অনন্দময় সংবাদ হল, মহামারিকালীন আমরা বাংলাদেশে আরও কর্মী নিয়োগ দিতে সক্ষম হয়েছি। এসজে ইনোভেশন কমিউনিটি আউটরিচ প্রোগ্রামগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে এবং শুধু গত ৩ বছরে ৫০০জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে নতুন প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ দিয়েছে আমাদের প্রতিষ্ঠান। আমরা বাংলাদেশি হিসেবে, বাংলাদেশে ৭০ জন কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে উচ্চ বেতনের চাকরি নিশ্চিত করেছি এবং পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে চাকুরির সুযোগ বৃদ্ধি করতে পেরে আমরা গর্বিত।”
প্রতিষ্ঠানটি এ সাফল্যে SJInnovation এর সহ ফাউন্ডার ও প্রতিষ্ঠানটির সি ও ও শাহেরা চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, '' এসজে ইনোভেশন শুধু যে সারা পৃথিবীব্যাপীই ব্যাপ্তি পেয়েছে, তা নয়, আমাদের এ প্রতিষ্ঠান মেধায়-প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণতা পাচ্ছে প্রতিদিন। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিপর্যায়ে যেমন আমরা নিজেদের আরও বিকশিত করে তুলছি, ঠিক সেভাবেই পেশাগতভাবেও আমরা আমাদের নিয়ে আসতে পেরেছি এক ভিন্ন উচ্চতায়, এবং এটা ছিল আমাদের সফলতার জন্য অত্যাবশ্যক।''
এসজে ইনোভেশন প্রতিষ্ঠানের প্রাণ তাদের টিম'র প্রত্যেক সদস্যদের সুখ-সাচ্ছ্যন্দকে (হ্যাপিনেস) গুরুত্ব দিয়ে থাকে, এবং এটা তাদের ব্যবসার অন্যতম প্রধান আদর্শ। এই প্যান্ডামিকের সময়ে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গত বছর সিলেটের 'সিলেট হেলথ সাপোর্ট' স্কীমের আওতায় করোনাকলীন সময়ে প্রায় ৫হাজার পেশেন্টকে সার্ভিস দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এতে অন্যতম প্রধান উদ্যেক্তা ছিলেন।
করোনাকালীন এমনকি তাদের টিম মেম্বারদের অভিভাবক কিংবা আত্নীয়দের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে নিউইয়র্ক থেকে শাহেদ কাজ করেছেন, এখনও করছেন।
মর্যাদার ইন্ক ৫০০০ এর স্বীকৃতি
টিম মেম্বারদের পাশাপাশি তারা তাদের কাজকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন একইভাবে। আমেরিকার প্রভাবশালী এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি সফটওয়ারভিত্তিক যে কোন কাজকেই গুরুত্বের সাথে নিয়ে থাকে। লাখ লাখ ডলারের ক্লায়েন্ট আছে তাদের। অথচ ক্লায়েন্ট বিশ্বস্ত হলে এমনকি ১০০ ডলারের কাজকেও তারা হাতে নেন। তাদের কাছে ছোট চাকুরি বলতে কিছু নেই। ম্যানচেষ্টারে অবস্থানকালীন এই দম্পতির সাথে আলাপে তারা এটাই জানালেন।
সাহেদ ইসলাম তাঁদের ব্যবসার এই সাফল্যে তাঁর উচ্ছ্বাসের কথা জানিয়ে বলেন, তারা গত দু'বছর থেকেই এই ৫ হাজার ব্যবসার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে এপ্লাই করেছিলেন, কিন্তু ইন্ক এর বিবেচনায় গত দুবছর তা তারা মনোনীত হতে পারেন নি। করোনাকালীন তাদের টার্নওভার আগের চেয়ে অনেক ভাল ছিল। এবারের ব্যবসা বিবেচনায় অর্থাৎ ২০২০ (প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালে) এর ম্যাগাজিনটির বিবেচনায় তারা এ সাফল্য পেয়েছে। একজন আমেরিকান-বাংলাদেশি ব্যবসায়ী হিসেবে বাংলাদেশে তাঁদের কোম্পানির ব্যাপক কোন পরিচিতি নেই, যদিও বাংলাদেশের প্রথম আলো এবং কালের কণ্ঠ তাঁদের নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছে, গত চার/পাঁচ বছর আগে।
আবারও উল্লেখ করা যায়, দুই বাংলাদেশী-আমেরিকানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত SJ Innovation একটি নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি, যা বভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে সফটওয়ার সমস্যার জন্য কাস্টমাইজড সমাধান দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্সে বিশেষজ্ঞ, এবং সবই তাদের দক্ষ-অভিজ্ঞ টিম দ্বারা পরিচালিত। এসজে ইনোভেশন ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছে এবং ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড সফটওয়্যার (বেসিস) এর সদস্যপদ লাভ করে।‘এসজে ইনোভেশন’ টিম বাংলাদেশ সরকারের সাথে (nrb.gov.bd) কাজ করেছে- একটি ডিজিটালাইজড সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকারে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ সরকারের সহায়ক হতে SJ Innovation প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম