যেমন আওয়ামী লীগ দেখতে চাই
ঢাকার টিকাটুলির রোজ গার্ডেনে ১৯৪৯ সালের ২৩জুন জন্ম পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের। জনগণের দেহ মনের নিরঙ্কুশ স্বাধীন বিচরণের আকাঙ্ক্ষা পুরণে জন্ম নেয় দলটি। অনেক রক্তাক্ত পথ ধাপে ধাপে পাড়ি দিয়ে ৫৫ সালে আওয়ামী পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে চলে। তার আগেই ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জয় দিয়েই শুরু হয় মিশন। ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ। দীর্ঘ প্রক্রিয়াটির নির্মাতা আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসের নির্মম ট্র্যাজেডি, ভাঙাগড়া পিচ্ছিল পথ অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। এতো ত্যাগ হয়তো বিশ্বের কোন রাজনৈতিক দল কখনও করেনি। শুধু আদর্শ আর সাংগঠনিক শক্তি দিয়েই আওয়ামী লীগ টিকে আছে। আওয়ামী লীগের শক্তি তরুণে গড়া ছাত্রলীগ। তারুণ্যের শক্তিই শেকড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে আওয়ামী লীগকে। এজন্য বিজয়গুলো আসতে বাধ্য হয়েছে। তরুণ শেখ মুজিব আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যা রচনা করেছেন মুক্তির মাধ্যমে পরিপূর্ণ বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হওয়ার মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছেন।
এতো অর্জনেও কি শক্ররা বসে ছিল, নাকি খুশি ছিল? না কোনটিও নয়। ৭৫ এর ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে বাঙালিদের দীর্ঘ জয়ের ইতিহাসের প্রতিশোধ নিয়েছিল পরাজিত শক্তিরা। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন এমনকি অনেক আওয়ামী লীগ নেতারাও, উৎশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটনায়। এটা ইতিহাসের ভুল পাতার ব্যাখা। পাকিস্তান পন্থী বিদেশি রাষ্ট্র, দেশীয়ও সকল পর্যায়ের পরাজিত শক্তির সম্মিলিত ষড়যন্ত্র এটা। আরো ছিল আওয়ামী লীগের অতিলোভী ক্ষমতাভোগী শ্রেণি।
এসময় আওয়ামী লীগে ঘটে ছন্দপতন! বড় বড় নেতা বনে যাওয়ারাও ক্ষমতার স্বাদ পেতে যায় মুশতাক, মেজর জিয়ার দুয়ারে। অনেকেই চুপচাপ। খুনিদের নিষেধাজ্ঞায় বঙ্গবন্ধু। প্রশাসন, সংবাদ মাধ্যম, সুশীল, শুভাকাঙ্ক্ষীরা রাতারাতি চেঞ্জ। এটা ছিল সাময়িক। কারণ আওয়ামী আদর্শ ও জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এমন এক ওয়েট ফুল আদর্শ যা সবাই সহজে বহন করতে পারে না। পারলেও ধারণ করা কঠিন। ধারণ করলেও মুখে আসে না। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এদেরই বিচ্যুতি হয়েছে, ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে।
ক্ষমতার লোভ আর ব্যক্তি স্বার্থে লিপ্ত হয়ে আওয়ামী লীগ আদর্শ থেকে খন্দকার মুশতাক, মওলানা ভাসানী, সিরাজুল আলম খান, ড.কামাল, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রউফ, মাহমুদুর রহমান মান্না, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, শফিউল আলম প্রধান,হাবিবুর রহমানরা বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে পারেননি। লাভ হয় নি। দেশীয় ভাবধারার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ আওয়ামী লীগের মন্ত্র। পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। কেউ বিচ্ছিন্ন হলেও আওয়ামী লীগ আদর্শই আওয়ামী লীগকে বয়ে নিয়ে যাবে যুগ থেকে যুগান্তর।
পঁচাত্তর হত্যাকান্ড, পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার। ইতিহাস বিকৃতির লীলাখেলা। অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগের বেহাল দশা। ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। পরিস্থিতির এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহর রহমতে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা ৮১ সালের ১৭ই মে প্রতিকূলতার বেড়াজাল ভেঙে বাবার দেশে। তরুণ শেখ হাসিনার উপর আস্থা ছিল সকলের। আওয়ামী লীগকে ধরে রাখতে বঙ্গবন্ধু কন্যাকেই সবাই ঐক্যের প্রতীক মেনে নিয়েছিল। জিয়াউর রহমান সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে। পাকিস্তান থেকে রাজাকারদের নিয়ে এসেছে, প্রতিষ্ঠিতও করেছে।
প্রতিকূল ধ্বংসাত্মক মুহুর্তেও আওয়ামী লীগ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রথমত বঙ্গবন্ধুর আর্দশ ফেরাতে হলে আগে সংগঠনকে পুনর্জ্জীবিত করতে হবে। আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব ফেরাতে হবে। সবেমাত্র ৩৪ বছর। এই তরুণ বয়সে দলের সভাপতি। তাতে কি? তিনি তো বঙ্গবন্ধু কন্যা। শৈশব থেকে তরুণকালেই তো আওয়ামী লীগ নির্মাতা, বাংলাদেশের নির্মাতা বঙ্গবন্ধুকে স্টাডি করা শেষ। তাই তো তাঁর উপর সকলের আস্থা। পারলেন আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগের জায়গায় ফেরাতে। শত কষ্ট হয়েছে। বাধা উপেক্ষা করতে হয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে বহুবার। পিচ্ছিল পথে পা শক্ত করে হেটেছে। তবুও অগ্রসর হয়েছে সামনে।মেজর জিয়ার পর খালেদা জিয়া আর তারেক জিয়া হত্যার শত চেষ্টা করেছে। রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে সাংগঠনিক ভিত শক্ত করে ২১ বছর পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। মাঝ পথে আবার ধাক্কা।
২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলার মিশন। ঘুরে দাঁড়িয়ে জনগণের প্রত্যাশায় জনগণের সেবায় আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। তথ্য প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশ। আজকের বাংলাদেশের যে বিপুল পরিমাণ উন্নয়ন তা তরুণ শেখ মুজিবের ফর্মুলার বহিঃপ্রকাশ। গ্রাম হয়েছে শহর। ভিক্ষুক জাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, হয়েছে মালিক। পাতায় পাতায় লিখে যাওয়া সূত্রের প্রয়োগ। বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ফিরিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করছেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা, "অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন" বইগুলো জাতিকে সত্য জানার সুযোগ দিয়েছে। এই অসম্ভব কাজটিও করেছে শেখ হাসিনা। করোনা মহামারীতে বিশ্ব তছনছ হলেও বাংলাদেশের মানুষের জীবন জীবিকায় তার প্রভাব ফেলতে দেন নি।
আলোচনা তো সবই হলো। যার জন্য এই আলোচনা তাদের করণীয় কি? তাদের আকুতি কি আওয়ামী লীগের কাছে? তরুণ জনগোষ্ঠী আগামীতে কেমন আওয়ামী লীগ দেখতে চায়। ৭১ পেড়িয়ে ৭২ এ আওয়ামী লীগ। ৭২ বছরে ঘটে যাওয়া সকল সত্য বিশুদ্ধ ইতিহাস তরুণদের সামনে তুলে ধরতে হবে আওয়ামী লীগ অগ্রজদের। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বিশ্বাসঘাতকদের সম্পর্কে তাদের সামনে পরিস্কার চিত্র তুলে ধরতে হবে। তাদের জানাতে হবে এই ঘরে বিশুদ্ধ আর দুষিত কারা। রাজাকার আল-বদর আলশামস স্বাধীনতা বিরোধীদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পৌঁছে দিতে হবে। জানতে হবে মেজর জিয়া আর জেনারেল এরশাদ কি করেছে? ১/১১ এ কার কি ভূমিকা ছিল, কেন বারবার বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনাকে হত্যার টার্গেট? আওয়ামী লীগের উপর কেন দেশী বিদেশী চক্রের বিষ চোখ? তা অগ্রজদের দায়িত্ব নিয়ে তরুণদের সামনে তুলে ধরতে হবে। যেসব রাজাকারদের ফাঁসি হয়েছে। ফাঁসির পর দেখা গেল তাদের কবরে লেখা শহীদ, নিহত মেজর জিয়াউর রহমানের নামের সামনে শহীদ। নিহত জঙ্গিরাও লিখছে শহীদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতভাবে উপস্থাপন। এসব বিকৃত ইতিহাস যাতে তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে না পারে সেজন্য আওয়ামী লীগ অগ্রজদের দায়িত্ব নিতে হবে।
তরুণদের অধিকার পরিমাণ আলোচনা, পর্যালোচনার সুযোগ দিতে হবে। দেশের হাল তরুণদেরই ধরতে হবে। তরুণদের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী হতে হবে। কেন আওয়ামী লীগ অপরিহার্য অনুধাবন করতে হবে। আন্দোলন-সংগ্রাম, গৌরব, অর্জন বলতে সবই আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ৭২ বছরে আন্দোলন সংগ্রাম অর্জনে শক্তি তরুণরা। তাই যুগ থেকে যুগান্তরে টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগে তরুণদের গতিশীলতা,সম্পৃত্ততা ও কাজের অধিকার পরিমাণ সুযোগ দিতে হবে।
উন্নয়নের এই মহা বিপ্লবে আদর্শহীন, দুর্নীতিবাজ তথাকথিত নেতাদের দেখতে চায় না তরুণরা। মৌলবাদী জামায়াত শিবির আর হেফাজতের বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে তরুণদের। তাহলেই আওয়ামী লীগ আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে যুগ থেকে যুগান্তর। দুঃসময়ে রক্ত দেয়া নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছাড়া যেমন আওয়ামী লীগ অচল তেমনি শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগ অস্তিত্বহীন। জন্মদিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ১৫ই আগস্টে শহীদ, জাতীয় চার নেতা, ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ মা বোনসহ আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের রক্ত দেয়া নেতাকর্মীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক গণিত বিভাগ, সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও পরিচালক, বঙ্গবন্ধু চর্চাকেন্দ্র বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগ।
এইচআর/এমএস