‘রাজনীতি’ কার কাছে?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, `বিএনপি যদি নির্বাচনে না থাকে তাহলে গণতন্ত্র কীভাবে অর্থবহ হবে? উল্টো তারা গণতন্ত্রকে দুর্বল করতে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। শক্তিশালী রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতি বিএনপির কমিটমেন্ট থাকলে তারা সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণ করতো না’ বলেও মনে করেন।
একই দিনে (২৯ জুন) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সমালোচনা করে সংস্থাটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘তাপস কতটুকু ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন এ শহরের মানুষ জানে। কত পার্সেন্ট ভোট পেয়েছেন তাও মানুষ জানে।'
এর মাত্র একদিন আগে বাংলাদেশের বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান সাবেক ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ সংসদের এক আলোচনায় বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। তখন মন্ত্রীরা জেলার দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে গেলে কর্মীরা আসত। মন্ত্রীরা গ্রামগঞ্জে যেতেন। কোথায় যেন সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে।’ তিনি এই আলোচনায়ই সচিবদের সমালোচনা করে বলেছেন ‘সাংসদেরা সচিবদের ওপরে এটা খেয়াল রাখতে হবে’।
বাংলাদেশের তিনজন জাতীয় ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি এ বছরের শুরুতে ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের এমপিরা নির্বাচিত হওয়া দূরে থাক পালানোর দরজাও খুঁজে পাবে না’।
এ কথাগুলো যারা উচ্চারণ করেছেন, তারা সবাই সরকারদলীয়। শুধু ওবায়দুল কাদের দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রতিপক্ষের সমালোচনা করতে গিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার জন্য গণতন্ত্রকে অনর্থক করে দিচ্ছে বলে বিএনপি'র বর্তমান কার্যক্রমের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু আজকের এই নিবন্ধের আলোচনার অন্য তিনজন সরকারদলীয় বিশিষ্ট মানুষেরা প্রকাশ্যে যেসব উচ্চারণ করেছেন, তাতে কি চিত্রিত হচ্ছে। তারা সরাসরিই বলতে গেলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন। সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় যে এ নির্বাচনী প্রহসন হচ্ছে, তা তারা বলেননি, তাদের আলোচনায় নির্বাচন ব্যবস্থার ত্রুটি তারা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এরপরও বিএনপি'র বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের উক্তির পক্ষে হয়তো আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ দ্বিমত পোষণ করবে না, কারণ বিএনপিও সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে গত এক দশক থেকে শুধু ব্যর্থই হচ্ছে। কিন্তু তার পরও উপরোল্লিখিত তিনজন জাতীয় নেতার প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছে সাধারণ মানুষ এমনকি সরকারদলীয় অসংখ্য নেতাকর্মীও।
সাঈদ খোকন যখন বলেন, ‘বর্তমান মেয়র কত পার্সেন্ট ভোট পেয়েছেন, তা দেশের মানুষ জানে’- তখন প্রশ্নটা দলের অভ্যন্তর থেকেই উঠে আসে। অথচ হিসাবের খাতায় তাপসের ভোট তো কম না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের আরেক নির্বাচিত পৌর মেয়র আব্দুল কাদের মীর্জা যখন বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের এমপিরা নির্বাচিত হওয়া দূরে থাক পালানোর দরজাও খুঁজে পাবে না’, তখন কি গণতন্ত্র প্রশ্নবোধক করার জন্য বিএনপিকে পুরোপুরি দায়ী করা যাবে?
একজন রুহুল কবির রিজভী যদি বার বার পুরোনো ক্যাসেট বাজান সংবাদ সম্মেলনে কিংবা মির্জা ফখরুল যখন সরকারের সমালোচনা করেন, তখন মনে হয় তারা আসলেও যেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ গেছেন, এমনকি তারা তাদের দল কিংবা দেশকে সুষ্ঠু দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তারা যে ব্যর্থ হচ্ছেন, তা-ও অস্বীকার করবেন কীভাবে? ডা. জাফরুল্লাহ যখন তারেক রহমানকে নিয়ে যৌক্তিক সমালোচনা করেন, সে সমালোচনা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে এমনকি বিএনপি'রও নেতাকর্মীদের অনেকেই সমর্থন করেন, তখন তারেক রহমান তার লোকজন দিয়ে ডা. জাফরুল্লাহকে প্রকাশ্যে হুমকি দেন। অথচ প্রবীণ হলে এখনও এই জাফরুল্লাহদের কথাগুলোকেই গুরুত্ব দেয় দেশের লোক। আমরা তো দেখছি, এই ব্রিটেনে তারেক রহমানের নেতৃত্বে কি হচ্ছে! মাঝে মাঝে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা'র বিরুদ্ধে কিছু কল্পিত অপবাদ নিয়ে আসেন। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, দলীয় নেতাকর্মীরাও এসব বিশ্বাস করে না, সমালোচনা করেন, কিন্তু মেনে নেয় মেনে নেয়ার প্রয়োজনে।
কল্পিত অপবাদ দিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা যায় না। তা তারেক রহমানের উপলব্ধিতে এসেছে কি-না জানি না, তবে বাস্তবতা হলো বিএনপি তার নির্দেশনায় ক্ষয় হচ্ছে। দলটি এখন এক সংকট সময় অতিক্রম করছে সাংগঠনিকভাবে। এসময়ে বাস্তবতাকে মেনে নেয়া ছাড়া তাদের কোনো রাস্তা নেই। রাজপথে এখন তারা আর থাকে না। করোনার অনেক ইস্যু, রিকশা-ভ্যান শ্রমিকদের দাবি, হকারদের আন্দোলন চলছে। মাঠ কিছুটা হলেও উষ্ণ করে রাখছে বামপন্থী দলগুলো, কিন্তু বিএনপি নেই। দেশ-জনগণের প্রয়োজনে রাজপথে না থাকলে তো আর দল কিংবা কর্মী ধরে রাখা যায় না, প্রকারান্তরে দেশের জন্য কল্যাণও নিয়ে আসতে পারে না এরকম দল।
বিএনপি'র যখন এরকম অবস্থা, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারাই মুখ খুলছেন, সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের দুর্বলতা প্রকাশ্যেই নিয়ে আসছেন তারা । একজন জনপ্রতিনিধি যে কীভাবে সচিবনির্ভর হয়ে গেছেন এবং এ কারণেই হয়তো জনপ্রতিনিধিরা কর্মীদের গুরুত্ব দিতে চান না। তোফায়েল আহমেদের কথা অনুযায়ী সেজন্যই সেই ১৯৯৬ সালের মন্ত্রী কিংবা সাংসদদের এলাকা-ঘনিষ্ঠ হয়ে কর্মীবান্ধব সংস্কৃতি এখন আর নেই। সচিবই কীভাবে জায়গা করে নিয়েছেন মন্ত্রীদের ওপরে, তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন এই জ্যেষ্ঠ সাংসদ ।
অর্থাৎ সাঈদ খোকন বলি, মির্জা কাদের বলি কিংবা বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ বলি, তারা সবাই কিন্তু সরকারের কিছু কিছু সেক্টরের দুর্বলতাকেই তুলে ধরেছেন। এই দুর্বলতা একদিনেই তৈরি হয়নি। অরাজনীতিকরা রাজনীতিকে যে বিরাজনীতিতে নিয়ে যাচ্ছেন, তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ, তা না হলে কর্মীদের ওপর নির্ভর না করে জনগণের ওপর আস্থা না রেখে ধরে নিয়ে আসা অর্থে-বিত্তে ঠাসা মানুষগুলোই জনপ্রতিনিধি বিশেষত সাংসদ হচ্ছেন, এমনকি উপনির্বাচনগুলোতেও। স্বাভাবিকভাবেই সেজন্য রাজনীতি এখন মেজর জিয়াউর রহমানের সেই কুখ্যাত ‘আই উইল মেইক পলিটিকস ডিফিকাল্ট ফর দি পলিটিশিয়ান’ বানিয়ে নেয়া হচ্ছে। অসাধুরা ক্রমেই ভর করছে ।
তবুও বলতেই হবে, এটাও একধরনের রাজনৈতিক উপলব্ধি । এই উপলব্ধি আওয়ামী ধারার রাজনীতিতে প্রভাব ফেলুক কিংবা না ফেলুক, এ বাস্তবতাকে খুব একটা অস্বীকার করা যাবে না। এ উপলব্ধিটা আসুক, উন্নয়ন যেখানে বেগ পেয়েছে, সেখানে বিরাজনীতিতে তা যেন মুখ থুবড়ে না পড়ে।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম