ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অতৃপ্ত আত্মারা কখনো সুখী হতে পারে না

শাহানা হুদা রঞ্জনা | প্রকাশিত: ০২:২৫ পিএম, ২৪ জুন ২০২১

বিখ্যাত দার্শনিক, শিক্ষক ও রাজনীতিবিষয়ক তাত্ত্বিক কনফুসিয়াস সুখী জীবনের জন্য খুব সাধারণ কিছু সূত্র দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, শাসকেরা এমন উদাহরণ সৃষ্টি করবে, যাতে সাধারণ জনগণ একে অন্যের প্রতি সদাচারে উৎসাহী হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি উনি বলেছেন তা হলো ‘যা আপনি নিজের জন্য প্রত্যাশা করেন না, তা অন্যের জন্য করবেন না।’

সুখী হওয়ার জন্য তিনি পাঁচটি উপায়ের কথা বলেছিলেন। যেগুলোর নাম দিয়েছিলেন ‘পাঁচ সদগুণ’। তিনি মনে করতেন, সুখী এবং অর্থময় জীবনের জন্য এই পাঁচ গুণের প্রতিটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা, সদাচার ও ভদ্রতা, দানশীলতা ও মানবতা, জ্ঞান ও শিক্ষা এবং বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য। (সূত্র: প্রথম আলো)

২০২১ সালের সুখের ইনডেক্সে দেখলাম বাংলাদেশ ১৪৯টি দেশের মধ্যে এবার ১০১ নাম্বারে আছে। ফিনল্যান্ড পরপর চারবার সবচেয়ে সুখী দেশ হয়েছে। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলো সামনের সারিতে থাকলেও আমেরিকা হয়েছে ১৯তম, ব্রিটেন ১৭তম ও অস্ট্রেলিয়া ১১তম সুখী দেশ। জনকল্যাণের সাথে জড়িত ছয়টি মূল বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এই সুখের মান নির্ধারণ করা হয়- আয়, স্বাধীনতা, বিশ্বাস, স্বাস্থ্যসম্মত দীর্ঘায়ু, সামাজিক সহায়তা এবং ভদ্রতা। আধুনিক বিশ্বের এ সদগুণগুলোর সাথে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে দেয়া কনফুসিয়াসের সদগুণের কী অদ্ভুত মিল।

শুনে খুশি হলাম যে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এবার কয়েক ধাপ এগিয়েছে। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগলো তাহলে কি আমরা কনফুসিয়াসের সেই পাঁচটি সদগুণ অনুসরণ করতে শুরু করেছি? চারপাশের মানুষের মধ্যে কি সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা, সদাচার ও ভদ্রতা, দানশীলতা ও মানবতা, জ্ঞান ও শিক্ষা এবং বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য এগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে? না, বাস্তবতাতো সেকথা বলে না। একটুকুও তা হয়নি। বরং প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের অবস্থান ক্রমশ নিম্নগামী।

প্রতি বছরই জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক বিভাগ ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। ২০১১ সালে দক্ষিণ এশিয়া দেশ ভুটান জাতিসংঘে বিশ্ব সুখী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করে। এর পরের বছর থেকেই ২০ মার্চকে বিশ্ব সুখী দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টও প্রকাশ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিজীবনে সততার এত অভাব যে দেশ দুর্নীতিতে সেরা হয়ে আছে বছরের পর বছর। এখানে ন্যায়নীতির কথা শোনা বা বলা বোকামির পর্যায়ে পড়ে। মানবতা কমতে কমতে প্রায় নিচের দিকে। জ্ঞান-শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। কারণ দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং এখন বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৮০০ এর নিচে। বাকিদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। দানশীলতা বলতে আমরা মনে করি শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করা। বেসরকারি উদ্যোগে সাধারণ মানুষের জন্য এবং অবাণিজ্যিক হাসপাতাল, স্কুল, লাইব্রেরি নেই বললেই চলে। বিশ্বাস তো উঠেই গেছে। অবিশ্বাস, লোক ঠকানো, অভদ্রতা যেন আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, খুন, ধর্ষণ চরম আকার ধারণ করেছে। বাল্যবিয়ের হার বাড়ছে। শিশুরা অধিকহারে শ্রমে নিযুক্ত হচ্ছে। তাদের মাদক ও পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি বাড়ছে। নিরাপত্তাহীন ও ভীতিকর পরিবেশ নারী-পুরুষ সবাইকে কোণঠাসা করেছে। গলা খুলে কথা বলার স্বাধীনতাও কমে যাচ্ছে।

অবশ্য আমরা দেখছি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, জিডিপি বাড়ছে, ফরেন রিজার্ভ বাড়ছে। রিজার্ভ এতটাই বাড়ছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৫ বছর আগে ৮১ মিলিয়ন টাকা হাওয়া হয়ে যাওয়ার পরও, আমরা উদাসীন ছিলাম এবং টাকা ফিরিয়েও আনতে পারিনি। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য জনগণের এতগুলো টাকা উড়ে যাওয়া তো চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না।

সে যাক, পত্রিকার খবরে প্রকাশ দেশে কোটিপতিও বাড়ছে দ্রুতগতিতে। শুধু ব্যাংক তথ্যেই এক বছরে বেড়েছে ৮ হাজার ২৭৬ জন কোটিপতি। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে বেড়েছে তিন হাজার ৯৬২টি। বর্তমানে ব্যাংকখাতে মোট আমানতের প্রায় সাড়ে ৪৩ শতাংশই কোটিপতিদের দখলে।

কিন্তু কোটিপতির সংখ্যা দিয়ে কি সুখ অর্জন করা সম্ভব? না, তা সম্ভব নয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে অর্থনীতির আকার ক্রমেই বড় হচ্ছে। প্রতি বছরই বাড়ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুণগত মান না বাড়ায় সমাজের একটি শ্রেণির কাছেই বেশি সম্পদ ও অর্থ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ জীবন-জীবিকার টানাপোড়েনে খাবি খাচ্ছে। মধ্যবিত্তরা দরিদ্র হচ্ছে, দরিদ্ররা দরিদ্রতর হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন যে কোনো দেশেই কোটিপতির সংখ্যা বাড়াটা উন্নয়নের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। তবে একই সময়ে যদি মানুষের মধ্যে বৈষম্য বাড়তে থাকে তাহলে অবশ্যই এই উন্নয়ন ইতিবাচক প্রভাবের তুলনায় নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।

ঠিক এমটাই ঘটছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ধনীরা যেভাবে আরও ধনী হচ্ছে, বাকি জনগণের পকেট কিন্তু সেভাবে ভরছে না। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ইব্রাহীম খালেদ সাহেব এক মন্তব্যে বলেছিলেন, উন্নয়ন তো হচ্ছে। যে প্রবৃদ্ধির কথা সরকার বলছে, সেটিও তো হচ্ছে। কিন্তু এই জিডিপি থেকে যে টাকা আসছে তার সুষম বণ্টন হচ্ছে না। যে জাতীয় আয় যোগ হচ্ছে, তা শতকরা মাত্র ৫ জন মানুষের হাতে আসছে। সেই পাঁচ ভাগ মানুষ প্রতি বছর আরও বড়লোক হচ্ছেন । বাকি ৯৫ শতাংশের কাছে সেই টাকা আসছে না। অর্থাৎ টাকা উপর থেকে নিচের দিকে নামছে না।

ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেছিলেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড হলো সুষম বণ্টনের দেশ। সবচেয়ে অসম বণ্টনের দেশ হলো আমেরিকা। আমরা আমেরিকার মডেল অনুসরণ করছি। তাই স্বাভাবিকভাবেই গরিব আরো গরিব হচ্ছে। এই কথার সূত্র ধরেই তাই হয়তো দেখতে পারছি সুখী দেশগুলোর তালিকায় সুষম বণ্টনের দেশগুলো এগিয়ে থাকলেও, আমেরিকা ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বেও এর অবস্থান ১৭ নম্বরে। কারণ সেখানে বণ্টন অসম।

আমাদের দেশে সম্পদের অসম বণ্টনের কারণেই সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের হাতে টাকা এবং জীবন চরম ভোগবাদিতায় পূর্ণ। অন্যদিকে বড় একটি অংশের দারিদ্র্য সমাজে ভয়াবহ রকমের অসন্তোষ তৈরি করছে। অধিকাংশ মানুষের ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্ট, আশাহীনতা- একটি দেশকে সুখী দেশ বানাতে পারে না।

মনের এই সুখহীনতা থেকেই দেশে বাড়ছে অপরাধ, হতাশা, মাদক, যৌনতা এবং সর্বোপরি দুর্নীতি। এই দুপক্ষই দেশের জন্য কোন মঙ্গল বা সুখ বয়ে আনতে পারে না। তাই সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে দেশের অধিকাংশ নাগরিক যখন অসুখী হন, তখন তা মেটানোর দায়িত্ব হওয়া উচিত সরকারের। এটাই সুশাসনের লক্ষণ।

রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তিজীবনেও আমাদের চাহিদার লাগাম টানা দরকার। আমাদের অতৃপ্ত আত্মা যদি প্রতিনিয়ত জীবনকে চালিত করে, তাহলে সুখ আসবে না ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে। সুখী মানুষের জামা গায়ে দেয়া মানুষ ছিলেন আমার বাবা। শত দুঃখ কষ্টেও আব্বা বলতো সুখী হতে চাইলে উপরের দিকে দেখবে না। কার, কী আছে, তা নিয়ে ভাববে না। দেখবে তোমার চেয়েও কষ্টে আছে কত মানুষ, অথচ তারা জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। তখন দেখবে নিজেকে সুখী মনে হবে।

আর তাই নানাধরনের অপ্রাপ্তির ভেতরে বসবাস করেও যখন দেখি, নগরের জীর্ণ বস্তিতে বসে মা তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করছেন, একজন প্রতিবন্ধী মানুষ যখন রাস্তা পারাপার হচ্ছেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েটি যখন সবকিছুকে পরাজিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখতে পারছে, রিকশা টেনেও একজন বাবা যখন তার সন্তানকে ডাক্তার বানাতে পারছেন, তখন ব্যক্তি আমাকে অনেক বেশি সুখী মনে হয়। মনে হয় ‘কী পাইনি, তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি’। হিসাব না করেও তো সুখী হওয়া যায়।


২৪ জুন, ২০২১

লেখক : সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

এইচআর/এএসএম