দলীয় প্রতীক ছাড়া হোক ইউপি নির্বাচন
রাজন ভট্টাচার্য
নিরেট ভদ্রালোক মানুষ গ্রামের কামাল উকিল। সবাই তাকে ভালো চেনেন। জানেন। প্রতিদিন এলাকার বিচার সালিশে তিনিই মধ্যমনি। যা বলতেন তাই লোকে শুনতেন। রাস্তায় বের হলে আদাব, সালাম পেতেন। বলতে গেলে সর্বজন শ্রদ্ধার মানুষ। তিনিও এলাকার সবাইকে সম্মানের সঙ্গে কথা বলতেন। কোনদিন কথার বরখেলাপ করতেন না। বিয়ে, যাত্রাপালা, কবি আর বাউলগান, ফুটবল খেলা, মোরগ আর ষাঁড়ের লড়াই সহ সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে তার সরব উপস্থিতি। এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও তার পরামর্শ নিয়ে চলেন।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে এলাকার সাধারণ মানুষ দল বেঁধে বাড়ি আসেন। কি ব্যাপার? কোন ঘটনা ছাড়াই ১০ গ্রামের মানুষ এক হতে দেখে চোখ কপালে উঠল উকিল সাহেবের। সবাই একটি দাবি নিয়ে আসেন। আপনাকে এবার চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে হবে। দু’হাতে ঠেলে সবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন কামাল উকিল। বললেন না না। এটা হয় না। অসম্ভব। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। এভাবেই বাকি জীবন কাটাতে চাই। কোন ঝামেলায় যেতে চাই না। মাফ করো। তোমাদের সব কথা রাখি, কিন্তু এমন দাবি করো না, যা রাখা অসম্ভব।
এবার এলাকাবাসী বললেন, আপনি কি জানেন পাশের ইউনিয়নে সুব্রত মাস্টারকে সবাই মিলে প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি কিন্তু এলাকাবাসীর কথা ফেলতে পারেননি। আশপাশের অন্তত পাঁচটি ইউনিয়নে এমন ভালো মানুষদের প্রার্থী করার উদাহরণ হাজির করা হল। এবার তো কথা দিতে হবে উকিল সাহেবের। কেউ কথা না নিয়ে বাড়ি ফিরতে চান না। সময় নিলেন তিনি। ভাবলেন। নিরুপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত কথা দিলেন সবাইকে। তিনি প্রার্থী হচ্ছেন। গ্রামবাসীর কথায় অন্য দু’জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ালেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন জনমানুষের এই প্রতিনিধি। জয় হলো মানুষের ভালোবাসার। তাই এলাকায় খুশির বন্যা।
সময় বদলে গেছে। এখন জনপ্রতিনিধি করতে বেছে বেছে ভালো মানুষদের তেমন একটা খোজা হয় না। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সুশাসন আর শান্তি প্রতিষ্ঠার চিন্তা থেকে অনেকটাই সড়ে এসেছে। এর বড় প্রমাণ হলো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত। প্রার্থী ঠিক করার ক্ষেত্রেও গুন বিচার খুব কমই হয়। জনপ্রিয়তা যাচাই নিয়ে প্রশ্ন ওঠার নজির অহরহ। নিজেদের মতো করে প্রার্থী ঠিক করা হয়। যার যত লবিং তিনিই প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পান। তার প্রতি এলাকার মানুষের সমর্থন না থাকলেও কোন আসে যায় না।
বিগত পৌরসভা, উপজেলা, জেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সংসদ নির্বাচনেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন চিত্র দেখা গেছে। দলের স্থানীয় কমিটির সুপারিশের বাইরেও অনেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীর নাম তৃণমূল থেকে একেবারেই বাদ দেয়ার ঘটনাও আছে।
কথা হলো গ্রামের মানুষ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে কতোটা খুশি। শুরু থেকেই দেশের স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা এর বিরোধীতা করে আসছেন। যারা দেশ ও রাষ্ট্র নিয়ে ভাবেন তারও দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন না। তবুও হয়েছে। আগামীতেও হয়ত হবে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক ভাবে ইউপি নির্বাচন নিয়ে একটা নিরপেক্ষ জরিপ হতে পারে। যদি বেশিরভাগ মানুষ চায় ইউপি নির্বাচন ব্যবস্থা আগের জায়গায় ফিরে যাক, তবে অবশ্যই সরকারের চলমান সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে আসা উচিত হবে। এজন্য নির্দলীয় সাধারণ মানুষের মতামতকে প্রাধাণ্য দেয়ার বিকল্প নেই। আমার তো মনে হয়, এতে দেশের অনেক বড় উপকার হবে।
গতবার প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এবার দ্বিতীয় পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর অপেক্ষা। চলতি এপ্রিল থেকে ইউপি নির্বাচন শুরুর কথা ছিল। কোভিডের কারণে হয়ত আরো কিছুদিন পিছাতে পারে। কথা হলো শান্তির জনপথ খ্যাত ইউনিয়ন পরিষদ আর গ্রামগুলোতে রাজনীতি কতোটা প্রভাব ফেলেছে। চলমান প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থাপনার প্রতি সন্তুষ্টই বা কতোজন। একটা বিষয় স্পষ্ট দলীয় প্রতীকে নির্বাচন কমবেশি সবখানেই অশান্তির কারণ হয়েছে। অশান্তির সেই ছায়া সাধারণ মানুষগুলোর মনে বিরুপ রেখাপাত করেছে। এটাই শান্তিপ্রিয় মানুষের কথায় স্পষ্ট।
যেখানে কোনদিন রাজনীতির নামে হিংস্রতা, সহিংসতা, একে অপরের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব দেখা যায়নি এখন অনেক ইউনিয়ন আর গ্রামে তা দেখা যায়। ২০১৬ সালে প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর এখন বাড়ি বাড়ি রাজনৈতিক কর্মী চিহ্নিত। সবাই সবাইকে রাজনৈতিক পরিচয়ে চিনেন, জানেন। দেখার চেষ্টা করেন। এতে প্রতিটি গ্রামেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সৃষ্টির পাশাপাশি প্রতিহিংসা স্থায়ী রুপ নিয়েছে।
এক কথায় যদি বলা যায়, রাজনৈতিক কর্মীরা নানা কারণে খুশি হলেও দলীয় নির্বাচন গ্রামের সহজ সরল সাধারণ মানুষকে খুব একটা সন্তুষ্ট করতে পারেনি। উল্টো হৃদয়ে ক্ষত তৈরি করেছে।
গত ইউপি পরিষদ নির্বাচনের ঘটনা আগের নির্বাচন গুলোর মতো ছিল না। প্রার্থীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। এতে ভদ্রলোকরা সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ দিন অবধি কমবেশি রাজনৈতিক উত্তাপ ছিল। কোথাও কোথাও রাজনৈতিক কারণে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। ফলাফল নিজেদের ঘরে না যাওয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আক্রমন করে কথাবার্তা বলতেও দেখা গেছে। ঘটেছে নির্যাতনের ঘটনাও। প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে হামলা, পাল্টা হামলাসহ গুলাগোলি পর্যন্ত হয়েছে। এতো গেল ভোট কেন্দ্রীক উত্তেজনা।
ভোটের পর কিভাবে কেটেছে পাঁচ বছর। এ নিয়েও গ্রামের মানুষের সুখকর অনুভুতি নেই। ভোটে ধরুন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। এবার কোন কাজে বা সহযোগিতার জন্য চেয়ারম্যানের কাছে অন্য দলের সমর্থক ব্যক্তি গেলে তিনি সরাসরি বলেন, যাকে ভোট দিয়েছেন তার কাছে যান! এটা কেমন কথা। রাজনীতি কিন্তু এ ধরণের দ্বিধা বিভক্তি তৈরী করেছে। অনেকেই হয়েছেন সুবিধা বঞ্চিত।
তাছাড়া প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক কর্মীর এলাকায় সমান উন্নয়ন হচ্ছে না। এমন ঘটনাও আছে, নিজের সমর্থক না হলে, তার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা যায় না। একটু আগে উদ্দেশ্যমূলকভাবে রাস্তার কাজ শেষ করা হয়। তাছাড়া বাজার, দোকানপাটে তো বছরজুড়ে দল ভিক্তিক প্ল্যাট ফরম, আড্ডা গল্প এমন প্রবণতা বেড়েছে। যা সত্যিকার অর্থেই কেউ মন থেকে চায়নি। দলীয় নির্বাচনে সবার সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে, উন্নয়ন বেড়েছে বিষয়টি এভাবে দেখতে নারাজ সাধারণ নাগরিকেরা। এলাকায় যে কোন ঘটনা এখন রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখা হয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, রেওয়াজ নষ্ট হয়েছে। মামলা, বিচার সালিশেও রাজনৈতিক বিষয় প্রাধান্য পাওয়ায় সাধারণ মানুষের বেশ ক্ষতি হয়েছে। বেড়েছে ভোগান্তি।
কাজের প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন এলাকার ইউনিয়ন পর্যায়ে গেলেই সাধারণ মানুষ কেমন আছেন সেকথা জানতে খুবই ইচ্ছে করে। তৃণমূলের খবর হলো গ্রামে রাজনীতি প্রবেশ করায়, সে মানুষগুলো যে ভালো নেই তা বোঝা গেছে। রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে চাপা কষ্ট কাজ করে। তারা দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। সবচেয়ে বড় সত্যি হলো রাজনীতির বন্ধনে সবাইকে তো এক রাখা যায়নি। এটা সমাজের জন্য বেশ ক্ষতি হয়েছে। বেড়েছে সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ মনোভাব। কথিত রাজনৈতিক চর্চা গ্রামীণ জনপদে অশান্তি বাড়িয়ে তুলেছে।
দেশে চার হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়ন পরিষদ আছে। আগামী নির্বাচনে এসব ইউনিয়ন গুলোতে সাধারণ মানুষের ওপর প্রতিনিধি ঠিক করার সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেয়া যায় না? দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তা ঠিক। তবে আগের মতো নির্বাচনী প্রথায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হলে হয়ত নিজেদের আড়াল করে রাখা ভালো সাদা মনের আলোকিত মানুষগুলোকে ইউনিয়নবাসী প্রার্থী হিসেবে বেছে নিতে পারতো। নিজেরাই নিজেদের প্রতিনিধি ঠিক করে শান্তি, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেত। সাধারণ মানুষ জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার ক্ষমতা ফিরে পেলে অবশ্যই খুশি হবেন। মন থেকে দূর হবে অশান্তির কালো রেখা।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জিকেএস