ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

চীনে মুসলিমদের কোরবানি ঈদ পালনের রীতি

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ২৫ জুলাই ২০২১

অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, চীনে কি ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে? ওখানে কি মুসলিমরা নিজেদের ধর্ম পালন করতে পারেন? উইগুরদের নিয়েও অনেকে প্রশ্ন করেন। তারা কেমন আছে, কি ব্যাপার। এসব প্রশ্নের মধ্যে আজকে আমি উত্তর দিতে চাচ্ছি চীনে মুসলিমরা কিভাবে ঈদ পালন করেন সে বিষয়ে। যেহেতু মাত্র কোরবানির ঈদ পার হলো, তাই চীনের মুসলিমদের ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ প্রসঙ্গে বলতে চাই।

চীনে তিন থেকে চার কোটি মুসলিম রয়েছেন। প্রতিবছর চীন থেকে অনেক মুসলিম হজ পালন করতে সৌদি আরবে যান। তবে গত দু বছর করোনা মহামারির কারণে সৌদি আরবে সীমিত পরিসরে হজ হওয়ায় হজে যেতে পারেননি তারা। চীনে ঈদ উদযাপিত হয় সৌদির সঙ্গে একই তারিখে। চীনে ৫৬টি জাতির মানুষ বাস করেন। তাদের মধ্যে ১০জাতির মানুষ ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করেন। বিশ্ব মুসলিম উম্মার সঙ্গে একই ভাবে এবং একই রীতিতে তারা কোরবানি দেন এবং ঈদ পালন করেন। তবে তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক রীতিনীতিও অনুসরণ করেন। এই দশ জাতির মানুষ সুন্নি মুসলিম।

চীনের যে দশটি জাতি ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করেন তারা হলেন হুই, উইগুর, কাজাখ, তাজিক, কিরগিজ, উজবেক, তুংসিয়াং, পাও’আন,সালার, তাতার। মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক হুই জাতির। দ্বিতীয় স্থানে আছেন উইগুররা। হুই জাতির মুসলিম ছড়িয়ে আছেন চীনের সব প্রদেশ ও অঞ্চলে। বিশেষ করে নিংসিয়া, কানসু এবং ছিংহাই প্রদেশে। ইউননান প্রদেশেও অনেক হুই মুসলিম রয়েছেন। আর বেইজিং শহরেও হুই মুসলিম আছেন প্রচুর। তারা রয়েছেন সাংহাই, ছোংছিং, কুয়াংচৌসহ চীনের সব বড় শহরেই। উইগুররা বেশিরভাগ বাস করেন স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল সিনচিয়াংয়ে। সেখানে প্রধান শহর উরুমছি। রয়েছে কাশগরের মতো প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শহরও।

চীনের প্রতিটি বড় শহরেই রয়েছে মসজিদ। রয়েছে হালাল রেস্টুরেন্ট। বলতে গেলে চীনের বড় শহরগুলোতে যেখানেই দশ-পনেরোটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে সেখানেই একটি বা দুটি হালাল রেস্টুরেন্ট আছে। চীনের মুসলিমদের অনেকেই কোরবানি ঈদে পশু কোরবানি করেন। আবার যারা হয়তো কোরবানি করছেন না তারা হালাল মাংসের দোকান থেকে মাংস কিনে আনেন।

বেইজিংয়ের একটি বিশাল এলাকা হলো নিয়োচিয়ে। নিয়োচিয়ে শব্দের অর্থ হলো গরুর রাস্তা। তার মানে এইখানে গরু জবাহ হয় এবং এখানে হালাল মাংসের দোকান রয়েছে। এই এলাকায় বেইজিংয়ের সবচেয়ে পুরনো মসজিদ ‘নিয়োচিয়ে মস্ক’ অবস্থিত। এই মসজিদ হাজার বছরের প্রাচীন। নিয়োচিয়ে এলাকায় বাস করেন দশ-পনেরো হাজার মুসলিম। এরা বেশিরভাগ হুই জাতির।

নিয়োচিয়ে এলাকায় বেইজিংয়ের প্রধান ঈদের জামাতও অনুষ্ঠিত হয়। ঈদের নামাজের পরপরই কোরবানি দেয়া হয়। পশু কোরবানি করার নির্দিষ্ট স্থান আছে। সেখানে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে কোরবানি করা হয়। এখানকার রেস্টুরেন্টগুলোতে মুসলিমদের তো বটেই অমুসলিমদেরও ভিড় জমে থাকে। কারণ এখানকার রান্না খুব সুস্বাদু। পাওয়া যায় নান রুটি, শিককাবাবসহ নানা রকম খাবার যা বিশেষ করে মুসলিম বাবুর্চিরা রান্না করতে জানেন।

বেইজিংয়ে প্রতিবছরের মতো এবছরও ২০ জুলাই ঈদের দিন জামাতে নামাজ পড়েছেন মুসলিমরা।কোরবানিও করেছেন অনেকেই। যারা কোরবানি দিতে পারেননি তারা নিয়োচিয়ে থেকে হালাল মাংস কিনে নিয়ে গেছেন।

চীনের বিভিন্ন প্রদেশে যেখানেই মুসলিম বসতি রয়েছে সেখানেই একই নিয়ম। ঈদের নামাজের পর কোরবানি করা হয়। চীনে ছাগল,ভেড়া, দুম্বা, গরু কোরবানি বেশি প্রচলিত। তবে সিনচিয়াংয়ে ভেড়া ও উটের সংখ্যা বেশি বলে, ভেড়া এবং উটই বেশি কোরবানি দেয়া হয়। অধিকাংশ পরিবার ভেড়া কোরবানি করে।

সিনচিয়াংয়ের প্রধান শহর উরুমছিতে অনেক মসজিদ। গ্র্যান্ড বাজার মসজিদ কমপ্লেক্সে প্রধান ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। কাশগরের প্রাচীন ও বিখ্যাত প্রধান মসজিদের ঈদ জামাতও বিখ্যাত। পনের দিন আগে থেকেই ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয় উইগুর মুসলিমদের মধ্যে। মসজিদ ধোয়া মোছা করে নতুনভাবে সাজানো হয়। এসব খরচ বহন করে স্থানীয় সরকার।

প্রতিবছরের মতো এবছরও সিনচিয়াংয়ের বিভিন্ন মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন পোশাক পরে দলে দলে মসজিদে গেছেন নারী ও পুরুষ মুসল্লিরা। ঈদের নামাজে নারীরাও অংশ নেন তবে পৃথক সারিতে দাঁড়ান তারা। ঈদে সব জাতির মুসলিমরাই নতুন কাপড় পরেন। তারা নিজের নিজের জাতির ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে থাকেন। এদিন তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন। কোথাও কোথাও ঈদের মেলাও বসে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে।

কোরবানির পশু বিশেষ করে ভেড়া, দুম্বা ও ছাগলের মাংস দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন খাবার। সিনচিয়াংয়ে ঈদের দিনে বাড়িতে বাড়িতে রান্না হয় ‘সিনচিয়াং রাইস পোলাও’। এটি মূলত কাচ্চি বিরিয়ানি ধরনের। মাংস ও সবজির মিশেলে তৈরি বিরিয়ানি বলা চলে একে। আরেকটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো সিনচিয়াং নুডুলস যার অন্য নাম লাহমান। ভেড়ার মাংসের বিশেষ ডিশ রয়েছে যা ঝোল যুক্ত এবং খুব সুস্বাদু। ঈদ উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন উইগুররা। এতে বিশেষ এক ধরনের নাচ পরিবেশন করেন তারা। মসজিদের কাছাকাছি ঈদ মেলা বসে বিভিন্ন শহরে।

হুই এবং অন্যান্য জাতির মুসলিমরাও তাদের ঐতিহ্যবাহী খাদ্য তৈরি করেন। চীনে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে মূল কথা হলো, এখানে ধর্মে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীরা পরষ্পরের মূল্যবোধকে সম্মান করেন। ধর্মে অবিশ্বাসীরাও লোকজ প্রথা, রীতিনীতি মেনে চলেন। ধর্মীয় স্থাপনাসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সরকারী খরচে ও উদ্যোগে মেইনটেইন করা হয়।

চীনে আমি নিজে অনেকবারই ঈদ পালন করেছি। কোথাও ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে দেখিনি।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস