ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আজ যে নিপীড়ক কাল সে ধর্ষক

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:২৬ এএম, ২৩ জুলাই ২০২১

তাহিয়াতুল জান্নাত

তখন কেবল মাঠ পর্যায়ে দু তিনজন ভলান্টিয়ার নিয়ে কাজ করছি। এই মাঠে বসে, ওই উঠোনের কোণায়, সেই গাছতলায় বসে বা দাঁড়িয়ে অভিভাবক ও কিশোরীদের মাঝে যৌন হয়রানি,বাল্যবিয়ে এবং মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলি। কখনোবা ঘা ঘুতো, দু চারটে বাজে কথা শুনি, কখনোবা ভালবাসা স্নেহ পাই। এক সভা শেষে হঠাৎ পাশের বস্তিতে বেড়ে ওঠা কিশোরী সাথী (ছদ্মনাম) খুব ভয়ে-ভয়ে, লজ্জায়-লজ্জায় বলল, আপু আমাদের স্কুলের এক স্যার ক্লাশে এসেই বলেন, আমাকে দেখে কারো ভয় লাগলে বুকের বোতাম খুলে বুকু থুথু দিবা। কথাটা খুব নোংরা করে বলেন। শুনলে আমাদের লজ্জা লাগে তাই ওই স্যারের ক্লাশ কম করি, আবার ক্লাশে মাঝে মাঝে আমাদের পিঠে ,আর হাতের মাশেলে হাত দেন, বেত থাকলেও পিঠে হাত দিয়ে মারেন খুব খারাপ লাগে এভাবে সবার গায়ে হাত দিলে। আমার এক বান্ধবীতো এই স্কুলই ছেড়ে দিছে।

শিক্ষকের বিরুদ্ধের প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে কঠিন একটা পদক্ষেপ কিন্তু আমরা নিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু শিক্ষকদের এই পিঠে হাত দিয়ে ব্রার স্ট্রাইপ মেপে নেয়াটা বন্ধ হয়েছে কি আদৌ? নারীকে অস্পৃশ্য বলছি না, আমাদের গায়ে হাত রেখে আমাদের কম্ফোর্টজোনের অনেকেই কথা বলেন,বলতেই পারে। আমাদের অনেক শিক্ষক, অনেক কাকা মামা আমাদের পিঠে বা কাঁধে হাত রাখেন বা রখতেই পারেন।

কিন্তু দেখুন একজন নারী বা কিশোরী,সে কিন্তু ঠিক বোঝেন কোন মানুষটা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমাদের গায়ে হাত রাখছেন। এবং প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সম্ভবত এমন কোনো না কোনো পিশাচের সন্ধান মেলে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর কথা কিশোরী ও নারীরা পরিবার ও মার্কসের ভয়ে কখনই মুখ খুলতে চায় না। এমনকি মুখ খোলার মত নির্ভরশীল কাউকে পাশেও পায় না। ফলাফল নিপীড়িত শিক্ষাজীবন।

আরেকটা ঘটনা বলি, আমি তখন জেলার প্রাইমারি আর হাই স্কুলগুলিতে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করছি। রাত ৯ টার দিকে একটা কল এলো, 'আপু আপনি কি রেমি আপু, আমি প্রভা (ছদ্মনাম) । আমার খুব বড় একটা বিপদ আপু, প্লিজ আপনি আমাকে বাঁচন।' আমি প্রভার সাথে কথা বললাম প্রায় একঘন্টা। প্রভা ফরিদপুর এক সনামধন্য স্কুলের শিক্ষার্থী ,বাবা মা দুজনই স্কুল শিক্ষক। প্রভাকে যিনি বাসায় গণিত পড়ান তিনি ওর বাবার পুরানো বন্ধু এবং কলিগ। গাঁয়ে কাঁটা দেবার মত সত্য এটাই যে বাবার বন্ধু এবং গণিতের শিক্ষক সুযোগ পেলেই মেয়েটির সারা শরীরে হাত বোলান। যেদিন মেয়েটি আমাকে কল করেছিল ঠিক তার আগের দিন সন্ধ্যায় ওর বাবা মা ওকে স্যারের কাছে পড়তে দিতে পুজোর বাজার করতে যায়।

হ্যাঁ পুরোনা বন্ধু এবং কলিগের ওপর তাদের পরম ভরশা থাকলেও সেদিন সন্ধ্যায় কিন্তু একজোড়া নোংরা হাত থেকে মেয়েটিকে বাঁচানো যায়নি। সবচেয়ে দুঃখজনক সত্য এটাই প্রভা আমাকে ফোন করে ওর মায়ের কাছে এই কথাগুলো জানানোর জন্য। মাকে বহুবার স্যারের কাছে না পড়তে চাওয়ার কোনো সমাধান হয়নি তার। তাই সে বাধ্য হয়ে আমাকে সব খুলে বলে। প্রভাকে শেষমেশ ঐ নিপীড়কের হাত থেকে বাঁচানো গেলেও সম্মান ও বাবার স্বার্থে নিপীড়কের কোনো শাস্তি হয়নি।

প্রভা , সাথী বা এমন হাজার হাজার কিশোরী আমাদের দেশে আছে যারা তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নিপীড়নের কথা কারো কাছে বলতে পারে না। পরিবার তাকে সমর্থন করে না। অনেক কিশোরী জানিয়েছেন তারা তাদের মায়ের কাছে এমন ঘটনা শেয়ার করলে তাদের শুনতে হয়,কই আমার সাথে তো কেউ এমন করে নাই, আমার গায়ে তো কেউ ধাক্কা দেয় নাই, আমাকে তো কেউ কখনো ব্যাড টাচ করে নাই। তুমি খুব বড় হয়ে গেছো, নিজের খালুকে নিয়ে এমন বাজে কথা বলতে কে শিখিয়েছে তোমাকে!

এইযে একটা দূরত্ব আমাদের পরিবারের সাথে আমাদের কিশোরীদের। এই দেয়ালটা, এই বোঝাপড়ার ঘাটতিটা আমাদের দিনের পর দিন পিছিয়ে দিচ্ছে। সমীক্ষায় বার বার বলছে যৌন হয়রানির ৭৫ শতাংশ পরিবার ও ঘনিষ্ঠ জনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের পরিবার আমাদের কথা বিশ্বাস করছে না তারা তাদের জীবন দিয়ে আমাদের জাজ করে পুরো ব্যাপারগুলি ধামাচাপা দেয়ার সংস্কৃতি চলমান রাখছে।

সমাজে নারীদের অবস্থান যদি এমন হয় সেক্ষেত্রে পুরুষের প্রতি সহিংসতার কথা মন থেকে বাহির না হয়াই ভাল। সম্মীক্ষায় এসেছে , প্রতি ১০ জন পুরুষের মাঝে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হন। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব,সামাজিক ও আইনগত বিচার বিশ্লেষণ করে সত্যিকার অর্থে এখনো কোনো পুরুষ তার প্রতি নিপীড়নের কথা প্রকাশ্যে বলতে পারার মত মানসিকতা বা সামাজিক অবস্থানে তৈরি করতে পারেননি। তাই বলে সহিংসতা বৃদ্ধির হার নিন্মমুখী নয়।

একটি পাঁচ সাত বছরের শিশু অনেক সময়ই বোঝে না তার প্রাইভেট বডি পার্ট কোনগুলি। হরহামেশাই সেই বিভিন্ন জনের কাছে অনিরাপদ স্পর্শের শিকার হয়। খেলতে খেলতে শিশুটি বড় হলেও তার মনের মধ্যে সেই ঐ স্পর্শগুলি গভীরভাবে দাগ কেটে থাকে। গবেষণা বলে প্রতি ৪ জন কন্যা শিশুর মধ্যে একজন অনিরাপদ স্পর্শের সম্মুখীন হয়। ছেলের মায়েরা নিশ্চিন্ত হবার কারণ নাই, প্রতি ৬ জন পুত্র সন্তানের মধ্যে একজন অনিরাপদ স্পর্শের সম্মুখীন হয়।

এখন অনেই কপাল কুঁচকে বলবেন, আপনি কখনো আনসেইফ টাচ ফেইস করেন নাই। সেটা অবশ্যই বিশ্বাস করতে চাই আমরা কিন্তু সত্যিই কি ফেইস করেন নাই, নাকি নিজেকে সকলের কাছে পবিত্র বলে দবি করতে মিথ্যা বলছেন সেটা আপনি নিজেকে প্রশ্ন করে, সন্তানের যত্ন নিন।

আপা, ভিড়ের মধ্যে অচেনা কেউ যদি আপনার স্তন মর্দন করে তাতে আপনার পবিত্রতা নষ্ট হয় না। পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ কেউ সুযোগ খুঁজে আপনাকে নিপীড়ন করলেও আপনার পবিত্রতা নষ্ট হয় না। তবে এসকল বিষয়কে আপনি জাস্ট একটা নর্মাল ইস্যু হিসেবে ভেবে নিয়ে পুরো ঘটনাটা ইগনোর করে নিজেকে পবিত্র হিসেবে জাহির করতে যেভাবে হিপোক্রিটের মত বলেন, ' না না আমি কখনো হ্যারাস হই নাই। সুযোগই দেই নাই, সুযোগ দিলেই তো মেয়েরা হ্যারাস হয়।'

এই মিথ্যাটা বাকি দশজন নারীর ভয়েস রেইজ করতে বাধাপ্রাপ্ত করে। আর বিশজন পুরুষের মনে একথাই গেঁথে দেয় যে , 'সুযোগ পেলেই হ্যারাস করা যায়'। কিন্তু আপনার এই মনোভাব এবং কপটতা নিপীড়নের শিকার হওয়া নারীদের মনে একটা আবছা বিশ্বাস এনে দেয় আর হয়তো তারা নিজেদের অপরাধীও ভেবে বসে। তাদের মনেও একটা খোঁচা লাগে, তাহলে কি 'আমি কোন সুযোগ দিয়েছিলাম বলে, বাসের মধ্যে লোকটা আমার শরীরে হাত দিয়েছিল?'

আমার পরিবর্তনটা কোথায় দরকার জানেন? সত্য প্রকাশে। আমরা সত্য শিকার করতে চাই না, শরীর এবং মনকে এক করে ফেলি। যদি কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হয় তাহলেই তাকে আমরা দুঃশ্চরিত্রা বলি আর যদি কোনো নারী মিউচুয়ালি সহবাস করে তখন তাকে আমরা চরিত্রহীন বলি অর্থাৎ তাদের দুজনের চরিত্র বিশ্লেষণের শব্দদুটি একই থাকে। আমরা যৌন নিপীড়নের মত ঘটনাগুলিকে খুব নর্মাল করে ফেলি ভিকটিমের পোশাক, চলাফেরা বা পারিবারিক শিক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে আমরা ভুলেই যাই আজ যে নিপীড়ক কাল সে ধর্ষক।

আমাদের দেশটা ঠিক সেইদিন ই নারীবান্ধব হয়ে উঠবে যেদিন থেকে প্রভার মত কিশোরীরা তার পরিবারের কাছে সকল কথা শেয়ার করার মত পরিবেশ পাবে এবং পরিবার তাকে সাপোর্ট করবে। আমাদের সমাজ যখন আর নিপীড়নের পক্ষে, ভিকটিমের স্লিভলেস নিয়ে পড়ে থাকবে না, কেবল নিপীড়নের কারণ হবে নিপীড়ক।
সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষা বইয়ের ব্যায়াম ও পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি বয়ঃসন্ধিকাল ও মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লেখা অধ্যায়গুলিও গুরুত্বের সাথে পাঠদান করতে হবে। কিন্তু কবে আমরা নারীদের চলাফেরা, জামাকাপড়, চিন্তাভাবনা দিয়ে যৌন সহিংসতা বা ধর্ষণ এর মত অপরাধকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করার মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে পারবো? সেই পথটা কি আমাদের আদৌ চেনা আছে?

লেখক : নারী ও শিশু উন্নয়নকর্মী|

এইচআর/এমএস