২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও এগিয়ে চলা
পৃথিবীতে কোন কোন দিন আসে সূর্যের প্রখর তীব্রতা নিয়ে, কোন কোন দিন অমাবস্যার রাতের চেয়েও অন্ধকারময়। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল, ঠিক তেমনি এক ভোরে ইতিহাসের কালপুরুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নক, কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য।
এই হত্যাকাণ্ড স্তব্ধ করে দেয় বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অর্জিত আমাদের রক্তস্রোত স্বাধীনতাকে। জাতির জনককে হত্যা করা হবে এ কথা বঙ্গবন্ধুপ্রেমী বিশ্বনেতৃত্বও কোনদিন বিশ্বাস করতে পারেনি। দেশের সাধারণ মানুষও তো একথা কোনদিন কল্পনাও করেনি। করার কথাও নয়।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাবন্দী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকেও নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে। যাঁরা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানী কারগারে আটক, সেই কঠিন ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার লাল সূর্য।
কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির ক্রমাগত আক্রমণ বার-বার স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমতাভিত্তিক সমাজের অগ্রগতির ধারাকে। এই জঘন্য অপশক্তি ২০০১ সালে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় রাজনীতির নতুন মেরুকরণ। ফের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। রক্তাক্ত হতে শুরু করল বাংলাদেশ। নতুন করে আমাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ। শুধু নৌকা প্রতীকে ভোট দেয়ার কারণে ধর্ষিত হয়েছে শত শত তরুণী। হাজার হাজার ঘরবাড়ি আক্রান্ত হয় ঐ খুনিদের আক্রমণে। বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের ওপর চলে নির্মম অত্যাচার।
বিএনপি-জামায়াত জোটের হত্যা আর অপরাধের ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী এক মিছিলপূর্ব-সমাবেশ আহ্বান করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তাঁকে লক্ষ্য করে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে থাকে। এই গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান আইভী রহমানসহ চব্বিশ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায় শত শত নেতাকর্মী। এখনও আমাদের বহু জাতীয় নেতা গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে নিয়ে অমানবিক জীবন যাপন করছেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এই গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে হামলাকারীরা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্বকে। আমরা একটু অতীতের দিকে ফিরে যাই, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে কার্যকরী ছিল আইএসআই ও সিআইএ। তাদের ক্রীড়নক ছিল খুনী ডালিম, ফারুক, রশীদচক্র ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মীর জাফর খুনি মোশতাকের চক্র। কিন্তু এ-কথা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, জিয়াউর রহমান ছিল বঙ্গবন্ধু খুনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদদাতা। ঠিক এমনিভাবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, হাওয়া ভবনের অধীশ্বর তারেক রহমান ছিল একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মূল মদদদাতা।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত চক্র ক্ষমতাসীন হওয়ার পর জিয়াপুত্র তারেক রহমান বিকল্প ক্ষমতা কেন্দ্র গড়ে তোলে ঐ হাওয়া ভবনে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, সেনা গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, পুলিশ বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই তাজউদ্দীন ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেএমবির ঘাতকরা। এই পুরো নীলনকশা হাওয়া ভবন ও তারেক রহমানের মস্তিষ্কজাত।
খুনীরা চেয়েছিল নির্বিঘ্নে এই হত্যাকান্ড সম্পাদন করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে জননেত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ায় খুনিদের সেই দুরাশা পূরণ হয়নি। অনেক আন্দোলন সংগ্রাম ও নেতাকর্মীর আত্মত্যাগের মাধ্যমে আজ জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। পলাতকদেরও দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করার চেষ্টা অব্যাহত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে ও রায় কার্যকর হচ্ছে। ঠিক তেমনিভাবে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মাস্টারমাইন্ড তারেক রহমানসহ অপর আসামিদের বিচার কার্যক্রম চলছে।
কেবল এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি খুনির দল। তারা সাজিয়েছিল জজ মিয়া নাটক। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে যখন তৎকালীন সামরিক গোয়েন্দা প্রধান এই গ্রেনেড হামলা নিয়ে কথা বলতে চেয়েছেন, তখন বেগম জিয়া বলেছিলেন, ‘এটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি দেখছি’! যা কিনা সামরিক গোয়েন্দা প্রধান তার জবানিতে বলেছেন।
ইতিহাসের নির্মম মিলন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পূর্বে খুনি ফারুক, রশীদ যখন জিয়ার সঙ্গে কথা বলেছিল তখন জিয়া বলেছিলেন তোমরা যদি পারো কিছু করো। আমার সমর্থন থাকবে। সাংবাদিক লরেন্স লিফ্সুজ তার জবানিতে বলেছেন জিয়াউর রহমান সমস্ত ঘটনা ঠাণ্ডা মাথায় এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। অপর এক সাংবাদিক এন্থনী মাসকারেনহাস লিখেছেন, জিয়াউর রহমান ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মূল ছাতা। লরেন্স লিফ্সুজ আরও লিখেছেন, জিয়া চাইলে ঐ ক্যু থামাতে পারতেন। এটা ছিল তার সাংবিধানিক দায়িত্ব। ঠিক খালেদা জিয়া ঐ ঘটনা জেনেও বিদ্রূপাত্মক মনোভাব দেখিয়েছেন।
১৯৭১ এর আগে পরে সকল আন্দোলন সংগ্রাম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আওয়ামী লীগ সদা-সর্বদা গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। কখনও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ পরিহার করেনি। খুনের মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক শক্তিকে উচ্ছেদ করতে চায়নি। এখনও রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেও বিধিবদ্ধ আইনের মাধ্যমেই সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই এক বিরল দৃষ্টান্ত।
আজ এই শোকের দিনে আমরা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ যারা সেই দিন প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, যারা পঙ্গু ও আহত অবস্থায় অপরিসীম কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। ইতিমধ্যে মহামারি করোনা সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে মুখে ফেলে দিয়েছে। নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে সামরিক জান্তা গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে মিয়ানমারকে। আফগানিস্তানের মসনদে তালেবানদের আহরণের মধ্যে দিয়ে শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয় সমগ্র বিশ্ববাসী আতঙ্কের মুখে। এমতাবস্থায় যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলাম সেই অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, সামাজিক সমতা ভিত্তিক দেশ গঠনে সকল প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক-মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানাই।
লেখক : স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতা।
এইচআর/এমএস