ডুবুরি লীগ এবং লীগের রাজনীতি
করোনার আগে আমি ডকুমেন্টারির কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন জেলা, উপজেলা, গ্রাম পর্যায়ে কাজ করতে হয়েছিল। সে সময়ে অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে। তার মধ্যে একজনের সঙ্গে পরিচয় হওয়া আমি কখনো ভুলতে পারবো না। তিনি নিজের নাম বলার পর বললেন তিন জাতীয় ‘ডুবুরি লীগ’র প্রেসিডেন্ট। আমি তাকে শুধু জিজ্ঞেস করলাম লীগ শব্দটা কোথা থেকে এসেছে জানেন? ব্যক্তির মুখের অবয়ব দেখে বুঝতে পারলাম আমার কথা তার ভাল লাগেনি। তিনি চেয়েছিলেন হয়তো আমিও তাকে একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে সম্মানিত করবো। কিন্তু তা আর হলো না।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে সেদিন নির্ধারিত হয়েছিল দলটির সভাপতি হবেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক হবেন শামসুল হক।
১৯৫২সালে আওয়ামী মুসলীমলীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। এক বছর দায়িত্বপালনের পর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে দলের সাধারণ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ একটি অসাম্প্রদায়িক দল হবে এই মর্মে একটি সমঝোতা হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে ২৩৭টি আসনের মধ্যে আওয়ামী মুসলিমলীগ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন। শর্তমতে মাওলানা ভাসানী দলটিকে অসাম্প্রদায়িক করতে মুসলিম শব্দটি বাদ দিতে জোর পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন। তবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভয় পাচ্ছিলেন, তাঁর ধারণা মুসলিম শব্দটি বাদ দিলে পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা কমে যেতে পারে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভ করার পর ১৯৫৫ সালে মাওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। দলটিকে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিফলন ঘটনোর জন্য এর নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ’।
পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দলটিতে ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তির ঘটনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরই ধারাবহিকতায় মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(ন্যাপ) নামে নতুন রাজনৈকিত দল গঠন করেন। ১৯৬৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর তৎকালীণ ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ’ পুনর্গঠন করা হয়। তবে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত একটানা ১৩ বছর দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট-সরকার গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসনে জয় লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানী স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে সরকার গঠন করতে বাধাগ্রস্ত হলে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের ডাক দেন। তারই সুফল হিসেবে ১৯৭১ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে পরাজিত করার লক্ষ্যে আরো একবার স্বৈরতান্ত্রিকতা প্রকাশ পায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ২১ বছর অপেক্ষার পর ১৯৯৬ সালে আবার স্বাধীনতার সপক্ষের দল সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। ২০০১ সালে আবার ক্ষমতা হারায়। তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে, ধান ভানতে শিবের গীত কেন? ডুবুরি লীগের লীগ শব্দটির জন্ম একদিনে হয়নি। এ কথাটা শুধু ওই ব্যক্তি নয়, যারা আজ আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় আছেন তাদের প্রত্যেকেরই জানা উচিত।
আমার কাছে ‘রাজনীতি’ শব্দটির অর্থ রাজ-নীতি অর্থাৎ রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ করেন যে বা যিনি। এখানে একজন ডুবুরির কেন রাজনীতি ধারণ করার ইচ্ছে হলো এই প্রশ্ন আমার কৌতূহল। একবার আমি ভারতের পাঞ্জাবে ছিলাম ওদের নির্বাচনের আগে। যে পাঞ্জাবি পরিবারের সাথে ছিলাম তাদের মধ্যে নির্বাচনের কোন আলাপ আলোচনা নেই। কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলাম এখানকার রাজনৈকিত অবস্থা কি? ওরাতো অবাক। আমাকে বলল, ‘আমি তো নির্বাচন করছি না, বা আমার পরিবারেরও কেউ নির্বাচন করছে না। তাহলে আমি নির্বাচন নিয়ে এত কেন মাথা ঘামাবো। তাছাড়া রাজনীতি করার জন্য মানুষ আছে। এটা তাদের বিষয়।’ আমার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠলো নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের চিত্র। দেখলাম রিক্সাওয়ালা গাছের ছায়ায় আরাম করে রিক্সায় শুয়ে কানে মোবাইল নিয়ে খবর শুনছে। যাবেন? বললে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। তার দৃষ্টিতে আমার জন্য অবজ্ঞায় বলছে, তুমি কতো বেকুব, নির্বাচনের খবর শুনছি দেখেও কেন যাওয়ার কথা বলছো!
রাজনীতি এখন বাংলাদেশের মানুষের জন্য কম্পোলচারি সাবজেক্ট হয়ে গেছে। বিষয়টা এমন, যেন দল না করলে তাকে সভ্য মানুষ মনে করা হয় না! খুব জানতে ইচ্ছে করে, ঠিক কি করণে এবং কবে থেকে বাংলাদেশের মানুষ এত রাজনৈতিক সচেতন হয়েছে। আমার স্কুল জীবনে ছাত্র রাজনীতি বলতে বুঝতাম কয়েকজন, যারা ভাল ছাত্র তারা রাজনীতি করতো। তারা মাঝে মাঝে ক্লাশে ক্লাশে এসে বলতো আজ আমরা ক্লাশ করবো না। তোমরা বের হও। আমরাও বের হয়ে যেতাম। এটাই ছিল ছাত্র রাজনীতি। পরবর্তীতে ১৯৯৭-৯৮ সালে কলেজে এসে নির্বাচন করতে হয়েছিল। তবে আমার প্রতিদ্ব›দ্বী না থাকায় আমি সিলেকশন হয়েছিলাম। তারপর ব্যক্তিজীবনের ঘেরাটোপে সময় গড়িয়ে দেখতে পেলাম সমাজে তথা এই দেশের প্রতিটি মানুষ এখন এক একজন রাজনীতিবিদ। প্রত্যেকেই রাজনৈতিক স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রত্যেকেই প্রেসিডেন্ট, প্রত্যেকেই ভবিষ্যতের দেশনায়ক! কেন এমন হলো? এই প্রশ্নের জবাব কার কাছে পাওয়া যাবে?
আওয়ামী লীগের প্রত্যেক শাখার এজিএম বা প্রতিষ্ঠাবার্ষীকির আগে দলে যুক্ত হয় নতুন নতুন সদস্য। এত সদস্য কোথা থেকে আসে? কেন তারা আসছে, এই প্রশ্ন কি আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের মানুষদের মনে প্রশ্ন জাগেনি? কেউ একজন এক তোড়া ফুল নিয়ে এসে বলল আমি আওয়ামী লীগে যোগদান করতে চাই। তাহলেই কি সে আওয়ামী লীগ হয়ে যায়?
আমি জানতাম, কোন সংগঠন হচ্ছে সমআদর্শের মানুষদের সমষ্টি। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমি সেই অর্থের সাথে মিল খুঁজে পাইনা। চারিদিকে আওয়ামীলীগের এত সংগঠন, নিজেকে নিয়ে আমি বিব্রত থাকি। কারণ আমি আদর্শগত ভাবে নীতিতে বিশ্বাসী। আমি মনে করি দলের পরিচয়ে আমি পরিচিত হতে চাই না। আমার ভাল কাজই আমার দলকে গর্বিত করবে। আমার এই বিশ্বাস আমাকে এখন কোণঠাসা করে ফেলেছে। উপমহাদেশের বৃহত্তম রাজনৈকিত দল যেন আমাকে উপহাস করে বলছে ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই এতযে লোকে ভারী’।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পারলাম বাংলাদেশে আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে নিউজ করতে গিয়ে উঠে এসেছে নিবন্ধন ছাড়াও ৩ শতাধিক লীগ যুক্ত সংগঠন সক্রিয় রয়েছে বাংলাদেশে। চারিদিকে এত দল, তাহলে জনতার কাতারে বোধকরি আমি ছাড়া আর কেউ নেই!
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনারেবল পলিটিশিয়ান থাকে। তাদের সম্মানজনক ভাবে কোন একটা রাজনৈকিত দলে পদ বা পদবী প্রদান করা হয়। অথচ আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতকর্মীরা নিজেরাই রাজনৈতিক দলে নাম লেখাচ্ছেন। কারো কারো চেহারা তো রাজনৈতিক নেতাদের সার্বক্ষনিক সঙ্গী হয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। সংস্কৃতিক ব্যক্তিগণ সংস্কৃতিচর্চা ছেড়ে রাজনীতিতে বেশি মনোযোগ। তারা কে কোন স্তরের শিল্পী সেটা রেখে তারা এখন কে কোন রাজনৈতিক পদমর্যাদায় আছে সেটা প্রচার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কোন দেশের শিল্প যখন রাজনৈকিত মাপকঠিতে ব্যবচ্ছেদ হয়, তখন তা আর শিল্প থাকে না। শিল্পকে একটি দেশের আয়না বলা হয়। দেশের বর্তমান অবস্থা শিল্প চর্চার মাধ্যমে উঠে আসে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কৃতিক কর্মীদের ভয় পায়। কারন কখন কে কিভাবে নাটক, সিনেমা বা সাহিত্যের মাধ্যমে তুলে ধরবে। অথচ আমরা কি দেখতে পাচ্ছি, ঠিক তার উল্টা।
কবি-ছড়াকারগণ লেখা বাদ দিয়ে রাজনীতি করছে। সাহিত্যিক, নাট্যকার, পরিচালাক, প্রযোজক, শিল্পী সব একই অবস্থা। শিল্প-কারখানার মালিক কর, ট্যাক্স ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়ছেন। ডাক্তারগণ চিকিৎসা বাদ দিয়ে রাজনৈকিত কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশি ব্যস্ত। যার কারণে দেশের মানুষ বিদেশে যায় চিকিৎসা নিতে। শিক্ষকগণ শিক্ষায় মনোযোগ না দিয়ে রাজনৈকিত কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত আছেন। ছাত্রগণের আর দোষ কি?
গ্রাম্য পর্যায়ে রাজনীতির কুফল ঢুকে গেছে। অতীতে গ্রামের সাধারণ মানুষ গ্রাম্য প্রতিনিধি নির্বাচন করতো। এখন সেটা দলীয় পর্যায়ে হয়। একটি গ্রামের সাধারণ মানুষের রক্ষণাবেক্ষণ করতে কাকে দরকার শুধু সেই গ্রামের মানুষ জানার কথা। এখন দলীয় লোকজন এসি রুমে বসে গ্রাম্য প্রতিনিধি নির্ধারণ করেন। এখানে রাজনীতি যুক্ত হওয়ার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেলাম না।
সুযোগ সন্ধানী কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ সুযোগ বুঝে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছে। আর এসব মানুষ আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য নষ্ট করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারাই আওয়ামী লীগের লীগ বাণিজ্য করছে। তা না হলে সাধারণ মানুষের এত ক্ষমতা নেই তারা ৩ শতাধিক লীগ সর্বস্ব দল গঠন করে। শুধু দল গঠন করেই ক্ষ্যান্ত দেয়নি। এইসব অঙ্গসংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, জাতীয় দিবসগুলো পালন করার জন্য চাঁদাবাজি করা হয়। সাধারণ মানুষ যারা কোন রাজনীতির মধ্যে নেই, তেমন নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষজন চাঁদাবাজির ভয়ে তটস্ত থাকে।
আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া একটি দল। তারই নাম ভাঙ্গিয়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি চলছে। প্রতিনিয়তই বেরিয়ে আসছে দলটির কোন না কোন শাখার দুর্নীতির খবর। ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। তাহলে কি এই দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতারা ঘুমিয়ে আছেন? তারা কি চোখে সানগ্লাস আর কানে এয়ারফোন গুঁজে আছেন?
আপনাদের বলছি, যারা দলের বিশেষ পদ ও পদবীতে বসে আছেন। আপনারা দল করে পদ ও পদবী পেয়েছেন। কিন্তু যারা প্রকাশ্যে মুজিব কোট পরে দল করেন না, নিভৃতে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর দলের আদর্শ লালন করে, বিনিময়ে কোন কিছু পাওয়ার আশা না করেই। তাদের বিশ্বাস এবং আদর্শকে এভাবে ক্ষুণ্ণ হতে দিতে পারেন না। প্লিজ আপনারা ঘুম থেকে উঠুন।
দেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছানোর জন্য দরকার সাধারণ মানুষের মানবিক উন্নয়ন। দেশের মানুষকে রাজনীতি নামক শব্দটির অপব্যাখ্যা থেকে মুক্ত করুন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগের আদর্শ রক্ষা করুন প্লিজ।
লেখক : নাট্যকার, পরিচালক, সাংবাদিক।
এইচআর/জিকেএস