ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

জীবন যাচ্ছে তবুও কেন মানছি না!

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:৩৪ পিএম, ১২ জুলাই ২০২১

প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী

দেশে মহামারি করোনা ভাইরাসের ভারতীয় বা ডেল্টা ভেরিয়েন্ট সংক্রমণ চলছে। এই ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ইতোমধ্যে সারাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী ১৭ টি জেলা ছাপিয়ে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট সারা দেশে চোখ রাঙাচ্ছে। জেলা হাসপাতালে অপ্রতুল অক্সিজেন সরবারাহ ও হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার অভাবে চিকিৎসাসেবা দারুনভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অক্সিজেনের অভাবে বগুড়ায় করোনায় আক্রান্ত বেশ ক'জন রুগির করুণ মৃত্যু হয়েছে। যা গণমাধ্যমের বদৌলতে মানুষের মনে ব্যাপক দাগ কেটেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বগুড়ায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান করেছেন।

দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পগ্রুপ (এস আলম) করোনা চিকিৎসায় বগুড়ার দুটি সরকারি হাসপাতালে ১০টি ১০ টি করে মোট ২০সেট হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা উপহার দিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ৷ বগুড়া সদরের সাংসদও তার ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে দুটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা উপহার দিয়েছেন। দেশের অন্যান্য শিল্প গ্রুপও এ ধরনের মানবিক কাজে এগিয়ে আসবে বলে দেশবাসী আশা করে। করোনা ধনী গরিব সবাইকে মিলেমিশে একাকার করে দিয়েছে। প্রতিটি জেলায় বড় ছোট বহু ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও কোটিপতি রয়েছেন। তারা যদি তাদের নিজ নিজ জেলা সদর হাসপাতালে তাদের সিএসআর ফান্ড থেকে এস আলম গ্রুপের মত ২০টি করে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, বা এমপি জি এম সিরাজের মত ২টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সাহায্য দিয়ে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন তাহলে তা করোনা চিকিৎসায় প্রান্তিক জনপদে স্বস্তির আবহ তৈরি করবে। অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। জনমনে স্বস্তি ফিরে আসবে।

এদিকে কঠোর লকডাউন স্বত্ত্বেও মানুষের অসচেনতা ও স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা করোনা পরিস্থিতিকে আস্তে আস্তে জটিল করে তুলছে। হাসপাতালে বেড নেই, পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই, প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইসিইউ বেড নেই। বেড সংখ্যার অতিরিক্ত রোগির চাপে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা ভঙ্গুর। গত বছরের ৭মার্চ দেশে প্রথম করোনা রুগি চিহ্নিত হবার পর আমরা প্রায় ১৭ মাস সময় পেয়েছি। করোনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ আসবে জানা সত্বেও আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে পারিনি। অনিয়ম দুর্নীতি রোধ করা যায়নি। হাসপাতালে নিরবিচ্ছিন্ন অক্সিজেন সেবা নিশ্চিত করতে পারিনি।

সংকটাপন্ন রোগিদের চিকিৎসার জন্য আইসিইউ এর সংখ্যা বাড়ানো যায়নি। শুধু একটি উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। যদিও পরবর্তীতে বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহে তৎপর হয়েছে মন্ত্রণালয়। ৪৫ লক্ষ ডোজ টিকা সংগৃহীত হয়েছে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এসংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেবার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে মর্মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহান জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। তবে সংকট এখনো কাটেনি। সংকট সমাধানের অপেক্ষায় গোটা জাতি।

এক সময় বলা হতো করোনায় গ্রামের প্রান্তিক মানুষ ও কম বয়স্করা আক্রান্ত হয় না। ভারতের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এই দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। মানছি লকডাউনে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির। বহু মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার। শহর ছেড়ে বিকল্প কর্মের সন্ধানে গ্রামে ছুটতে থাকা মানুষের মিছিল দিনকে দিন লম্বা হচ্ছে। এছাড়া তাদের আর কিই বা করার আছে। এক্ষেত্রে কৃষিই হতে পারে বিকল্প কর্মের উপায়। সুতরাং কৃষিতে সরকারে আর্থিক প্রণোদনার পরিমাণ বৃদ্ধি করা দরকার। এছাড়া কর্ম হারানো মানুষগুলোকে এসএমই লোন প্রদানের মাধ্যমে আত্নকর্মসংস্থানের সুয়োগ করে দেয়া গেলে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল হবে। শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশের কৃষি জিডিপিতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অবদান রাখলেও এ খাতের শ্রমিক ও কৃষকরা আজও বঞ্চিত। বন্যা খড়া ও নদীভাঙনে বিপর্যস্ত কৃষক সরকারি অপ্রতুল পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই কৃষিতে বাম্পার ফলন ফলিয়েছে। কিন্ত কৃষকরা লকডাউনের কারণে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাদের উৎপাদিত পণ্য পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এক্ষেত্রে কৃষি বিভাগের সঠিক নজরদারি না থাকায় চরম ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের কৃষক সমাজ। কৃষি বীমার দাবি দেশে জোরালো হলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।

করোনায় প্রান্তিক জনপদের মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে। বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো কঠোর লকডাউনের কারণে চরম অর্থ সংকটে পড়েছে। সরকার ইতোমধ্যে প্রান্তিক জনপদের খেটে খাওয়া কর্মহীন মানুষ ও পরিবহন শ্রমিকদের জন্য ২৩ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ, তবে তা একেবারেই অপ্রতুল। অর্থ বিতরনে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রোধ করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

বিভিন্ন গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেশে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এতো অধিক সংখ্যক দরিদ্র মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা জরুরি হলেও কাজটি বেশ কঠিন। লকডাউন, কঠোর লকডাউন যেটাই বলিনা কেন স্বাস্থ্যবিধি না মানলে, জাতি হিসেবে আমরা সচেতন না হলে কাজের কাজ কিছুই হবেনা। এক্ষেত্রে শুধু দোষারোপের রাজনীতি পরিহার করে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

শুধু আমলা নির্ভরশীলতা দিয়ে তা করা যাবে না। বরং নির্বাচিত জন প্রতিনিধি, বিভিন্ন দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও আমলা সমন্বয়ে তা সহজেই করা সম্ভব হবে। করোনা কোন দেশের বা কোন দলের একক সমস্যা নয়। এটা বৈষয়িক সমস্যা। করোনা দেশে দেশে জাতীয় দুর্যোগ সৃষ্টি করেছে। করোনার ফলে বিশ্বকে দীর্ঘমেয়াদে শিল্প বানিজ্য শিক্ষা অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। যার প্রভাব এখনই পড়তে শুরু করেছে। জীবন ও জীবিকার দাগিতে আমরা শিল্প ও বাণিজ্য সচল রাখতে পারলেও শিক্ষা পুরোপরি স্থবির। কবে কখন কিভাবে দেশের বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে চালু করা যাবে তা এখনও অনিশ্চিত। তবে বলা হচ্ছে সকল শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে যা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। পার্শ্ববর্তী ভারতের আর্থিক কাঠামো অনেকটায় ভেঙ্গে পড়েছে। সে তুলনায় আমরা অনেকটাই ভালো আবস্থানে আছি। কতদিন থাকা যাবে সেটাই বড় কথা। তবে অর্থনীতির এই গতিকে ধরে রাখতে হবে।

দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়ে টিকা প্রদান করা জরুরি। কারন তারা টিকার অভাবে সময়মত কর্মস্থলে যেতে না পারলে তা রেমিট্যান্স প্রবাহের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া বিদেশী মিশন গুলোকে প্রবাসি বাংলাদেশিদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে। কে বৈধ কে অবৈধ এটা বিবেচনা না করে তাদের সকল বিপদে আপদে পাশে থাকাটাই জরুরি। তারা যখন দেশে ডলার পাঠিয়ে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি করছে বা মহামারি করোনা কালে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে সেই ডলারের কোনটা বৈধ প্রবাসীর আর কোনটা অবৈধ প্রবাসীর তা কিন্তু ডলারের গায়ে লেখা থাকে না।

আগামী ২১ জুলাই ঈদুল আজহা। যা মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। এদিকে লকডাউন স্বত্ত্বেও করোনা পরিস্থিতির উন্নতির কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাই ঈদ বলি আর উৎসব বলি স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করাটাই হলো বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জে আমাদের কে জিততেই হবে।

কোরবানিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দেশের খামারিরা প্রস্তত। তাদের খামারে লক্ষ লক্ষ দেশি গরু-ছাগল বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে। অনলাইনে কোরবানির পশুবিক্রি করা গেলে সংক্রমণ রোধ করা সহজ হতো সরকার বা সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। অন্যথায় গ্রামের হাটবাজারে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে কোরবরনির পশু ক্রয় বিক্রয় করা কঠিন হয়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে দেশের অবনতিশীল করোনা পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।

এদিকে দেশীয় খামারিদের কথা চিন্তা করে ভারত সীমান্তকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া উচিৎ। যাতে করে ভারত থেকে কোন কোরবানির পশু দেশে প্রবেশ করতে না পারে। ভারত থেকে চোরাই পথে দেশে গরু প্রবেশ করলে একদিকে যেমন করোনার ভয়াবহতা কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে অন্যদিকে দেশের গ্রামীণ প্রান্তিক খামারিরা লোকসানের সম্মুখীন হবে। তাই আমরা যদি করোনামুক্ত একটা দেশ দেখতে চাই তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মান্য করা জরুরি। আসুন সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি করোনামুক্ত দেশ গড়ি।

লেখক : আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন