ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বেজার যেন না হয় ঘরের যৈবতি

মোকাম্মেল হোসেন | প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ১৬ জুলাই ২০২১

নাকে-মুখে খাচ্ছি। ডালের বাটি এগিয়ে দিতে দিতে লবণ বেগম বলল-
: আস্তে খাও। গলায় ভাত ঠেইকা মরবা তো!
খাওয়ার কাজটা ধীরেসুস্থেই শুরু করেছিলাম। এ সময় আলাল-দুলালের কথায় আউলা লেগে গেল। ফোন করে আলাল বলল-
: তুমি কই?
: বাড়িতে।
: আমাদের বাজারে আসতে বইলা তুমি বাড়িতে বইসা রইছ?
দুলাল বলল-
: তুমি বাড়িতে কী কর?
: ভাত খাইতেছি।
: অহনও খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে আছ- গরু কিনবা কখন?
কোরবানির গরু কিনতে আজ আমার অষ্টধার বাজারে যাওয়ার কথা। বন্ধু আলাল ও দুলালকে সাহায্যকারী হিসেবে সঙ্গে থাকার অনুরোধ করেছি। তারা এত তাড়াতাড়ি বাজারে পৌঁছে যাবে ভাবিনি। আলাল পুনরায় বলল-
: খাওন-দাওন সাইডে রাইখা দৌড় দেও। নইলে পরে পস্তাবা।
আলালের কথা শোনার পর ভাতের থালা একপাশে রেখে দৌড় দেয়া উচিত। এ মুহূর্তে সেটা সম্ভব নয়। সকালে নাস্তা না করেই মুক্তাগাছা গিয়েছিলাম। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে খেতে বসেছি। লবণ বেগম সামনে থাকায় খাবারগুলো দ্রুত পেটে চালান করতে বিঘ্ন ঘটছে দেখে তার উদ্দেশে বললাম-
: তুমি ফোন কইরা যা যা আনতে বলছিলা, সব আনছি।
: কই রাখছ?
: আমার ব্যাগের সামনের পকেটে আছে।
লবণ বেগম উঠে গেল। এই ফাঁকে খাওয়া শেষ করলাম। এরপর হাত ধোয়ার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়েছি, ঠিক তখন ঘর থেকে লবণ বেগমের চিৎকার ভেসে এল। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই লবণ বেগম বিস্ফোরিত চোখে বলল-
: হোয়াট ইজ দিস?
নিরীহ গলায় উত্তর দিলাম-
: বলপেন।
: আমি কি তোমারে বলপেন আনতে বলছিলাম?
: কী আনতে বলছ?
: তুমিই বল- কী আনতে বলছিলাম!
: এতে বলাবলির কী আছে! তুমি যা যা আনতে বলছ; তাই আনছি।
: উহু। তুমি অবশ্যই তা আননি। আমি তোমারে আনতে বলছি ভ্রু পেন আর তুমি আনছ বলপেন!
: ভ্রু পেন?
: হ, ভ্রু পেন। মানুষের চোখের ওপরে যে দুইটা ভুরু আছে- এইটা জান তো?
: জানব না কেন? জানি।
: সেই ভুরুতে ব্যবহার করার জন্য এক ধরনের কলম পাওয়া যায়। এইটারে ভ্রু পেন বলে।
: অ।
এরপর লবণ বেগম অন্য একটা জিনিস হাতে নিল। সেটা চোখের সামনে ধরে জানতে চাইল-
: এইটা কী আনছ?
: লিপ লাইনার।
: ব্যাগে ভরার আগে জিনিসটা একবার নাকের কাছে নিছিলা?
: নাকের কাছে নেওন লাগব কী জন্য?
: আহা নিছিলা কিনা, সেইটা বল?
: না, নেই নাই।
: এই নেও, নাকের কাছে ধইরা দেখ- কী পচা গন্ধ!
অবাক হয়ে বললাম-
: পচা গন্ধ মানে! দোকানদাররে বলছিÑ সবচাইতে ভালোটা দেন। দোকানদার বলছে, এইটা বেস্ট। বিশ্ববিখ্যাত জর্ডানা কোম্পানির মাল। ওইটার গায়ে কোম্পানির নাম লেখা আছে দেখ।
: লেখা থাকলেই হইয়া গেল? আমি একটা সাদা কাগজে এক হাজার টাকা লেখলেই সেইটা এক হাজার টাকার নোট হইয়া যাবে?
চুপচাপ তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ থুম ধরে বসে থাকার পর মুক্তাগাছা থেকে কিনে আনা জিনিসগুলো সশব্দে টেবিলের ওপর রেখে বলল-
: বুঝছি! তোমার প্রতি মায়া দেখাইয়া কোনো লাভ নাই। চল আমার সঙ্গে...
: কোথায়?
: শহরে।
: এখন শহরে গেলে গরু কিনব কখন?
: আগে আমার কেনাকাটা শেষ করবা; তারপর গরু-উট যা খুশি কিনবা।
নৌকাডুবির পর সাঁতার না জানা কোনো মানুষ সামনে যা পায়, সেটাই আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। আমিও তাই করলাম। বললাম-
: এই এলাকায় আজই গরু-ছাগলের শেষ হাট।
: আগামীকাইল বিদ্যাগঞ্জের হাট আছে।
: গরু কিনতে এতদূরে যাব!
: মানুষ গরু কেনার জন্য নদী পার হইয়া সিরাজগঞ্জ চইলা যাইতেছে; আর তুমি বিদ্যাগঞ্জে যাইতে পারবা না?
মহাফাঁপরে পড়লাম। হুকুম পালন না করলে লবণ বেগম বেজার হবে। আবার আলাল-দুলালকে ডেকে আনার পর যদি অষ্টধার বাজারে না যাই, তাহলে তারা বেজার হবে। কী করব- এটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছি। লবণ বেগম বলল-
: কী হইল! যাবা না?
এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হওয়া উচিতÑ না; কিন্তু সংসারে অশান্তি যাতে কম হয়, এ ব্যাপারে প্রত্যেক বিবাহিত পুরুষের যতœশীল হওয়া উচিত। লবণ বেগমকে শুনিয়ে শুনিয়ে আবৃত্তি করলাম-
আলালের বেজারে আমার হইব কী?
দুলালের বেজারে আমার হইব কী?
বেজার যেন না হয় ঘরের যৈবতি।
আন আমার জামা, আন আমার জুতা
অক্ষরে অক্ষরে পালন করব যৈবতির কথা।
লবণ বেগমকে নিয়ে শহরে যাওয়ায় অষ্টধার বাজারে যাওয়া হলো না। পরদিন প্রতিবেশী হারেজ আলীকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যাগঞ্জ বাজারে গেলাম। গরু কিনতে কিনতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। গরুর মূল্য পরিশোধের পর চা-নাস্তা খেয়ে হারেজকে বললাম-
: বিসমিল্লাহ বইলা তুমি গরু লইয়া হাঁটা দেও। আমি ট্রেনে পিয়ারপুর যাই। তারপর ওইখান থেইকা বাড়িতে যাব।
বাড়ি পৌঁছে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেছি- এমন সময় হারেজের ফোন পেলাম। বললাম-
: কী খবর হারেজ? কোন পর্যন্ত আসছ?
ফ্যাকাশে গলায় হারেজ বলল-
: নিমতলা বাজারে আছি।
: আলহামদুলিল্লাহ। পা চালাইয়া আইসা পড়।
: ভাইজান...
: কিছু বলবা?
: হ।
: কও।
: একটা ঘটনা ঘইটা গেছে!
: কী ঘটনা?
: নিমতলা বাজারে পৌঁছার পর রেললাইন পার হইতেছিলাম; এমন সময় একটা ট্রেন...
: কও কী! গরু কি ট্রেনের নিচে কাটা পড়েছে?
: না।
: তাইলে?
: ট্রেনের শব্দ শুইনা গরু লাফ দিয়া আমার হাত থেইকা ছুইটা গেছে। পিছনে-পিছনে অনেকক্ষণ দৌড়াইছি ভাইজান, ধরতে পারি নাই।
: আশপাশে খোঁজ-খবর নেও নাই?
: পুরা এলাকা চইষ্যা ফেলছি ভাইজান; কোনো লাভ হয় নাই।
এবার আর ভাতের মায়া করলাম না। একটা ভ্যানগাড়ি জোগাড় করে দ্রুত নিমতলা বাজারে পৌঁছলাম। হারেজ আলী রেললাইনের পাশে নির্বাক হয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তাকে কান্না থামানোর নির্দেশ দিয়ে বললাম-
: কান্নাকাটি কইরা কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। কান্না বন্ধ কর।
আকাশে জিলহজ মাসের অপূর্ণ চাঁদ। চপলা নারীর ন্যায় ভেসে বেড়ানো মেঘমালা একটু পরপর সেই চাঁদকে ভালোবাসার চাদরে ঢেকে দিচ্ছে। আধো আলো-আধো ছায়ার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া চারপাশের রহম্যময় পরিবেশে হারিয়ে যাওয়া গরুটিকে খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ হারেজ আলী বলল-
: ভাইজান! মাইকিং করলে কেমন হয়?
নিমতলা বাজারে মাইকের কোনো দোকান নেই। একজন বলল-
: মাইক পাইতে হইলে মুক্তাগাছা যাওন লাগব।
আধামাইল সামনে এতিমখানায় মাইক পাওয়া গেল। পয়সাকড়ি দেওয়ার কথা বলায় তারা মাইক দিতে রাজি হলো। মাইকে কী বলতে হবেÑ তা একটা কাগজে লিখে হারেজের হাতে দিলাম। টর্চের আলোয় লেখাগুলো দেখতে দেখতে হারেজ বলতে লাগল- ভাইসব, ভাইসব। একটি মাঝারি আকারের ষাঁড় হারানো গিয়াছে। ষাঁড়টির গায়ের রঙ টকটকা লাল। দুই দাঁত। কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি ষাঁড়টির সন্ধান পাইলে ০১৫৫… নম্বরে ফোন কইরা জানানোর অনুরোধ করছি। ভাইসব, ভাইসব...
মাইকিং করতে করতে অগ্রসর হচ্ছি- বয়স্ক এক ব্যক্তি হাত তুলে ভ্যানগাড়ি দাঁড় করালেন। তারপর বললেন-
: কখন হারাইছে?
লোকটার প্রশ্নের উত্তর দিল হারেজ। বলল-
: এশার আজানের একটু আগে।
মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে মুরুব্বি বললেন-
: ভালো লোকের হাতে পড়লে গরু ইনশা আল্লাহ ফেরত পাবেন। আর যদি কোনো দুষ্টুলোকের হাতে পড়ে, তাইলে ওইটার গোশত মুক্তাগাছার কোন হোটেলে রান্না হবে- সেইটা আল্লাহপাক ছাড়া আর কেউ জানে না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে যাওয়ার পর তিনি পুনরায় বললেন-
: আপনেরা গরুর খাজনা উশুল করেন নাই?
এবার কথা বললাম আমি। মাথা নেড়ে জানালাম-
: করছি।
: ইজারাদার খাজনা উশুলের যে কাগজ দিছে, তাতে গরুর মালিকের নাম-ঠিকানা লেখা নাই?
গরু নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় যাতে কোনোরকম ঝামেলা না হয়, সে জন্য খাজনা আদায়ের কাগজটা হারেজের হাতে দিয়েছিলাম। হারেজ পকেট থেকে সেটা বের করে দেওয়ার পর দেখলাম- মালিকের নাম লেখা ইজ্জত শেক। ঠিকানা কাবারিকান্দা।
মুরুব্বিকে এ কথা জানানোর পর তিনি বললেন-
: অনেক সময় পোষা প্রাণীরা মালিকের মায়া ত্যাগ করতে পারে না। কোনোমতে একবার সুযোগ পাইলে ছুটতে ছুটতে মালিকের বাড়িতে যাইয়া হাজির হয়। আপনেরা মাইকিং করতেছেনÑ করেন। তবে একবার মালিকের বাড়িতে যাইয়া খোঁজ নিতে পারেন...
কাবারিকান্দা গ্রামে যখন পৌঁছলাম, তখন গভীর রাত। ইজ্জত শেখের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়লাম-
: বাড়িতে কে আছেন...
অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ধৈর্যের প্রান্তসীমায় পৌঁছার ঠিক আগমুহূর্তে ঘরের ভেতর থেকে খুকখুক কাশির শব্দ শোনা গেল। পুনরায় ডাক দিতেই বয়স্ক কেউ বললেন-
: কে ডাকে?
: আমরা।
: আমরা কে?
: এইটা ইজ্জত শেখের বাড়ি না?
: হ।
: মেহেরবানী কইরা একটু বাইরে আসেন।
যিনি বাইরে এলেন, তিনি ইজ্জত শেখের বাবা এলেম শেখ। আমাদের মুখে সবকিছু শোনার পর এলেম শেখ বললেন-
: আমরা খাওন-দাওন শেষ কইরা শুইতে যাব, এমন সময় দেখি লালু উঠানে খাড়া। লালুরে গোয়ালে বাইন্ধা রাখছি; কিন্তু ইজ্জত তো বাড়িতে নাই।
ষাঁড়টার তাহলে একটা নামও আছে- লালু! নশ্বর পৃথিবীর সংসার-বাগানে মানুষ ও একটা অবলা জীবের মধ্যে যে মায়াবৃক্ষ দিনে দিনে বেড়ে উঠেছে- তার শেঁকড় কতটা গভীরে প্রোথিত; তা আবিষ্কারের চেষ্টা করতে করতে বললাম-
: ইজ্জত শেখ কই গেছে?
: সে গেছে বোরোরচর; তার মেয়েজামাইরে ঈদের দাওয়াত দিতে। টাকাগুলা অন্য একজনের হাতে পাঠাইয়া দিয়া আমারে শুধু ফোনে বলছে- লালুরে বিক্রি কইরা দিছি। এখন সে কার কাছে বিক্রি করছে, কী বিষয়-বৃত্তান্ত- তা না জাইনা তো আমি গরু দিতে পারি না।
বৃদ্ধের কথা শুনে হা করে দম ছাড়লাম। এরপর তার হাত দুটো আমার দু’হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম-
: ঈদের তো এখনও কয়েকদিন বাকি আছে। এই কয়দিন লালু আপনের বাড়িতেই থাকুক। আমরা ঈদের দিন ভোরবেলা আইসা তারে নিয়া যাব।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন