ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সবাই পোষে টিয়া-ময়না আমি পুষি শালিক

মোকাম্মেল হোসেন | প্রকাশিত: ০৯:৫৮ এএম, ০২ জুলাই ২০২১

পাখিওয়ালার নাম সিরাজল। আমার দুই পুত্র সিরাজলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। দেখলাম, ছেলেদের সঙ্গে ইতোমধ্যে সিরাজলের একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে গেছে। এ কথা-সে কথার পর সিরাজল বলল-
: স্যার, ভাইয়ারা তো পাখি পোষার জন্য অস্থির হইয়া পড়ছে।
সিরাজলের কথা শুনে মাথা নেড়ে বললাম-
: সর্বনাশ! বাসায় কোনো পশু-পাখি নেওয়া যাবে না; আগে তো বার্ড-ফ্লু’র ভয় ছিলই, বর্তমানে এর সঙ্গে করোনা যুক্ত হইছে।
আমার কথা শুনে ছেলেরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও বাসায় পৌঁছে হেডঅফিসে নালিশ করে দিল।
নালিশ আমলে নিয়ে লবণ বেগম বলল-
: ছেলেরা পাখির জন্য বায়না ধরছে; কিইন্যা দিতেছ না কীজন্য?
: কীজন্য কিইন্যা দিতে অপরাগ হইছিÑ তার কারণ ব্যক্ত করছি।
: বার্ড-ফ্লু’, করোনা এইসব আত্তাবাত্তার দোহাই দিছ তো?
: হ।
: তোমার কাছে কোনো জিনিসের জন্য আবদার করলেÑ আমি হই কিংবা ছেলেরা হোক; ওইটারে ততক্ষণাৎ গলা টিইপ্যা মাইরা ফেলা তোমার অভ্যাসে পরিণত হইছে। ঘরের ভিতরে খাঁচার মধ্যে পাখি থাকব। বাইরের কোনো পাখি যদি এর সংস্পর্শে না আসে, তাইলে বার্ড-ফ্লু বা করোনা কীভাবে ছড়াবে, বোঝাও আমারে!
: আরে পাগল! সংক্রমণ ঘটার জন্য এক পাখির সঙ্গে অন্য পাখির কোলাকুলি করার প্রয়োজন নাই। জীবাণু বহনকারী কোনো পাখি সাইডে বইসা অথবা উইড়া যাওয়ার সময় ‘হাইচ্চো’ বইলা একটা হাঁচি মারলেও লোডা কাইত। সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে থাকা জীবাণু আশেপাশে থাকা পাখিরে শরীরে ঢুইকা পড়বে।
: এইসব ঠেকানোর জন্য পশু হাসপাতাল আছে। সেখানে নিশ্চয়ই টিকা-ফিকা পাওয়া যায়। তুমি সেদিকে চিন্তা না কইরা আওয়াজ তুলছ- পাখিই কিইন্যা দিবা না; এইটা কীরকম কথা!
: এইটা অতি বাস্তবসম্মত কথা।
: তোমার বাস্তবসম্মত কথারে ড্রেনে ফেলাইয়া আগামীকাইল বাচ্চাদের পাখি কিইনা দিবা।
: জি, আইচ্ছা।
পরদিন সিরাজলের দরবারের ছেলেদের হাজির করে বললাম-
: একজোড়া বাজরিগার পাখি দেও।
সিরাজল হাসতে হাসতে বলল-
: স্যার! ভাইয়ারা তো ময়নার অর্ডার দিয়া রাখছে।
: ময়না? ময়নার দাম কত?
: কথা কওইন্যা অরিজিনাল ময়না তো আজকাল পাওয়াই যায় না। আগে পাইয়া লই, তারপর দরদাম ঠিক করা যাবে।
: টিয়া কথা বলতে পারে না?
: পারে তবে ময়নার মতো পরিষ্কার হয় না। টিয়া নিবেন? টিয়া নিলে আজই দেওয়া যাবে।
টিয়ার ব্যাপারে ছেলেদের আগ্রহ কম। তারা ঠিক করে রেখেছে, করোনাকালে তাদের ভাব বিনিময় ও কথোপকথনের সঙ্গী হবে ময়না। সিরাজলকে বললাম-
: কী আর করা! তাইলে ময়নার ব্যবস্থাই কর।
: সময় লাগবে স্যার।
সময় লাগার কথা বলে সিরাজল হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। তার নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ বুঝতে পারছি না। সিরাজলের লাপাত্তা হওয়ার খবর লবণ বেগমের কানে পৌঁছার পর সন্দেহের চোখে সে বলল-
: পাখিওয়ালারে নাকি খুঁইজ্যা পাওয়া যাইতেছে না!
: হ।
: সে হঠাৎ এইভাবে ভেনিস হইল কীজন্য?
নিরীহ ভঙ্গি বললাম-
: আমি কেমনে বলব।
: পাখিওয়ালার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তোমার কোনো হাত নাই তো!
: মানে!
: তুমি তারে এই রোডে ঢুকতে নিষেধ করছ কিনাÑ এইটা জানতে চাইতেছি।
: আশ্চর্য! আমি নিষেধ করব কেন? আমি নিষেধ করার কে?
: পাখির পেছনে অনেকগুলা টাকা খরচ হবে মনে কইরা তুমি তারে এই এলাকায় আসতে নিষেধ করতেই পার!
যাক! তবুও বলেনি যে, পাখিওয়ালারে আমি গুম করেছি।

কয়েকদিন পর গলির মোড়ে একটা চা-পানের দোকানের সামনে সিরাজলকে দেখা গেল। বললাম-
: কই গেছিলা মিয়া? পোলাপানে তো আমারে অস্থির কইরা ফেলছে।
: সুসং দুর্গাপুর গেছিলাম স্যার।
: ওইখানে কেন?
: ওইখানের পাহাড়ে ময়নার খোঁজে।
: পাইছ?
: পাইছি। তবে রেট বেশি পড়বে।
: কত?
: ১০ হাজার।
: কও কী মিয়া! ১০ হাজারে ছোটখাট ছাগল পাওয়া যায়!
: ছাগলের জায়গায় ছাগল আর ময়নার জায়গায় ময়না। একটার সঙ্গে আরেকটার তুলনা দিলে চলবে স্যার? পাখি হইল শখের জিনিস। শখের তোলা ৮০ টাকা। আর এক তোলা ছাগলের মাংসের দাম ৫ টাকারও কম।
আরে! এই ব্যাটা তো দেখতেছি কথার কারিগর! দর কষাকষি করে ৮ হাজারে রফা করা হলো। সিরাজলকে বললামÑ
: ময়নার মধ্যে কোনো ভেজাল নাই তো!
: ভেজালের কারবার সিরাজল করে না। আপনে শতভাগ নিশ্চিত থাকেন।
দেশে এখন ভেজালের ছড়াছড়ি। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, শিক্ষায় ভেজাল, চিকিৎসায় ভেজাল, মানুষে ভেজাল। ভেজালের এ রাজ্যে নিশ্চিত থাকতে বললেই কি থাকা যায়? সংশয় নিয়ে সিরাজলের কাছে জানতে চাইলাম-
: ময়না কতদিনের মধ্যে কথা বলা শুরু করবে?
: এইটা টিচিংয়ের উপর নির্ভর করবে। তারে যত দ্রুত তারে শিখাইবেন, তত তাড়াতাড়ি সে কথা বলবে।
সিরাজলের কাছ থেকে ময়নার ডেলিভারি পাওয়ার পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম-
: গুডমর্নিং।
বড়ছেলে বলল-
: হ্যালো ময়না; হাউ আর ইউ?
মেজোছেলে বলল
: ভীষণ গরম পড়েছে; তাই না ময়না?
ছোটছেলে বলল-
: ময়না ভাইয়া, কেমন আছ?
ময়নাকে নিয়ে কোচিং শুরুর পর একমাস অতিবাহিত হয়েছে; অথচ তার মধ্যে কথা বলার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে লবণ বেগম বলল-
: এইটারে আগে শিষ দেওয়া শিখাইতে হবে। মানুষের বাচ্চাকাচ্চা যেমন আ-আ, ই-ই করতে করতে কথা বলা শিখে; তেমনি শিষ দিতে দিতে এইটর মুখে কথা ফুটবে।
এরপর কয়েকদিন ধরে ময়নার সামনে দাঁড়িয়ে পালা করে শিষ দেওয়া হলো। নাহ! কোনো লাভ হলো না- ময়না শিষ দেয় না; কথাও বলে না! মুখ ভার করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিষ পদ্ধতি ফলপ্রসূ না হওয়ায় সন্দেহের সুরে লবণ বেগম বলল-
: আমার মনে হচ্ছে, এইটা ময়নার বাচ্চা না!
আর্তনাদের সুরে বললাম-
: ময়নার বাচ্চা না!
: না।
: তাইলে কীসের বাচ্চা?
: শালিকের বাচ্চা। এর সামনে থেইকা দুধভাত সরাইয়া পোকা ধইরা দেখÑ দেখবা, টপটপি গিলতেছে।
কোনো পোকা না পেয়ে ছেলেরা পাখিটার সামনে একটা মৃত তেলাপোকা ধরতেই সে সেটা খেয়ে ফেলল। তেলাপোকা ভক্ষণের পর তার মান-মর্যাদা আরও নিচে নেমে গেল। লবণ বেগম ঘোষণা দিল-
: আমি নিশ্চিত- এইটা গোবইরা শালিকের বাচ্চা। এর সামনে একটা কেঁচো ধর, দেখবা- পরম আনন্দে খাইতেছে।
কেঁচোকে বলা হয় প্রকৃতির লাঙল। ঢাকা শহরে প্রকৃতিই নেই! লাঙল পাব কোথায়? বাসার পাশে একটা ড্রেন থেকে পোকা-মাকড় সংগ্রহ করে পাখিটার সামনে রাখার সঙ্গে সঙ্গে বিসমিল্লাহ না বলেই সে খাওয়া শুরু করে দিল। এ ঘটনার পর সিরাজলের খোঁজে গলির মোড়ে হাজির হলাম। কেউ কোনো তথ্য দিতে পারল না। দোকানদারের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জানলাম, অনেকদিন ধরে তাকে এ এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। বুঝতে পারলাম, প্রতারিত হয়েছি।

লবণ বেগমের ধারণা, আমি মোটামুটি চালাক প্রকৃতির মানুষ । তার ধারণা ভুল। চালাক লোকেরা এভাবে প্রতারিত হয় না। বিষণ্ণ মনে বাসায় ফিরে রিপোর্ট করতেই লবণ বেগম বলল-
: এইটারে আর রাইখা কী করবা? ছাইড়া দেও, বনের পাখি বনে ফিইরা যাক।
বেদনামিশ্রিত হাসি দিয়ে বললাম-
: থাকুক আরও কিছুদিন। দেখি কী হয়।
কয়েকদিন পর প্রতিবেশী আজমত সাহেব বারান্দায় পাখির খাঁচা দেখে বললেন-
: বাহ! ময়নার বাচ্চাটা তো খুবই সুন্দর!
বিরসমুখে বললাম-
: এইটা ময়না ভাইসাহেব। শালিক।
অবাক হয়ে আজমত সাহেব বললেন-
: শালিক কেউ পোষে?
: আমি পুষি।
: সবাই টিয়া-ময়না-মুনিয়া এইসব পোষে; আর আপনে শালিক পোষতেছেন? আশ্চর্য!
: আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। এইটারে কীজন্য পোষতেছি, জানতে চান?
: কীজন্য?
: আজকাল অফিস-আদালত, হাট-বাজার, রাস্তাঘাট যেখানেই যাই- দেখি, ময়নার মেকআপ দিয়া শালিকের দল ঘুইরা বেড়াইতেছে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এই দৃশ্য হজম কইরা মেন্টাল হাসপাতালে যাতে যাইতে না হয়, সেইজন্য ঘরের মধ্যেই শালিক রাখছি। আমার ঘরেই যদি ভেজাল ময়না বসবাস করে, তাইলে বাইরের ভেজাল ময়না দেইখা মন খারাপ হওয়ার চান্স কম।

লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন