কোভিড পরিস্থিতি, জনউদাসীনতা এবং আসন্ন ঈদ
কোনোরকম ভূমিকা না দিয়েই বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আমরা কোভিড-১৯ নিয়ে চরম এক সংকটজনক অবস্থায় নিপতিত হয়েছি। আক্রান্তের হার দিনকে দিন বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে মৃত্যুও। বিভিন্ন হাসপাতালে কোভিড শয্যাগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। এখন রোগী মেঝেতে রাখতে হচ্ছে। যশোরে দেখলাম হাসপাতালের ভেতরের মেঝেতেও তাৎক্ষণিকভাবে শয্যা না পেয়ে রোগীকে গাছতলায় রেখে চিকিৎসা শুরু করতে হয়েছে। আক্রান্তের হার গড়ে ৩২ শতাংশ । তবে, বিভিন্ন জায়গায় এ হার ৭০ শতাংশ অবধি পৌঁছেছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।
বস্তুত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঈদুল ফিতরে প্রচুর সংখ্যক মানুষ বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়ার সময়েই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিলো। সে কথা মাথায় রেখেই জনসাধারণকে নিজ নিজ জায়গায় থাকতে অনুরোধ করা হয়েছিলো।কিন্তু কেউ কথা শোনেননি। নিজের মত মতোই বাড়ি গিয়েছেন।আর পরিবারের জন্য শুধু ঈদ করার আবেগ ও খুশি সাথে করে নিয়েছেন তো বটেই সেই সাথে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন করোনার জীবাণু। অন্যদিকে এর সাথে যুক্ত হয়েছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। ফলে, কোভিড পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। কিন্তু জনগণের মধ্যে এ নিয়ে কি কোনরকম সচেতনতা বা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে? অবস্থাদৃষ্টে অন্তত তা মনে হচ্ছে না।
করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু বৃদ্ধি দেখেও জনগণের মাঝে ন্যূনতম সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না এটা পরিষ্কার। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। করোনা প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় যে উপায়-মাস্ক পরা সেটাও তারা করছেন না। অথচ এই সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য দেশব্যাপী লকডাউন চলমান রয়েছে। প্রয়োজনে মানুষ বাইরে বের হতে পারবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে-সে ব্যবস্থাও লকডাউনে রাখা হয়েছে। আছে জেল জরিমানারও বিধান। তারপরও মানুষ শুধু লকডাউন দেখতে রাস্তায় বের হচ্ছেন— ভাবা যায়?
যে কোন মহামারি ঠেকানোর উপায় দুটো-এটা আমরা হয়ত সবাই কম-বেশি জানি। প্রথমত- স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। দ্বিতীয়ত- টিকা নিতে হবে। কিন্তু এ দুটো কাজই সফলভাবে করা সম্ভবপর হযে ওঠে মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে।শুধুমাত্র লকডাউনের মতো বিধিনিষেধ দিয়ে মহামারি নির্মূল সম্ভব নয়। সত্যিকার অর্থে আমাদের জনসচেতনতার কাজটি আমরা করতে পারিনি বলেই কোভিড পরিস্থিতি আজকে এতটা খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুতরাং প্রশাসনিক পদক্ষেপের সাথে সাথে জনসচেতনতার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত বলে আমার মনে হয়।এজন্য যা যা করণীয় তা করতে হবে।
কোভিডের এরকম একটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেই এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ঈদুল আজহা পালিত হবে। কোরবানির পশু কেনাকাটার জন্য মানুষ হাটে যাবে। বিশেষ করে গ্রাম এবং জেলা শহরগুলোতে।তারা অনলাইনে পশু কিনতে খুব বেশি উৎসাহী হবে বলে মনে হয় না।এরপরে আছে সে পশু জবাই থেকে শুরু করে বিলিবন্টনের বিষয়। ফলে পশুর হাট থেকে শুরু করে জবাই, মাংস প্রসেসিং, বিলিবন্টন সবকিছু মিলিয়ে রীতিমতো একটা কর্মযজ্ঞ চলবে গ্রাম ও শহরে। এর সাথে শুরু হবে মানুষের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি। এবারও যদি মানুষের গ্রামে যাওয়া ঠেকানো না যায় তাহলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে তা ভাবতেও ভীষণ ভয় হচ্ছে। ফলে এ নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে এখনই।
এ অবস্থায় আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ দুইটা। প্রথমত-মানুষকে তার নিজের জায়গায় থাকতে উদ্বুদ্ধ করা। দ্বিতীয়ত-পশুর হাটগুলোতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশু বেচাবিক্রির ব্যবস্থা করা। একই সাথে জনগণের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে, মহামারি গরীব বা বড়লোক বিচার করে আক্রান্ত করে না। গত ১ বছরে এই রকম একটা ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে,করোনা গরীবের হয় না।
এটা বড়লোকের রোগিএখন বলব, যা ভেবেছেন এত দিন ধরে তা তো ভেবেছেনই। এখন নিজেকে একটু প্রশ্ন করুন , গ্রামে ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে এই যে মানুষ মারা যাচ্ছেন তারা কি সবাই বড়লোক? যশোর, খুলনা, রাজশাহী, সাতক্ষীরাসহ দেশের নানা জেলা ও থানা মিলিয়ে ৭ জুলাই এ ২০০ এর অধিক মানুষ মারা গেছেন। এরা কারা? আসুন নিজের বিবেককে আমরা একবার হলেও এ প্রশ্নটি করি।দেখুন আপনার বিবেক কি বলে?
পরিশেষে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে অনুরোধ থাকবে কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং টিকাদান কাজকে সার্থক করে তোলার জন্য স্থানীয় মানুষ, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাও কর্মী, ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গকে সাথে নিয়ে জনসচেতনতার কাজটা শুরু করুন। মসজিদের মাইকগুলো থেকে সচেতনতা, নির্দেশনার কাজটা ধর্মীয় বয়ানের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে করুন। জনপ্রতিনিধে, রাজনীতিবিদরা তাদের কাজটুকু করুন। গরীব মানুষদের পাশে খাদ্য সহায়তা নিয়ে দাঁড়ান। জনসচেতনতার জন্য যা যা করা উচিত সবগুলো ফ্রন্টকে এখন কাজে লাগান। কারণ জনগণ সচেতন না হলে কিন্তু সবচেষ্টা পণ্ডশ্রম হয়ে যাবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ এনাম মেডিকেল কলেজ, সাভার।
এইচআর/জেআইএম