ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শিক্ষা ভুবনে সম্মিলিত অবসাদ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১০:০৭ এএম, ০৭ আগস্ট ২০২১

করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পড়ছে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে, পরিবার সমূহের শৃঙ্খলায়, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের উপরে, সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক নানা স্তরে। বহু ছেলেমেয়ের পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, তারা আর কোনদিন হয়তো স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যিালয়ে ফিরবে না। দরিদ্র পরিবারের মেয়েগুলো বাল্য বিয়ের শিকার হচ্ছে। কলেজের এমনও ছাত্র আছে যারা তাদের উচ্চমাধ্যমিক স্তর শেষ করবে কলেজের করিডোরে পা না রেখেই।

সরকারের অবস্থান পরিষ্কার - সংক্রমণ পরিস্থিতি উন্নতি না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে। দীর্ঘ সময় এই অস্বাভাবিক বিরতিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি তারা মানসিকভাবে ভালো নেই। সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু শিক্ষার্থীদের উপর। তারা অসামাজিক হয়ে পড়ছে আর বড়দের একটা অংশ হচ্ছে মাদকাসক্ত।  

শিশুদের কাছে তাদের স্কুলটা বৃহত্তর এক ভূবন। এ সময়টিতে পড়াশুনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সামাজিকতাও শিখে। নিজের পরিবারের বাইরে নানা প্রকার পরিবারের সন্তানদের সাথে পরিচয় গড়ে উঠে, কত রকমের আদানপ্রদান হতে হতে তারা সামাজিক হয়ে উঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন থাকে। সেসব এখন বন্ধ। স্কুলে যাওয়া, ফিরে আসা, পড়তে বসা, খেলতে যাওয়া – এই যে শৃঙ্খলা – সব হারিয়ে যাওযায় শিশুদের মানসিক বিকাশের উপর নানা নেতিবাচক বিষয়ের প্রভাব পড়ছে গত ১৭ মাস ধরে।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পরিস্থিতিও নাজুক। হল বন্ধ, ক্লাস নেই, কাজ নেই – সব নেই-এর মাঝে এদের মাঝে দেখতে পাচ্ছি সম্মিলিত অবসাদ। এ অবসাদ একজন বা দু’জন শিক্ষার্থীর নয়, বলতে গেলে পুরো শিক্ষা স্তরের।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা, পরীক্ষা নেওয়ায় যে ঝুঁকি আছে সেটা সবাই বুঝি বা জানি। এ বিষয়ে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক সবাই একমত। সরকার পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন অতি দ্রুত। কিন্তু একথাও সত্য যে, শিক্ষা নিয়ে গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে কোন জাতীয় আলোচনা হতে দেখলাম না। প্রতিষ্ঠানে না গিয়েও পড়াশোনা চালু রাখা যায়। কিন্তু যতটুকু চালু রইল, তা পুরোপুরি ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন-নির্ভর। সারা দেশের স্বচ্ছল অভিভাবকরা এটা মেনে নিলেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চেষ্টা করল, কিছু শিক্ষার্থী পারল, কিছু পারলা না ডিভাইস ও দামী ডাটা কিনে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কিছুই আটকে থাকল না। তাদের ভাষায় ফিজিক্যাল ও ডিজিটাল – এর সমন্বয়ে ফিজিটাল সিস্টেমে এগিয়ে থাকল সরকারিদের চেয়ে। সাধারণ শিশুরা অ্যাপ ব্যবহার করা শিখল, কিন্তু সবাই নয়। ইংরেজি মাধ্যম আর শহুরে নামী স্কুল কলেজ চালিয়ে যেতে পালল কিছুটা। অতিমারির এক ঝকঝকে পরিণাম হলো পড়ুয়াদের মাঝে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’।

প্রায় দুটি বছর চলে গেল শিক্ষা জীবন থেকে। শিক্ষামন্ত্রী, উপমন্ত্রীসহ শিক্ষা কর্তাব্যক্তিরা একটু পরিমাপ করে দেখতে পারেন এ সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতির অবনমন কতটা হল। একটা ব্যবস্থা কি করা যেত না দূরত্ববিধি বজায় রেখে শিক্ষা চালু রাখার? আসলে অতিমারি ঠেকানোর একমুখী প্রশাসনিক উদ্যোগ আমাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাকেই মন্থর করে দিল। আর সেই ফাঁকে ঢুকে এল বৈষম্য। শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিভাজন ঢুকল তা আর সহজে বেরোবে বলে মনে হয় না।

দেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো শিক্ষা এবং তাকে বাঁচাতে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া কতদিনে সম্পন্ন হবে সেই রোড ম্যাপও জানতে পারছি না আমরা। করোনা আক্রান্ত ২২২টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৯টি দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরো সময় ধরে বন্ধ রেখেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।

শিক্ষা এবং অর্থনীতি- একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পূর্ণভাবে যুক্ত। তাই আমাদের উন্নয়ন যাত্রাকে বেগবান ও সুব্যবস্থায় আনতে শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে রাখা যাবে না করোনার অজুহাতে। অনেক দেশই একটা নির্দিষ্ট বিরতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকায় মহামারী শুরুর চার থেকে ছয় মাস পরই খুলেছে, পরিস্থিতি বুঝে এলাকা বা রাজ্যভেদে বন্ধও করেছে, আবার চালু করেছে। আমাদের দেশেও নির্দিষ্ট বিরতিতে অন্তত: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো খোলা রাখা যেত। এত দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠান একেবারে তালাবদ্ধ থাকায় শিক্ষার গুণগতমান নষ্ট হয়েছে। এসাইনমেন্ট সিস্টেমে তা পূরণ করা সম্ভব না।

তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা ভাবতে হবে। এ জন্য শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী সবার টিকার আয়োজন করতে হবে। আমরা শুনছি ১১ আগস্টের পর পরিবহন খুলবে, শপিংমল, দোকানপাট খুলবে, সীমিত পরিসরে সামাজিক অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হবে। যদি ৫০ জন বা ১০০ জন নিয়ে একটা বাস চলতে পারে, বিয়ে হতে পারে, তাহলে শ্রেণি কক্ষে পাঠদান সম্ভব হবে না কেন? আবেগ, উৎকন্ঠার বাইরে গিয়ে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটা জাতীয় মতামত গঠন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা, পাঠদান করা ও পরীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/জিকেএস