গেছে ঈদ আসছে ঈদ আছে কোভিড
বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট-এর কারণে করোনা ভাইরাসের কম্যুনিটি সংক্রমণ ঘটছে দেশব্যাপী। খারাপ অবস্থা খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে। আশেপাশের সাত জেলায় লকডাউন দিয়ে ঢাকাকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা এখন চলছে। কিন্তু শুধু ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট-কে দোষ দিব নাকি নিজেদের কাণ্ডকারখানার একটা নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করব – সেটা ভাবনায় আনা প্রয়োজন।
রোজার ঈদে মানুষ যেভাবে ফেরিঘাটে, সড়কের মোড়ে মোড়ে ভিড় করে, গাদাগাদি করে গাড়িতে চেপে বাড়ি গেছে তার ফলাফল জুন মাসে পাওয়া যাবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছিলেন। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সাথে সেই আনন্দের ঢেউটাও যে এখন লেগেছে সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই বিবেচনাতেই করোনা ভাইরাস দেশব্যাপী এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। প্রথম ঢেউয়ের সময় সাধারণ মানুষের মাঝে একটা ধারণা পাকাপোক্ত হয়েছিল যে, দরিদ্র মানুষের করোনা হয়না, গ্রামে করোনা নেই। কিন্তু গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু এখন ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে বেশি এবং দরিদ্র মানুষ ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা এবং জরুরি সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। ঢাকার হাসপাতাল সমূহেও রোগী ঢুকানোর আর জায়গা নেই।
কিন্তু এর মধ্যেই বেশি কিছু স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন যেন দেশে ভোট বড় বালাই। করোনার এমন ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেই নির্বাচন করতে হল। দিনরাত সরকার নিজে বলছে, গণমাধ্যমে উচ্চারিত হচ্ছে যে সামাজিক দূরত্বের কথা, সেখানে এই ভোট উৎসবে কি করে পালিত হয়?
গত বছর জুন জুলাইয়ের পর এরকম ভোট উৎসব হয়েছে দেশব্যাপী। করোনার অস্তিত্ব অস্বীকার করে চলেছে মিটিং, মিছিল, জনসভার ভিড়। করোনাকে চুপ করানো গেছে- সরকারের এমন বার্তায় মানুষও পর্যটন কেন্দ্রে গেছে, বিয়ে, জন্মদিনের উৎসব করেছে দেদারসে, ধর্মীয় ও নানা সমাবেশের নামে স্বাস্থ্যবিধি শিকেয় তুলে মেলামেশা করেছে। করোনাকে একবারে অস্বীকার করার চরম দৃষ্টান্ত ছিল রোজার ঈদ। ভুল পরিকল্পনায়, ভুল ব্যবস্থাপনায় মানুষ কাছে টেনেছে করোনাকে, কেন্দ্র থেকে প্রান্তে নিয়ে গেছে ভাইরাসকে যার ভয়ংকর দিকটা এখন আমরা দেখছি।
সরকারের দিক থেকে সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থাপনা ছিল টিকা দান কর্মসূচি। অত্যন্ত সফলভাবে, চমৎকার ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে শুরু হওয়া এই টিকা দান প্রক্রিয়াও শেষ পর্যন্ত সফল হলোনা ভারত থেকে টিকা না আসায়। বিশ্বের ২০ শতাংশের বেশি মানুষ টিকার আওতায় এলেও বাংলাদেশ টিকা নিতে পেরেছে মাত্র তিন শতাংশ মানুষ। আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশ তাদের জনগণকে আমাদের তুলনায় বেশি টিকা নিতে পেরেছে।
অতিমারি বারবার বুঝিয়েছে, শিখিয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি অবহেলা করলে কী হয়। স্বাভাবিক মেলামেশাতেও বাধা করোনা। কিন্তু আমরা সাবধান হইনি। লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষেত্রে আপোস করা, অবৈজ্ঞানিক পন্থায় সব খোলা রেখে জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য আনার চেষ্টা সবই করোনাকে উৎসাহ জুগিয়েছে। অথচ মাসের পর মাস ধরে করোনার জুজু দেখিয়ে বন্ধ রাখা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাড়ি বসে ‘অনলাইন ক্লাস’-এ সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়নি।
এর মধ্যে ছিল মানুষের দুর্বিনীত আচরণ। গত বছর করোনা শুরুর পর থেকে প্রতিটি ঈদ উৎসবে মানুষের উন্মত্ততা আমরা দেখেছি। কখনোই কোন বিধি না মানাই যেন আমাদের বৈশিষ্ট্য। দেশ-বিদেশর খবর এখন হাতের মুঠোয়। টেলিভিশনে, পত্রিকায়, মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তায়, অনলাইনে, সামাজিক মাধ্যমে এত প্রচারণার পরও আমাদের থুতনিতে মাস্ক ঝুলছে, নাক মুখ ঢাকছে না। পথে নামলেই দেখতে পাই কিছু মানুষের মধ্যে সচেতনতার বালাই নেই।
মাস্ক পরা বা দূরত্ব-বিধি মানার চেষ্টা নেই কোথাও। বহু টেম্পু, বাস, মিনিবাসে চালক-যাত্রীর মাস্ক নেই। পথের ধারে থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে আড্ডায় মশগুল বহু যুবক। বাস বন্ধ, তাইকে, কারে করে বা মাইক্রোবাসে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পথ চলছে মানুষ। ঈদের সময় এভাবে বাড়িও গেছে তারা। গাদাগাদি করে গল্পে মাতোয়ারা মানুষ রেস্তোরায়, ক্লাবে, পাড়ায় পাড়ায়। এত মৃত্যু দেখেও যদি মানুষ সচেতন না হয়, তবে আর বিধিনিষেধ জারি করে কী লাভ হবে সেটা বড় প্রশ্ন।
দেশে এখন নতুন করে করোনার বড় ঢেউ নিয়ে আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে চিকিৎসক মহলে। সতর্ক থাকার কথা বলছে প্রশাসন। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না অনেক জায়গায়। আমরা আগেই বলেছিলাম কম মৃত্যু আর কম সংক্রমণ দেখে আত্মসন্তুষ্টির জায়গা নেই। কিন্তু তখন এসব সতর্কবার্তাকে পাত্তা দেওয়া হয়নি।
সামনে আছে আরেক ঈদ। কোরবানির ঈদ। আবার কি দেখতে হবে কমান্ডো ট্রেইনিং-এর মহড়া? কিন্তু আমরা জানি এই ঈদের ঝুঁকি আরও বেশি। একদিকে ভিড় করে বাড়ি যাওয়া আর পশুর হাটে জমায়েত হওয়া। মানুষ মানবে তো? আতঙ্কিত সচেতন মানুষ দাবি করছে মাস্ক ছাড়া বাইরে বেরোনো লোকজনের বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। মানুষের দূরপাল্লার যাতায়াত কঠোরভাবে বন্ধ করা হোক। লোকজনের বেপরোয়া ভাবকে সহ্য করার কোন যুক্তি নেই। মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে আরও বেশি, না হলে বাধ্য করা হোক সতর্কতায়। আর সরকার অবশ্যই সক্রিয় হোক টিকা দান কর্মসূচি আবার বড় আকারে শুরু করতে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস