স্যার একাধিক নারী কেলেংকারির ঘটনা যুক্ত করতে সক্ষম হইছেন
মোবারকের খুব ইচ্ছা একটা সিনেমা বানাবে। সিনেমা তৈরির জন্য অনেক কিছু দরকার। সবার আগে দরকার ভালো একটা গল্প; এরপর টাকা-পয়সা। এসব বিষয় মোবারক যে জানে না, তা নয়। তারপরও দেখা হলেই সে তাগাদা দেয়-
: দুলাভাই, কী করলেন?
: কুন বিষয়ে?
: বিষয় তো একটাই- সিনেমা।
গতানুগতিক প্রশ্নের উত্তরও গতানুগতিক হয়। ইতঃপূর্বে অনেকবার উচ্চারিত কথার পুনরাবৃত্তি করে বলি-
: আরে পাগলা! সিনেমা বানানো কি মুখের কথা? এর জন্য প্রচুর টাকা দরকার।
: কত টাকা? পাঁচ-দশ লাখ?
: ধুর! পাঁচ-দশ লাখে নাটকই হয় না আর সিনেমা!
: আমাদের ক্ষেত্রে তো বেশি টাকা লাগার কথা না। সিনেমার কাহিনী লিখবেন আপনি। ডিরেকশনও দিবেন আপনি।
: পাগলে কয় কী! সিনেমার কাহিনী লেখা কি তরমুজ কাটার মতো সহজ কোনো কাজ?
: সমস্যা কী! আপনে সাম্বাদিক না? আজকাল আলু-পটলের ব্যবসায়ীরা ফাটাফাটি গল্প খাঁড়া কইরা সুপারহিট সিনেমা বানাইয়া ফেলতেছে আর সাম্বাদিক হইয়া আপনে এই কাজ পারবেন না- এইটা কি বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা?
: সাম্বাদিকতা আর গল্প লেখা এক জিনিস নারে পাগলা। সাম্বাদিকতা এক জিনিস আর গল্প-কাহিনী লেখা অন্য জিনিস। সবাই তা পারে না।
: অসুবিধা নাই। আপনে দশজনের লেখা দশটা গল্পের চুম্বক অংশ টুকলিফাই কইরা একটা হৃদয়বিদারক প্লট তৈরি করবেন; বাকিটা দেখার দায়িত্ব আমার।
: আইচ্ছা দেখলাম। কিন্তু নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকাদের টাকা পয়সা দিতে হবে না? তারা কি মাগনা কাজ করবে?
: ধুরাউ! আপনে এখনও নায়ক চিনেন নাই। আরে আমার ছবির নায়ক তো আমি নিজে। নায়িকা ও গান-বাজনার বিষয়টা কল্পনায় মাইরা দিব।
: মানে?
: মানে খুব সহজ। আপনি কাহিনীর মধ্যে ঢুকাইয়া দিবেনÑ নায়ক কিছুক্ষণ পরপর টেলিভিশনের সামনে সিটিং করবে। ওই সময়কালে একে একে ১০টা ইন্ডিয়ান সুপার-ডুপার হিট ছায়াছবির ‘হট’ গান দেখানো হবে। গান চলাকালীন নায়িকার পাশে নায়ক নিজেরে কল্পনা করবে। ব্যস! নায়িকা-গায়িকার মামলা শেষ।
: শুধু নায়িকা-গায়িকা দিয়া সিনেমা হবে না। বাকিদের কেমনে ম্যানেজ করবা? সিনেমায় একজন কড়া ভিলেন লাগবে।
: ভিলেনের সঙ্গে আমি অগ্রিম কথা বইল্যা রাখছি। তিনি বিনা পয়সায় অ্যাকটিং করতে রাজি।
: তিনি কে?
: আমাদের মোখলেস স্যার।
: কও কী! স্যার কি অভিনয়ের সঙ্গেও জড়িত?
: না।
: তাইলে তারে দিয়া কেমনে কাজ করবা?
: দুলাভাই, আপনে নিশ্চিত থাকেন- অভিনয় না করলেও ভিলেনের কাজকর্ম বিষয়ে মোখলেস স্যারের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। অতি ওস্তাদ লোক। সিনেমার পর্দায় ভিলেন আর কী অ্যাকশন দেখায়! পান্তাভাতের সঙ্গে কাঁচামরিচ খাওয়ার স্টাইলে তিনি এর চাইতেও মারাত্মক সব অ্যাকশন ইতোমধ্যে বাস্তবে দেখাইয়া ফেলছেন।
: কী রকম!
: স্যার দ্রুততম সময়ের মধ্যে তার ক্যারিয়ারে একাধিক নারী কেলেংকারির ঘটনা যুক্ত করতে সক্ষম হইছেন। এছাড়া তার একটা কোচিং সেন্টার আছে। সেই কোচিং সেন্টার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে অতি নিবিড়ভাবে জড়িত। এছাড়া...
: কী?
: মিথ্যা মামলা দিয়া লোকজনরে হয়রানি করা, বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ, এমন কী চড়া সুদের দাদন ব্যবসার সঙ্গেও তিনি জড়িত।
: এই রকম একজন লোক শিক্ষকতা করেন কেমনে? লোকজন প্রতিবাদ করে না?
: করে, তবে তার কোনো রেজাল্ট নাই।
: কেন?
: আমাদের এমপির ছেলে তাার দোস্ত।
: বুঝতে পারছি। ঠিক আছে, এইবার কও, ছবিতে কি কোনো ফাইটিংয়ের দৃশ্য থাকবে?
: অবশ্যই থাকবে। মাইরপিট ছাড়া ছবি হয় নাকি?
: তাইলে একটা ফাইটিং গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
: উহু। তার কোনো প্রয়োজন নাই।
: কী করতে চাও?
: সিনেমার পরিচালক আপনে; অথচ আমারে জিজ্ঞাসা করতেছেন- কী করতে চাও? আরে! করবেন তো আপনে। কয়েকটা অ্যাকশন ছবির রক্ত শীতল করা মাইরপিট দৃশ্যের কাটপিস যুক্ত কইরা দিবেন। পারবেন না?
: পারব। এইবার আস শুটিংস্পটের বিষয়ে।
: শুটিং হবে আমাদের বাজারে। বাজারের পাশে রেললাইন, জঙ্গল, নদী ও বাড়িঘর আছে। উইপোকার কয়েকটা ঢিবিও আছে। হবে না?
: হবে। বাকি রইল ক্যামেরা, ক্যামেরাম্যান। ডাবিং, এডিটিং।
: ময়মনসিংহ শহরে আমার পরিচিত একটা ভিডিও দোকান আছে। বিভিন্ন বিবাহ অনুষ্ঠানের ভিডিও কইরা বেড়ায়। নিখুঁত কাজ করে। আমি তাদের সঙ্গে আলাপ কইরা রাখছি।
: হায় আল্লাহ! এই ডিজিটাল যুগে নরমাল ভিডিও দোকানের ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যান দিয়া চলচ্চিত্র নির্মাণ করবা?
: কাজকাম কী দিয়া সম্পন্ন হইল, সেইটা দেখার বিষয় না। সিনেমার পোস্টারে আমরা লেইখা দেব- অত্যাধুনিক ক্যামেরায় নির্মিত একশ’ পার্সেন্ট ডিজিটাল সিনেমা...
মোবারকের সঙ্গে এসব আত্তাবাত্তা টাইপের কথাবার্তা অনেকবার হয়েছে। এবার ঈদ করতে বাড়ি গিয়েছিলাম। কোরবানিসহ হাজিবাজি ঝামেলা শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে পাশের ইউনিয়নে অবস্থিত শ্বশুরবাড়ি গেলাম। যথারীতি মোবারকের সঙ্গে দেখা হলো। জিজ্ঞেস করলাম-
: ঈদ মোবারক; কেমন আছ?
সারা মুখে সরল হাসি ছড়িয়ে দিয়ে মোবারক বললÑ
: ঈদ হ্যাজ গন; শুধু মোবারক আছে।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর টেলিভিশনের সামনে বসে মোবারকের এ কথার অর্থ একটু অন্যভাবে করলাম। ঈদ চলে গেছে; তবে দেশের টিভি চ্যানেলগুলোয় ঈদের অনুষ্ঠানমালা আছে। বলা হচ্ছে, সাতদিন-দশদিন পর্যন্ত এগুলো চলবে। কোনো কোনো চ্যানেলে মোবারকের সঙ্গে তবারকের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। দর্শক নাটক বা অনুষ্ঠান সংক্রান্ত নির্ধারিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মধ্য দিয়ে আকর্ষণীয় পুরস্কার জিতে নিতে পারবে। দেখলাম- ব্যবস্থা খারাপ না; তবে এতে কাজ হচ্ছে কি? প্রকৃতির ‘মৃদু ডাকে’ সাড়া দিয়ে টয়লেটে ঢুকলাম। ফিরে এসে দেখি- এরই মধ্যে চ্যানেল পরিবর্তন হয়ে স্টার জলসার ঘরে চলে গেছে। টেলিভিশনের সামনে আণ্ডা-বাচ্চা থেকে শুরু করে নানা বয়সের দর্শক। যতক্ষণ বসে রইলাম, স্টার জলসা কিংবা জি বাংলা- এই কারবার চলতে লাগল।
দেশের টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিযোগিতামূলকভাবে ঈদের অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। দর্শকরা এসবের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে না; তারা ভারতীয় টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত সাপ-বেজির লড়াই কিংবা বিড়ালে-বিড়ালে ঝগড়া-কোন্দলের মতো পরিবারের দেবর-ভাবি, শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ অথবা জেঠু-ঠাকমা’দের ভেতরকার ষড়যন্ত্র-অবিশ্বাস, কুৎসা-কূটচাল, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে, তা দেখে ‘আনন্দ অথবা কষ্ট’ পাচ্ছে; তথাকথিত পারিবারিক ড্রামা-মেলোড্রামার নামে নির্মিত জঞ্জালের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। এজন্য কি শুধু আমাদের দুর্বল অনুষ্ঠান নির্মাণ পদ্ধতি দায়ী; নাকি আরও কোনো কারণ আছে? থাকলে খুব দ্রুত এর প্রতিকার খুঁজতে হবে। না হলে সামনে ভয়ংকর বিপদ অপেক্ষা করছে।
ঈদের পরপরই সরকার লকডাউন কার্যকর করতে সচেষ্ট হওয়ায় ঢাকায় ফেরার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এজন্য রাতেই ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছি- মোবারক জানতে চাইল-
: দুলাভাই, বিদ্যাগঞ্জ বাজার পার হওয়ার সময় কোনো পোস্টার চোখে পড়ছে?
: কার পোস্টার?
: আমার।
: সিনেমা তৈরির আগেই পোস্টার ছাপাইয়া ফেলছ?
: সিনেমার পোস্টার না।
: তাইলে?
: ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা ও দোয়া কামনা সংক্রান্ত পোস্টার। এলাকাবাসীরে ঈদের শুভেচ্ছা জানাইয়া তাদের কাছে দোয়া চাইছি।
: তুমি নির্বাচন করবা নাকি?
: ঠিক ধরছেন।
: কোন পদে?
: চেয়ারম্যান পদে।
: ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান?
: হ।
: ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের তো খুব বদনাম।
: বদনামের কাজ না করলে কীজন্য বদনাম হবে?
: ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা যেসব কীর্তিকলাপের সঙ্গে যুগে পর যুগ ধইরা নিজেদের যুক্ত করছে, তাতে বর্তমানে বদনামের কোনো কাজ না করলেও কেউ আর বিশ্বাস করে না। তোমারে একটা ঘটনা বলি- আমাদের গ্রামের কাইমদ্দি চাচা একদিন মাঠ থেকে ফিরে দেখেন, চাচি ভাত রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত হাল বাওয়ার কাজ শেষ করে ক্ষুধায় কাইমদ্দি চাচার বেহুঁশ হওয়ার দশা। তিনি চাচির ওপর ভয়নক রকবম ক্ষেপে গিয়ে ভাত রান্না করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু তারপরও চাচি ভাত রান্নার কাজে বিরত হচ্ছেন না দেখে তিনি লাঠি হাতে চাচির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন- ভাত রানলেও আইজ তুই মাইর খাবি; না রানলেও মাইর খাবি। বুঝলা মোবারক, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদেরও হইল চাচির কপাল। তারা চুরি করলেও চোর, না করলেও চোর। বর্তমানে এইটা ট্র্যাডিশনে পরিণত হইছে।
মোবারক আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল-
: দুলাভাই, আমি এই ট্র্যাডিশনটা ভাঙ্গতে চাই।
: খুব শক্ত কাজ।
: হোক শক্ত, চেষ্টা করতে দোষ কী?
মানুষের ইচ্ছাশক্তির কাছে নতজানু হয় হিমালয়। হার মানে সাগর-মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ। মোবারকের মধ্যে কোনো কপটতা নেই। অন্তরে যে সত্য-সুন্দরের ধারণা সে লালন করে, সেটাই কাজে পরিণত করার চেষ্টা করে। সামনেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। দেখা যাক, কী ঘটে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস