শেখ কামাল তোমাকে আমরা সবসময় খুঁজছি
বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল। কবি সুকান্ত মাত্র ২১ বছর বেঁচে ছিলেন। শেলী, কীটস্, বায়রন বেশি দিন বাঁচেননি; শেখ কামালের ছিল মাত্র ২৬ বছরের জীবন। এই অল্প বয়সে জীবনে কত কি না করেছেন! মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশাল অবদান ছিল। ক্রীড়াক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা, সঙ্গীতাঙ্গনে তাঁর অবদান, নাট্যাঙ্গনে অনবদ্য ভূমিকার কথা নতুন প্রজন্মের জানা প্রয়োজন। কেননা বর্তমান প্রজন্ম শেখ কামালকে কতটুকুই তাঁকে জানে বা জানার সুযোগ হয়েছে। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর উপন্যাসে বিষয়টা এমনভাবে তুলে এনেছেন। ‘ছেলে হলে কী নাম রাখবেন? জেলে বসে আমি এই কথাটা অনেক ভেবেছি। তুর্কি বীর কামাল পাশার নামে নাম রাখব। তুমি কী বলো? ছেলে হলে নাম রাখব ‘শেখ কামাল’। রেণু বললেন সুন্দর নাম। ‘বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখকদের মধ্যে একজন ছিলেন যুক্তিবাদী ব্রিটিশ দার্শনিক ও গণিতবিদ বার্টান্ড রাসেল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য জেল-জুলুম, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেও বাড়িতে অবসর পেলেই বঙ্গবন্ধু বই নিয়ে বসতেন। তার সংগ্রহেও অনেক বই ছিল। তিনি বই পড়ার সময় সহধর্মীণী ফজিলাতুননেছা মুজিবকেও (রেণু) শোনাতেন। ফজিলাতুননেছা মুজিব তিন বছর বয়সেই বাবা-মাকে হারান।
বড় ছেলে শেখ কামালের নামের ক্ষেত্রেও এরকম ঘটনা এসেছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারে এ নামটি এসেছে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নাম থেকে। কামাল আতাতুর্ক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কারের মাধ্যমে ধর্মাশ্রয়ী অটোমান সাম্রাজ্যকে একটি আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্রে রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। ফজিলাতুননেছা মুজিব এসব বিষয়েও অবগত ছিলেন। বড় ছেলের নাম রাখলেন শেখ কামাল।
মেজ ছেলে শেখ জামালের নামটি এসেছে মিসর তথা আরব জাতীয়তাবাদের প্রধান নেতা জামাল আব্দেল নাসের থেকে। নাসের রাজনৈতিক প্রভাবে তখন ইরাক, লিবিয়া, আলজেরিয়া ছাড়াও আরবের বাইরেও স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তুলতেও নাসের অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
তিনটি ছেলের নাম থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের উদার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মিথষ্ক্রিয়ার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রকৃতার্থে সেটাই শেখ কামাল নামকরণের ইতিহাস। ২২ বছর বয়সে শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। আবার যুদ্ধফেরত এই মুক্তিযোদ্ধা নিজেকে সামরিক বাহিনী থেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন গণমানুষের কাতারে। ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট ওয়ার কোর্স’র কমিশন পেয়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন কেবল ছুটেছেন নতুন সৃষ্টির নেশায়। রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, খেলা, সংস্কৃতি সব অঙ্গনে দাগ কেটেছেন শেখ কামাল। সমাজ বদলানোর জন্যই যে তার জন্ম হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর এই উত্তরসূরির জন্মও গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম। শৈশব শুরু হয় নানা টানাপড়েনের মধ্যে। বিশেষ করে বাবার স্নেহ-মমতাই ছিল দুষ্প্রাপ্য বস্তু। বঙ্গবন্ধু প্রায়শ কারাবাসে কাটাতেন বলে তার সঙ্গ পেতেন না খুব একটা। তাই মায়ের ছেলে হয়েই তার বেড়ে ওঠা। ঢাকার সেগুনবাগিচার ডনস স্কুলে শুরু তার শিক্ষাজীবন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে মাঠের। হিসাব করলে দেখা যায় শেখ কামালের বয়স তখন ১৫-১৬ বছর। কবি সুকান্তের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘আঠারো বছর বয়স’ । “আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/র্স্পধায় নেয় মাথা তোলাবার ঝুঁকি,/আঠারো বছর বয়সেই অহরহ / বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি ।”
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ‘৬৪-৬৫ সালের দিকে ধানমন্ডিতে ক’টা বাড়িই বা ছিল? এখন বহুতল ভবনের কংক্রিটের গ্রাম হচ্ছে ধানমন্ডি। ওখানে সেই সময় কোনো শপিংমলের প্রশ্নই ছিল না। হয়তো দু-একটি মুদি দোকান থাকলেও থাকতে পারে। তখনকার সময়ে ধানমন্ডিতে বিহারি-বাঙালি মিলিয়ে তখন পরিবার ছিল ৫০-৬০টির মতো। অফিস-আদালত করে তারা যে যার বাসায় ঢুকে পড়ত, তাদের মধ্যে খুব মাখামাখিও ছিল না। ওসব বাড়ি ছিল সরকার অনুমোদিত নকশায়, তেমনি কেডিএস ফার্মার সামনের ওই মাঠটিও ছিল ছেলেপুলেদের খেলাধুলার এবং তাতে ওয়াকওয়ে ছিল মানুষের হাঁটাচলার জন্য। ওই নকশাতেই ছিল , বাস্তবে ছিল না। পাশের রাস্তায় আড্ডা দিত একদল তরুণ। সেই দলে ছিলেন হারুনুর রশিদ, বাচ্চু, জিএম ইকবাল, জিএম ফারুক, কেএম মোজাম্মেল, ওমর, কেএম হক মন্টু, শাহাব উদ্দিন সেন্টু, সিরাজুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, দেওয়ান মঞ্জুরুল হক, মাহফুজুর রহমান, কেএম জিলানী, মাসুম হাসান, মঞ্জুর রহিম, জিল্লুরসহ অনেকে। তাদের বেশিরভাগই ম্যাট্রিক পাস করে পড়ছেন কলেজে। কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। পাড়ায় থাকলে তাদের আড্ডা ওই মাঠের ধারে। এখানেই শেখ কামালের সাথে সবার পরিচয় ।
হারুনুর রশিদের (বর্তমান আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক , সাবেক এমপি ) মনে আছে কামালের সঙ্গে প্রথম আলাপের স্মৃতি, “তখন আমরা বন্ধুরা মিলে গল্প করছিলাম আগের জায়গায়। কামাল আমাদের জুনিয়র, সম্ভবত কলেজে ভর্তি হয়েছে সে। কিন্তু এসেই একনাগাড়ে বলে গেল নানা কথা। ‘আমরা সবাই মিলে এই মাঠ পরিষ্কার করে ফেলব। নতুন ক্লাব গড়ব। তরুণদের খেলাধুলার দিকে নিয়ে আসতে হবে, নইলে নষ্ট হয়ে যাবে। এই পুরনো ধাঁচের খেলা দিয়ে হবে না। সামনে এগোতে হলে আমাদের আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। বাইরের কোচ লাগবে। খেলার প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে হলে খেলোয়াড়দের জন্য ভালো টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করতে হবে। খেলে সংসার চালাতে না পারলে এদেশে খেলার উন্নতি হবে না।’এই ছেলে বলে কী! তবে তার এই চিন্তা-ভাবনা শুনে আমরা অবাকও হয়েছিলাম। অল্প বয়সী ছেলের মাথায় এত কিছু থাকে কীভাবে। ওইদিনের আলাপের পর থেকেই শেখ কামাল আমাদের অলিখিত নেতা হয়ে গেল। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমরা বয়সে বড় হলেও তার চিন্তা-চেতনা আর দশজনের থেকে আলাদা ছিল।” এটাই তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে নতুন বন্ধুদের দলে।ইতিহাসের অনেকগুলো টুকরো টুকরো ঘটনা আছে। কমিটির কয়েকজন মিলে তারা সাধারণ সভা করে ইকবাল স্পোর্টিংয়ের নাম বদলে ফেলে। নতুন নাম হয় আবাহনী ক্রীড়াচক্র। নামবদলের পর সাধারণ সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের কাগজপত্রসহ সবকিছু আদালতে পেশ করা হয়। ভবিষ্যতে যেন কেউ ঝামেলা করতে না পারে। আদালতের অনুমোদনে দাঁড়িয়ে যায় আমাদের আবাহনী ক্রীড়াচক্র। সেই থেকে আমরা আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয় শেখ কামালকে। আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতির শুরু ১৯৬৬ সালে হলেও দেশে বড় আঙ্গিকে তার নবযাত্রা হয় ১৯৭২ সালে। আবাহনী ক্রীড়াচক্র নাম নিয়ে।
দুই.
শেখ কামাল কতটা সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন তা আবাহনীর নামকরণের কাহিনী শুনলে বোঝা যাবে । সংগঠনের নাম চেয়ে ধানমন্ডি এলাকার প্রত্যেক বাড়িতে চিঠি বিলি করা হয়েছিল। জমা পড়েছিল ইংরেজি-উর্দু অনেক নাম। তখন সে-রকম নামের প্রচলন ছিল কিন্তু তারা পছন্দ করেন একটি বাংলা নাম ‘আবাহনী’। লালমাটিয়া কলেজের বাংলার অধ্যাপক মতিউর রহমান দিয়েছিলেন নামটি। সংগঠনের নাম হয়ে গেল আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি। পাকিস্তান আমলে কোনো ক্লাব সংগঠনের এটাই প্রথম বাংলা নাম। হারুনুর রশিদের স্মৃতিতে আছে, “আমরা সবাই তখন সদস্য সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কামালের অনুপ্রেরণায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জোলি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বতন প্রো-ভিসি নাসির আহমেদ শিলু আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতির সদস্য হন দুই টাকা করে চাঁদা দিয়ে। একইভাবে আমার ভাবী সেলিনা ইসলামসহ অনেক মহিলা এর সদস্য হয়েছিলেন। আমাদের সংগঠনের তিনটি শাখা ছিল-ক্রীড়াচক্র, সাহিত্য চক্র ও সাংস্কৃতিক চক্র। ১৯৬৮ সালে একবার হৈ চৈ করে নির্বাচনও হয়েছিল। সেখানে শেখ হাসিনা হয়েছিলেন সাহিত্য সম্পাদিকা। তখন আমাদের কার্যক্রম ছিল বাঙালি বিভিন্ন দিবসগুলো পালন করা।
যেমন- একুশে ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ আমরা সবাই ফুল নিয়ে শহিদ মিনারে যেতাম। প্রথম বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৬৯ সালে মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর ‘তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট’। বড় আয়োজন, তাই ফজিলাতুন্নেসা মুজিব টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান ও মানিক মিয়ার স্ত্রী ছিলেন কো-চেয়ারম্যান। ২৪ দলের এই টুর্নামেন্টে নারায়ণগঞ্জ থেকেও এসেছিল একটি দল। টুর্নামেন্টের সুবাদে ছড়িয়ে পড়ে আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতির নাম।”খেলাধুলার পাশাপাশি ওই মাঠে এলাকার তরুণরা নিয়েছিলেন অস্ত্র পরিচালনার ট্রেনিং। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের আগে এই মাঠে প্রায় ৫০ জন তরুণকে ট্রেনিং দিয়েছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন শওকত আলী। বাঙালি তরুণরা মুখে কাপড় বেঁধে অবাঙালি বাড়িগুলোতে গিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে ৮০টির মতো অস্ত্র জোগাড় করেছিলেন। সেগুলো দিয়েই ট্রেনিং নিতে নিতেই যুদ্ধে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। ২৫ মার্চ কালরাতে বঙ্গমাতাকে অভয় দিয়ে শেখ কামাল রওনা দেন মুক্তিযুদ্ধে।
তিন.
অভিনেত্রী ডলি জহুরের বিশ্বাস, “কামাল ভাই বেঁচে থাকলে দেশের সংস্কতি অঙ্গনের মাথা হয়ে থাকতেন।”বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তওরিক হুসেইন বাদল কোনো অঙ্গনের জন্য আলাদা করতে পারে না কামালকে, “কামালকে নির্দিষ্ট করে কোনো ছাঁচে ফেলা মুশকিল। একদিকে তার রাজনীতি, সেই কলেজ-জীবন থেকে তার সরব উপস্থিতি। তারপর মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। পাশাপাশি নাটক করছে। সেতার বাজাচ্ছে। আবার নিজে খেলছে, আবাহনী গড়ছে। এমন বহুমাত্রিক চরিত্রের তরুণ খুঁজে পাওয়া দায়। চাইলে কেউ হতে পারবে না, ‘ঈশ্বর প্রদত্ত’ কিছু না থাকলে এমন হওয়া যায় না।” এ-রকম ক্ষণজন্মা মানুষদের হাতেই সমাজের খোলনলচে বদলে যায়। শেখ কামালের ২৬ বছরের কর্মজীবনে আছে অনেক বদলানোর ছবি।দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার স্মৃতি থেকে সমাজবিজ্ঞানের সহপাঠী তত্তরিক হুসেইন বাদল বলেন, “আমরা গিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী মেলায় অংশ নিতে। সেবার এখানকার অনেক নাটকের দল গিয়েছিল সেখানে। ডাকসু থেকে আমরা গিয়েছিলাম নাটকের দল নিয়ে।
সেই দলের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্যার( বর্তমানে জাতীয় অধ্যাপক ) । নাটকের নাম ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’। জর্জ বার্নার্ড শ’র লেখা অনুবাদ করেছিলেন নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। কামাল তার প্রধান চরিত্র, বিপরীতে ছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার। আমি প্রম্পটিং এবং অভিনয় করেছি। তখনো পাসপোর্ট হয়নি, পারমিট নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার জীবনের প্রথম প্লেনে চড়া। কলকাতায় নামার পর আমাদের এয়ারপোর্টে বরণ করে নিয়েছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, আকাশবাণীর জনপ্রিয় খবর পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকে। আমাদের সেই দলে ছিলেন আনোয়ার হোসেন দিলু, হাবিবউল্লাহ হাবিব, আসলাম ভুঁইয়া, যারা পরে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।” উল্লেখ করা যেতে পারে ’ সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক নাটকে শেখ কামাল নিয়মিত অভিনয় করতেন। প্রয়াত শিক্ষাবিদ আবুল ফজল শেখ কামালকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন তা পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করছি । “খুব ধারাবাহিকভাবে নয়, মাঝে মাঝে অবসরমতো আমার দিনলিপি লেখার অভ্যাস আছে।
২৬-১০-৭৫ তারিখে দিনলিপি লিখতে গিয়ে হঠাৎ শেখ সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের কথা মনে পড়লো। পিতার সঙ্গে তাকেও হত্যা করা হয়েছে। তার সাথে আমার মাত্র বার তিনেকের দেখা। স্রেফ দেখাই। তেমন কোনো আলাপ-পরিচয় ঘটেনি। একবারই দু’একটি কথা বিনিময়ের সুযোগ ঘটে। প্রথমবার ওকে দেখেছি অত্যন্ত দূর থেকে। শুধু চোখের দেখা-তখন কিশোর কিংবা কৈশোরে উত্তীর্ণের পথে ও। সন-তারিখ মনে নেই। খুবসম্ভব, ১৯৬৬-৬৭ই হবে। ঢাকার সুবিখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানটের’ বার্ষিক অনুষ্ঠান, ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট হলে। আমাকে করতে হয়েছিল সভাপতিত্ব। ভাষণ ইত্যাদি প্রাথমিক পর্ব শেষ হলে শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অর্থাৎ গানবাজনা, নৃত্য ইত্যাদি। মঞ্চ থেকে নেমে এসে আমরা আসন নিয়েছি দর্শকদের চেয়ারে। আমার পাশে বেগম সুফিয়া কামাল। তিনি তখন ‘ছায়ানটের’ সভানেত্রী। সমবেত ঐকতানের প্রস্তুতি নিয়ে শিল্পীরা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র হাতে মঞ্চে আসন নিয়েছে অর্ধবৃত্তাকারে। শিল্পীদের সারির মাঝখানে দীর্ঘকায় হ্যাংলাদেহ এক ছেলে সেতার হাতে ঋজু হয়ে আসন নিয়ে সংকেতের প্রতীক্ষায় বসে আছে আসন গেড়ে। সে বয়সেও গোঁফের রেখা স্পষ্ট।
অঙ্গুলি নির্দেশ করে সুফিয়া কামাল বললেন-
:ওইটি মুজিবের ছেলে।
: কোন মুজিবের?
তখনো এক নামে চিহ্নিত হয়নি। শেখসাহেব।
: শেখ মুজিবের। ছায়ানটের ছাত্র।
শেখ মুজিব তখন জেলে। ভোগ করছেন দীর্ঘ কারাবাস।..১৭ মার্চ শেখ সাহেবের জন্মদিন। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ প্রতিবছর এ দিনটি পালন করে থাকে। ১৯৭৪-এর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য ঢাকার ছাত্রলীগ আমাকে অনুরোধ জানায়। আমি রাজি হলাম, তবে দিনে দিনে ফিরে আসতে চাই এ শর্তে। তারা সেভাবে বিমানের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছিল।
১৭ তারিখ ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, ওরা আমাকে নিতে আসবে কিনা, এলেও আমি চিনতে পারবো কিনা। ওদের কারো সঙ্গে তো আমার দেখা নেই। এ যাবৎ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ওদের প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রাম শাখার সদস্যদের কেউ কেউ। তাদের কেউ আবার আমার সহযাত্রীও হয়নি।
নিজের ছোট্ট হ্যান্ডব্যাগটি হাতে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় মেয়ের বাসায় কী করে যাওয়া যায় সেকথা ভাবতে ভাবতে নির্গমনপথে এগোলাম। একধারে দেখলাম একটা ছিপছিপে গোঁফওয়ালা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ লম্বা বলে সহজে চোখে পড়ে। ছেলেটাকে আমি চিনতে পারলাম না।
লাউঞ্জের প্রবেশপথে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলে-
: আপনাকে নিতে এসেছি।
বলেই আমার হাত থেকে ব্যাগটি আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজের হাতে নিয়ে নিল। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম-
: তুমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসেছ?
: জি হাঁ।
নম্র কণ্ঠে জবাব দিলো ছেলেটি।
ওর পেছনে পেছনে হেঁটে এসে একটা গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসলো ও নিজে। এবং শুরু করলো ড্রাইভ করতে। তার আগে ও জেনে নিয়েছে আমি কোথায় উঠবো। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মনে হঠাৎ কৌতুহল হলো, জিজ্ঞাসা করলাম-
: তুমি কি করো?
বলল-
: অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি সোসিয়োলজিতে।
: ঢাকা থেকে?
: জি হাঁ।
শেখ সাহেবের সঙ্গে ছেলেটির দৈহিক সাদৃশ্য আমার মনে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়ে উঠছিল। জিজ্ঞাসা করলাম-
: তোমার নাম?
: শেখ কামাল।
: ও তুমি আমাদের শেখসাহেবের ছেলে।
: জি হাঁ।
বললাম-
: এত সব মন্ত্রীরা থাকতে আজকের অনুষ্ঠানে আমাকে কেন তোমরা নিয়ে এলে প্রধান অতিথি হতে?
তেমনি আবেগহীন কণ্ঠে ও বলল-
: আপনার এক কথা ওঁদের হাজার কথার সমান। মনে মনে সংকোচ বোধ না করে পারলাম না। ”
চার.
১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে জাতীয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় খেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের হয়ে, সহ-অধিনায়ক ছিলেন তিনি। আর ভলিবল খেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃবিভাগ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন করেন নিজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগকে। বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাডমিন্টনেও তার উজ্জ্বল উপস্থিতি, দ্বৈতে একবার রানার্সআপ হন মুরাদ লতিফের সঙ্গে জুটি বেঁধে। ১৯৭৫ সালে সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক ক্রীড়ায় জেতেন ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। কোন খেলাটি খেলেননি তিনি, সেটাই হলো বড় প্রশ্ন। খেলা আনন্দের, এটিকে তিনি আবার ব্যবহার করেছেন পারস্পরিক সৌহার্দ-সম্প্রীতির জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ বনাম ছাত্র ইউনিয়নের প্রীতি ফুটবল ম্যাচটি তারই এক অনন্য উদাহরণ।
সমাজ বদলানোর জন্যই যে তার জন্ম হয়েছিল। সেই স্মৃতি সামনে নিয়ে আসেন গোলাম সারোয়ার টিপু, “বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের মুখেই দেখি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার কোলে জয়। একটা বাড়ি পরেই তারা থাকেন সপরিবারে। তাঁর সঙ্গে আমাদের দলের বাদশা-বাটুদের ভালো পরিচয়, তাদের সঙ্গে একটু কথাবার্তা হয়েছে। আলাপ শেষে এগোতে এগোতে দেখি বঙ্গবন্ধুর বৈঠকখানার সামনে বারান্দায় সাদা শাড়ি পরা ফর্সা এক ভদ্র মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। শেখ হাসিনা গিয়েও তার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলছেন। তিনি ছিলেন খালেদা জিয়া। তখন তো তাকে বিশেষভাবে চেনার কোনো কারণ ছিল না। অনেক পরে সেই স্মৃতির চেহারাটা মিলেছে জিয়াউর রহমানের স্ত্রীর সঙ্গে।” এরপর তাদের আবাহনী প্রতিষ্ঠাতার চিলেকোঠা দর্শন, “কামালের রুম না বলে বলা উচিত একটা চিলেকোঠা। সেখানে বসে আমরা কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলি। এরপর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একটা ট্রেতে করে নিয়ে আসেন সমুচা। জিজ্ঞাসা করেন, কে কে চা খাবো? দেশের প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে আমাদের জন্য সমুচা আর চা নিয়ে এসেছেন। এতটাই সরল ও সাদামাটা ছিল ওই পরিবার। কামালের রুমটাও ছিল খুব সাধারণ মানের। আমার ভাবনায় ছিল সাজানো-গোছানো একটা কক্ষ হবে।”
পাঁচ.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য এই ক্লাবের শুরুর দিকের সদস্যও। পরে রাষ্ট্রের বড় দায়িত্বে জড়িয়ে পড়ায় ক্লাবের নিত্য সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে না পারলেও তিনি ভাইয়ের ক্রীড়া-কীর্তির খোঁজখবর রাখেন সব সময়। তাই কামাল আর আবাহনীর প্রসঙ্গে উঠলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে- “১৯৭৫ সালে ৩১ জুলাই জার্মানি যাওয়ার দিন কামালকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোর কী লাগবে। সে বলেছিল, তার খেলোয়াড়দের জন্য অ্যাডিডাস বুট নিয়ে আসতে।” এটাই ছিল ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শেষ সাক্ষাতের স্মৃতি, যা তাকে বারবার কাঁদিয়ে যায়।
টাকার লোভ তাকে যেমন ছুঁতে পারেনি, তেমনি তার ক্লাবকেও। অন্তত যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এই শুদ্ধতার চর্চা করে গেছেন ক্লাবে। আবাহনীর চলতে কষ্ট হলেও ক্লাবটিকে কখনো দুষ্টুচক্রের ভেতর ঢুকতে দেননি এই তরুণ। ক্লাবের ম্যানেজার সুভাষ সোমকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, “কেউ কোনো স্বার্থের জন্য যেন এ ক্লাবে না আসে। আমার জানামতে, সবুর খান ক্লাবে বড় অঙ্কের টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আবাহনী ক্লাবের সব খরচ তিনি বহন করবেন। তাতে রাজি হননি কামাল ভাই। ওই সময় রাজাকার-আলবদর বাহিনীর লোকজনও ক্লাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে টলাতে পারেনি।
নারায়ণগঞ্জের বাচ্চু নামে এক ব্যবসায়ী আমাকে দিয়ে আবাহনীকে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কোনো একটা ব্যাপারে সরকার তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছিল। কামাল ভাইকে তার কথা বলতেই তিনি সতর্ক করেছিলেন আমাকে। ভবিষ্যতে যেন এ-রকম কোনো প্রস্তাব নিয়ে তার মুখোমুখি না হই।” জানা যায় , আবাহনীর সার্কাস দল ছিল । ক্লাবের আয়ের উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ! “এটা এখন হয়তো অনেকের বিশ্বাস হবে না, তবে আবাহনীর নামে একটি সার্কাস দলও তৈরি করেছিলেন শেখ কামাল ।১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হওয়া সার্কাস শোর হিসাব দেখিয়েছেন ম্যানেজার। এই শো থেকে আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৪৪ টাকা। বড়লোকরা টাকা নিয়ে শেখ কামালের আশেপাশে ঘুরছেন। তিনি একটু হ্যাঁ বললেই ক্লাবের তহবিল ফুলে-ফেঁপে ওঠে। সেই চাঁদার টাকা তিনি চাননি, খুঁজেছেন নিষ্কলুষ আয়ের পথ। ভেবেছেন ক্লাবের নিজস্ব আয়ের কথা। মানুষকে সার্কাসের বিনোদন দিয়ে আয় করা গেলে ক্ষতি কী!
ছয়.
একথা এখন সবার জানা হয়ে গেছে , শেখ কামালই বাংলাদেশের ফুটবলে আধুনিকতা এনেছিলেন। এই ক্লাবের প্রথম বিদেশি কোচ উইলিয়াম বিল হার্ট, যার ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ফুটবল কোচিং বিদ্যা এবং অভিজ্ঞতা। এমন একজনের হাতে দল তুলে দেওয়ার মধ্যে সম্ভাবনার চেয়ে বেশি থাকে ঝুঁকি। নানা দোলাচলের পরও শেখ কামাল কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন ওই বিদেশি ভদ্রলোককে। পরে এই আইরিশ বিল হার্টেই ১৯৭৪ সালে আবাহনীর নতুন শোভা।
শেখ কামালের বড় একটা গুণ ছিল নতুন কিছুকে আলিঙ্গন করতে পারত। আমরা অনেকে হয়তো এটা-সেটা ভেবে ভয় পেতাম, ইতস্তত করতাম কিন্তু সে চ্যালেঞ্জ নিতে পারত। সালাউদ্দিনসহ কয়েকজন হার্টকে কোচ করার ব্যাপারে প্রস্তাব করলেও আমাদের মধ্যে নানারকম দ্বিধা ছিল। প্রথমত, সে কোনো পাস করা কোচ নয়। তার ফুটবল-জ্ঞান থাকলেও আমরা তো সত্যিই কিছুই জানতাম না ইউরোপীয় ফুটবল সম্পর্কে। স্বাভাবিকভাবে আমাদের মধ্যে নানামুখী মত ছিল। শেষ পর্যন্ত কামাল ঝুঁকি নিল তাকে কোচ করার।”আজকের যে ‘বিকেএসপি’ সেটারও ভাবনা চিন্তার খোরাক যুগিয়েছিলেন শেখ কামাল ।
ইতিহাসের পাদটীকা হিসেবে উল্লেখ করা যায়। কোন এক দিন বঙ্গবন্ধু কী যেন আলাপ করছেন, সঙ্গে ছিল শেখ কামালও। হঠাৎ টিপুসহ কয়েকজন খেলোয়াড়ের কানে লাগে বঙ্গবন্ধুর একটি কথা। তিনি ইউসুফ আলী সাহেবকে বলছিলেন, “ঢাকার কাছাকাছি বড় কোনো জায়গা দেখেন, যেখানে খেলাধুলার সব সুযোগ-সুবিধা করা যাবে।” খেলাধুলার বড় জায়গার কথা শুনে সবাই একটু আগ্রহী হয়ে ওঠে। পরে এ ব্যাপারে কামালকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন টিপু। তিনি বলেছিলেন, “একাডেমির মতো কিছু একটা করার জন্য বড় জায়গার কথা বলেছেন আব্বা। যেখানে ভালো সুযোগ-সুবিধা থাকবে, আধুনিক ব্যবস্থা থাকবে। সব ক্লাব গিয়েও ওখানে খেলতে পারবে- এ রকম একটা জায়গা।” একাডেমির মতো করার পরিকল্পনা কার ছিল বা কার মাথা থেকে এসেছিল সেটা টিপু নিশ্চিত নন। তবে তিনি ধারণা করেন, “কামালই এ-রকম কিছু একটা গড়ার চিন্তা করেছিল। কারণ খেলাধুলা নিয়ে সে ভাবত এবং বাইরের খোঁজখবরও রাখত।খুবই সাদাসিদা জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন শেখ কামাল।
গোলাম সারোয়ার টিপু’র স্মৃতিচারণে উঠে আসে টুকরো টুকরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য । “সফরে প্রায় প্রতিদিন কামালকে একটা প্যান্ট ও শার্ট পরে থাকতে দেখে আমার একটু বিস্ময় হয়েছিল। সে কি আর কোনো কাপড়-চোপড় আনেনি! পরে বরকতের কাছে শুনি তাই, লম্বা এক সফরে সে গিয়েছিল মাত্র এক-দুটো শার্ট-প্যান্ট নিয়ে। দুদিন পরপর রাতে সেগুলো ধুয়ে দিত। তারপর বালিশের তলায় রেখে কোনোরকমে একটু ভাঁজ হলে পরদিন আবার সেই কাপড় গায়ে চেপে সে বেরিয়ে পড়ত। তার দলের খেলোয়াড়রা কী স্টাইল করে চলে অথচ তার কাপড়-চোপড়, স্টাইল নিয়ে কোনো আগ্রহই ছিল না। একদম সাদামাটা। শৌখিনতা বলে কোনো জিনিস কামালের ছিল না। অন্তত দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বলে যে একটু ফিটফাট করে চলবে, এসবের ধার ধারত না সে।”
সাত.
মানুষের মন জয় করার একটা আকাঙক্ষা সব সময় তাঁর মধ্যে দেখা যেতো । নিজে বাস্কেটবল খেলার জন্য বেছে নেন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবকে। তারকা বাস্কেটবল খেলোয়াড় অভিজিৎ কুমার সরকারের মুখে শোনা গেছে গল্পটা, ’৭৪ সালের দিকে হবে। ওয়ান্ডারার্স তখন বাস্কেটবলে দুর্দান্ত দল। হঠাৎ একদিন গাড়ি করে কালাম ভাই আসেন আমাদের ক্লাবে। ক্রিকেট ও ফুটবলের সুবাদে তাকে আমরা আগে থেকেই চিনতাম, তবে কখনো কথা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুবাদে তার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল আমাদের কাজী ভাইয়ের (বীরবিক্রম কাজী কামালউদ্দিন)। দুজনে খানিকক্ষণ কথা বলেছেন। এরপর কোচ কাজী ভাই আমাকে ডেকে বলেন, “ভায়া (এ কে সরকারের ডাক নাম), কামাল তো ওয়ান্ডারার্সে খেলতে চায়, কী বলো।” আমি একরকম খুশিই হয়েছিলাম। যদিও তিনি কেমন বাস্কেটবল খেলতেন জানতাম না, এরপরও খুশি হয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে আমরা খেলব ভেবে। কয়েকদিন ধরে একসঙ্গে খেলার পর আমাদের সঙ্গে কামাল ভাইয়ের দারুণ এক সম্পর্ক তৈরি হয়। তার মধ্যে দুর্দান্ত এক সম্মোহনী শক্তি ছিল, অপরিচিতদের অনায়াসে আপন করে ফেলতে পারতেন। পরে একদিন গল্পে গল্পে জিজ্ঞাসা করি, তিনি কেন ওয়ান্ডারার্সে বাস্কেটবল খেলতে এলেন। তাৎক্ষণিকভাবে জবাবটা তিনি দেননি। বলেছিলেন, “পরে বলব।” এ-কথা আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। প্রায় বছরখানেক পর একদিন তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, “তোদের ক্লাবে আমার বাস্কেটবল খেলার উদ্দেশ্য হলো, ওয়ান্ডারার্সের সমর্থকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়া। আমার খেলার সুবাদে তাদের যদি একটু আবাহনীপ্রীতি হয়। অন্যান্য দলের সঙ্গে খেলায় আবাহনীকে যদি সমর্থন করে তারা। তার কথা শুনে আমি অবাক হয়েছি। একটা মানুষ কতদূর পর্যন্ত ভাবতে পারেন, ক্লাবের জন্য কত কী করতে পারেন!”
আট.
শেখ কামাল মিউনিখ অলিম্পিকে গিয়েছিলেন । সেখানে এক ফাঁকে ঢুকে গিয়েছিলেন মিউনিখ স্টেডিয়ামে অ্যাডিডাসের দোকানে। সেখানে রুহেল আহমেদ দেখেন অন্য কামালকে, “দোকানে ঢুকে সে বাচ্চা ছেলের মতো শুরু করে দিল। ফুটবল, জার্সি, বুট কত কী সে ধরে ধরে দেখছে। প্রায় ৩ ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছিল ওই দোকানে। অলিম্পিকে যে বলটা দিয়ে খেলা হচ্ছিল সেটা তার খুব পছন্দ হয়েছিল। বাংলাদেশে তখনো ব্লাডারের ফুটবল, মানে ওপরের চামড়ার ভেতরে ব্লাডারে পাম্প দিতে হতো। এটা সে-রকম নয়। তাই কয়েকটা বল কিনে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু ১৯ মার্ক করে দাম দেখে মুষড়ে পড়েছিল। তখন আমি বলেছিলাম, টাকার কথা চিন্তা করিস না, যা মন চায় কিনে নে। অ্যাম্বাসি থেকে ৫ হাজার মার্ক দিয়েছে তোর খরচের জন্য। শুনেই সে প্রচণ্ড খেপে গেল। সে বলে, “অসম্ভব। সরকারি টাকা আমি কোনোভাবেই নিতে পারব না। তুই এই টাকা ফেরত দিয়ে দিবি।” শেষে নিজের টাকায় একটা বল কিনেছে কামাল আর আমি তার ক্লাবের জন্য ১১টা জার্সি কিনে দিয়েছি আমার বেতনের টাকা দিয়ে। আমি বেতন পেতাম ১ হাজার ২০০ মার্ক করে। আকাশি-নীল জার্সিগুলোর একেকটির দাম ছিল ৩ মার্ক। সেটা নিয়েছিল খুশিমনে।” খুব সমস্যায় পড়ে গেলেন রুহেল আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর ছেলেদের খেদমতের জন্য টাকা দিয়েছে অ্যাম্বাসি কিন্তু সেই টাকায় তারা খেদমত নেবেন না। ফার্স্ট সেক্রেটারি সাহেব যদি তাকে ভুল বুঝেন, এ নিয়ে তার টেনশন শুরু হয়।
প্রয়াত শিক্ষাবিদ আবুল ফজল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন । বঙ্গবন্ধুই তাঁকে বেশ খানিকটা বেশী বয়সেই খুবই আগ্রহসহকারে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছিলেন । বঙ্গবন্ধু’র হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের ক্যাবিনেটে শিক্ষা উপদেষ্টা হতে বাধ্য হয়েছিলেন । কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টা থাকা অবস্থায় তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে প্রথম ছোট গল্প ‘ মৃতের আত্মহত্যা ’ লিখেছিলেন । যা হোক সেটাও আরেক ইতিহাস । আবুল ফজলের লেখা থেকে আরো দু’চারটি লাইন এই পরিসরে সংযোজন করা যেতে পারে । “আমার হাতব্যাগটি এবারও নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিচে নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে আমাকে বসাল। এবারও নিজে ড্রাইভারের সিটে বসে স্টার্ট দিয়ে দিল। দেখলাম ও সব সময় একা। এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোর্ডিং কার্ড করার জন্য নিজেই ব্যাগটি হাতে নিয়ে কিউর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলে বলে কোনোরকম অগ্রাধিকার খাটাতে চাইল না। দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। যখন ওর পালা এলো তখনই শুধু টিকেটটি বাড়িয়ে দিল। বোর্ডিং কার্ড-টার্ড হয়ে যাওয়ার পর বিমান ছাড়া পর্যন্ত ও থেকে যেতে চাইছিল। আমি অনেক বলে-কয়ে ওকে লাউঞ্জ থেকে বিদায় দিলাম। একই দিন ওর গাড়িতে ও আমাকে চারবার লিফ্ট দিয়েছে কিন্তু নিজে চারবারও বোধকরি কথা বলেনি। তাতে মনে হলো ও অত্যন্ত স্বল্পবাক। শুনেছি অত্যন্ত ক্রীড়াপ্রিয় ছিল। রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও কোনো ধনীর মেয়েকে বিয়ে করেনি, বিয়ে করেছিল দেশের সেরা ক্রীড়াবিদ মেয়েটিকে। বাংলাদেশের সেরা ক্রীড়া সংস্থা ‘আবাহনী’ ওরই নিজের সংগঠন, ওরই সৃষ্টি। সেদিন দেখেছিলাম অবিকল বাপের মত করেই গোঁফ রেখেছে ও। সে দিনের ঋজু দেহ দীর্ঘ লিকলিকে চেহারার সুদর্শন তরুণটির নম্র-মধুর ছবি আমার মনে আজও গাঁথা হয়ে আছে। আজ ও নেই, বাংলাদেশের সেরা মেয়ে ক্রীড়াবিদ ওর নববধূটিও গেছে হারিয়ে। ”
আগামীকাল ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মদিন। তোমার জন্মদিনে তোমাকে খুব করে মনে পড়ছে । তোমাকে আমরা সবসময় খুঁজছি ।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম