কোভিডের নতুন সংস্করণ আর আমরা থেকে আমি’র আমরা
এরশাদ মোড়ল এখনো বেচে আছেন। ১৯৭১-এর ২০ মে চুকনগর গণহত্যার পর লাশের ভিড়ে নিজের নিখোঁজ বাবাকে খুঁজতে সেখানে গিয়েছিলেন তরুণ এরশাদ। ২০১৯-এর শেষের দিকে খুলনা মেডিকেল কলেজে একটা সেমিনারে লেকচার দিতে যশোর থেকে খুলনা যাওয়ার পথে চুকনগর বধ্যভূমিতে দেখা হয়েছিল প্রৌঢ় এরশাদ মোড়লের সাথে। বাবাকে খুঁজে পাননি, পেয়েছিলেন মৃত মায়ের স্তন পানের বৃথা চেষ্টায় মা’র বুকের উপর হামাগুড়ি দিয়ে থাকা একটা মেয়ে শিশুকে।
মৃত মায়ের মাথায় সিঁদুর, হাতে শাখা। বধ্যভূমি থেকে ফেরার পথে শিশুটিকে সাথে করে ঘরে ফেরেন এরশাদ মোড়ল। নাম রাখের সুন্দরীবালা। ঘরের কোনে স্থাপন করেন ঠাকুর ঘর আর উঠানে তুলসি গাছ। সুন্দরীবালাকে শেখানো হয় গিতা পাঠ। সনাতন রীতিতে বেড়ে উঠা সুন্দরীবালাকে এরশাদ মোড়ল সম্প্রদান করেছেন হিন্দু পাত্রের কাছে। সেদিন এরশাদ মোড়ল পিতৃশোকে কাতর হয়ে একাকী ঘরে ফিরলে তাতে কারো কিছু আসতো-যেতো না। চুকনগরের হাজারো শহীদের সংখ্যায় শুধু যোগ হতো ‘এক’, তবে তাতে স্ট্যাটিস্টিক্সেরও হেরফের হতো না এতটুকুও।
দুই.
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরী। ’৭১-এর অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকে গোপনে নিজ ক্লিনিকে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা আর পাশাপাশি সাহায্য করতেন তিনি। এর জন্য অবশ্য কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল তাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক আগ মুহূর্তে তাকে নিজ বাসা থেকে উঠিয়ে নেয় মওলানা মান্নানের নেতৃত্বে একদল আলবদর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রায়েরবাজারের বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয় তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। চক্ষু বিশেষজ্ঞের চোখের পাশেই ছিল বেয়নেটের গভীর ক্ষতচিহ্ন। এমন পরিণতির শঙ্কা আছে জেনেও ঢাকা শহর ছেড়ে জাননি এই শহীদ বুদ্ধিজীবী শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের কথা চিন্তা করে।
তিন.
শহীদ জননী জাহানারা ইমান যখন ক্যান্সারের চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে দেশে ফিরে আসেন তখন তিনি ভাল করেই জানতেন যে এই আসাটা তার আগাম প্রস্থান নিশ্চিত করবে মাত্র। চিকিৎসক আর শুভানুধ্যায়ীদের সব পরামর্শ আর অনুরোধ উপেক্ষা করেই ফিরেছিলেন শহীদ জননী যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়াটা আরেকটু এগিয়ে নেয়ার জন্য।
চার.
১৯৮১’র স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আজকের প্রধানমন্ত্রী, সেদিনের আওয়ামী লীগের সদ্য নির্বাচিত সভাপতি শেখ হাসিনার জন্য মোটেও সহজ বিষয় ছিল না। ছিল রাষ্ট্রীয় বাধা, ছিল জীবনের ঝুঁকিও। আপার দেশে ফেরা ঠেকাতে গঠন করা হয়েছিল এমনকি প্রতিরোধ কমিটিও। নয়া দিল্লীতে স্বামী-সন্তান নিয়ে থিতু না হয়ে সেদিন একজন শেখ হাসিনা শত ঝুঁকি মাথায় নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন বলেই আজ বাংলাদেশের কোটি মানুষ বুক চিতিয়ে চলতে পারে আর ভরা পেটে ঘুমায় শান্তিতে।
পাঁচ.
চলমান প্যান্ডেমিকটি চন্ডীর বেশে দেশে এগিয়ে আসছে। এটি প্যান্ডেমিকের দ্বিতীয় ওয়েভের দ্বিতীয় ওয়েভ না ওয়েভ নম্বর তিন তা নিয়ে বিতর্ক বিস্তর। যেহেতু আমরা চলমান দ্বিতীয় ওয়েভটিকে ন্যূনতম ছয় সপ্তাহের জন্য দৈনিক নতুন রোগী শনাক্তের বিবেচনায় পাঁচ শতাংশের নিচে ধরে রাখতে পারিনি, তাই একদলের যুক্তিতে এখন যা চলছে তা দ্বিতীয় ওয়েভেরই দ্বিতীয় সংস্করণ।
অন্যদিকে চলমান ওয়েভটা যেহেতু এরই মাঝে প্রথম ওয়েভের সর্বোচ্চ পিকটা ছুঁয়ে বরং ছাপিয়েও গেছে, কাজেই এটিকে তৃতীয় ওয়েভ ছাড়া অন্যকিছু মানতে নারাজ আরেকদল বিশেষজ্ঞ। তবে ওয়েভ এটি যাই হোক না কেন, সামনের দিনগুলো যে ভয়াবহ হতে পারে সেই নিয়ে শঙ্কার শেষ নেই। এমনি পরিস্থিতিতে প্রথমে রাজধানীকে রক্ষায় আশেপাশের জেলাগুলোয় এবং তারপর সারাদেশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন সরকার। জুলাইয়ের প্রথম প্রহরে কড়াকড়িটা বাড়বে আরেক ডিগ্রি। পথে নামবে সেনাবাহিনীও।
ছয়.
লকডাউনকে ছুটি বানিয়ে আবারো হিড়িক পড়েছে ঢাকা ছাড়ার। বেশি ভাড়া দিয়েতো বটেই, বরাবরের মতোই ট্রাকে চেপে আর পায়ে হেটেও শহর ছাড়ছে মানুষ। আর বরাবরের মতোই তা রিপোর্টিং-এ ব্যস্ত টিভি চ্যানেলগুলো। মাঝে-সাঝেই আমার এখানে ওখানে ডাক পরে টক’শোতে কোভিড নিয়ে কথা বলার। কাজেই চেম্বারের ফাঁকে-ফাঁকে এই চ্যানেল, সেই চ্যানেলের খবরগুলো দেখে-বুঝে একটু আপডেটেড থাকার চেষ্টা আমার প্রতি সন্ধ্যায়ই। মন দিয়ে শুনি আর বোঝার চেষ্টা করি কেন ছুটছে মানুষ শহর ছেড়ে।
নানা মানুষের যুক্তি নানান। কেউ গ্রামে ছেড়ে আসা পরিবারকে সঙ্গ দিতে তো কেউ বন্ধ ঢাকায় আয়-রোজগারও বন্ধ হবে এমনি শঙ্কায়। শহর ছাড়ার পিছনে যুক্তি আছে আরো অনেক এবং এর সবগুলো যুক্তিই খুবই যুক্তিযুক্ত। তবে লক্ষণীয় এই যে, যুক্তি যাই হোক না কেন, তাদের প্রত্যেকের শহর ছাড়ার কারণটা ‘নিজের জন্য, নিজের তাগিদে’। আর ‘আমার’ জন্য শহর ছাড়তে গিয়ে ‘আমি’ যে ‘আমাদের’ আর এমনকি ‘আমরা পরিবারেরও’ বিপদের কারণ হচ্ছি, তা নিয়ে কিন্তু এতটুকুও মাথাব্যথা দেখছি না কারোরই।
সাত.
আমরা সবাই ভবিষ্যতের জন্য বাঁচি আর বর্তমান যখন ভবিষ্যতে গিয়ে পৌঁছায় তখন ছেড়ে আসা বর্তমান অর্থাৎ অতীতের জন্য আমাদের থাকে অনেক আক্ষেপ। ঐ যেমনটি বাউল আব্দুল করিম বলেছিলেন, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। আগের দিনগুলো সুন্দর ছিলো কিনা জানিনা, তবে আগে আমাদের অনেক কিছুই ছিল আমাদের জন্য। সেই ‘আমাদের আমরা’ কিভাবে যে ‘আমার আমি’ হয়ে গেলাম তা আমি ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারি না। আমরা কোভিডের লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে বাড়ার জন্য মানুষের সচেতনতার অভাবকে দোষী। কোভিড কিন্তু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সমস্যা সেখানে নয়। আমাদের সমস্যা কখন যেন বড় বেশি ‘আমরা’ থেকে ‘আমি’ হয়ে গেছি।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
আঞ্চলিক পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/এমএস