কোন্দলের খপ্পরে রাজনীতির মাঠ
বাংলাদেশের রাজনীতিকেও করোনায় আক্রমণ করেছে, এমনটাই বলছেন কেউ কেউ। মহামারির কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রায় বন্ধ। তবে ঘরোয়াভাবে এবং ভার্চুয়াল সংযোগ হওয়ার মাধ্যমে রাজননৈতিক নেতাকর্মীদের যোগাযোগ ঠিক থাকলেও কোন্দলজনিত কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি যেন নেতিয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, নেতাদের কেউ কেউ এলাকায় কাজ করছেন। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে কাজের সুফলকে গায়েব করে দিচ্ছে দলগুলোর ভিতরের কোন্দল। অনেকে মনে করেন, দলীয় কর্মকাণ্ড স্থবির হওয়ায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারছেন না তারা। বরং কাজ না থাকায় অকাজেই ঝুঁকছেন স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এ বিভেদ শুধু যে তৃণমূল পর্যায়েই তা নয়, কেন্দ্রীয়ভাবেও দেখা যায় বিভিন্ন দলের মধ্যে।
কিছুদিন আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া নিয়ে মন্তব্য করে দলের ভিতরকার অবস্থা প্রকাশ করে দেন, যা সব গণমাধ্যমে গুরুত্বসহ প্রকাশ পায়। স্পষ্ট হয়ে যায়, বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়েই বিভিন্ন ইস্যুতে বিভাজন স্পষ্ট। জেলা পর্যায়ে এ অবস্থা আরও প্রকট। বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অর্ধশতাধিক জেলা কমিটিই তারা গঠন করতে পারেনি। যেসব জেলায় আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছিল সেখানে পূর্ণাঙ্গ কমিটিও করা সম্ভব হয়নি। ফলে কোথাও কোথাও আহ্বায়ক কমিটি কাজ করছে। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সাংগঠনিক এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রধান কারণ নেতৃত্বের কোন্দল।
শুধু তৃণমূল নয়, কেন্দ্রীয় পর্যায়েও যে এর প্রভাব পড়েছে তা বোঝা যায় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কার্যক্রমেও। অন্যদিকে তৃণমূলে সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী না হওয়ায় তারা কেন্দ্রীয় কমিটিও করতে পারছে না। জাতীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে তিন বছর আগে। বলা হচ্ছে, করোনাজনিত কারণে জাতীয় কাউন্সিল করতে পারছে না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, করোনা শেষেও তাদের পক্ষে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি করা বেশ কঠিনই হবে। দীর্ঘদিন ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা দলের কর্মীদের মধ্যে হতাশার পাশাপাশি কোন্দল মিটিয়ে ফেলার কার্যকর পদক্ষেপও গ্রহণ করছে না কেন্দ্রের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে যুবদল, মহিলা দল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হছে অনেক আগেই। দল ভাঙার ভয়ও কাজ করছে এক্ষেত্রে।
আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তারা বলেন, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বেশুমার মামলা চলছে, কাদের নিয়ে তারা কমিটি করবেন। তাদের এই যুক্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বিরোধী দলে থেকে কেউ কি এমন পরিস্থিতিতে পড়েননি। পাকিস্তান আমলের প্রায় পুরো সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। কিন্তু দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ থাকেনি। এমনকি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে জেলা পর্যায়ের নেতাদেরও জেলে ঢুকতে হয়। কেন্দ্রে সংগঠনকে পরিচালনা করতে হয় আমেনা বেগমকে।
স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালের কথাও যদি ধরা হয়, তখনও দেখা যায় ভিন্নভাবে দলটি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। দলের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, এমনকি জাতীয় চার নেতা যারা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বিশাল দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন তাদেরও হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগের ওই দুর্যোগের তুলনায় বিএনপির বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্যই তুলনীয় নয়। সুতরাং তাদের উত্থাপিত যুক্তিকে যথাযথ বলার মতো নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সাংগঠনিক এ দুর্বলতা নেতৃত্বের ব্যর্থতা নয় কেন?
আসলে যোগ্য নেতৃত্ব না থাকলেই দলের ভিতর কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহর একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি প্রায়ই বলেন, লন্ডনে বসে নির্দেশনা দিলেই বিএনপির আন্দোলন সফল হবে না। বিএনপি মুখে মুখে সরকারের পতন চাইলেই শেখ হাসিনা বিএনপির জন্য ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন না। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, কোনো কাজ না থাকায় নেতারা নানা ইস্যুতে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন। আন্দোলন নেই বলে একে অপরের পেছনে লেগে আছে। মাঠে থাকলে নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা সৌহার্দ তৈরি হতো।
আন্দোলন প্রশ্নেও তাদের মধ্যে বিভেদ প্রকাশ্য। কিছুদিন আগে দেখা গেল, মেজর হাফিজউদ্দীন বীরবিক্রম (অব.) এবং শওকত মাহমুদ কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশ ছাড়াই সাম্প্রদায়িক একটি শক্তির আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের বাইরে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করায় তাদের বিরুদ্ধে চিঠিও ইস্যু করা হয়েছিল বিএনপি দফতর থেকে। মির্জা আব্বাসকেও সাংগঠনিক নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে চিঠি পেতে হয়েছিল। সাংগঠনিক বিপত্তি থেকে রক্ষা পেতে কারণ দর্শানো কিংবা ব্যাখ্যা চাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছিল দলটিকে। বাস্তবতা হচ্ছে, দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের বিভাজনের কারণে সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী হচ্ছে না, তা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
বিএনপির কোনো কোনো নেতা এ বিভাজনকে মতভিন্নতা হিসেবে দেখছেন। অন্তত পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ দেখে এমনটা মনে হয়। মতভিন্নতা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে স্বাভাবিক। কিন্তু দলীয়ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়, এমন কোনো মতভিন্নতাকে নিশ্চয়ই গণতান্ত্রিক ধারাভুক্ত বলার সুযোগ থাকে না। দলীয়ভাবে বিএনপি হেফাজতে ইসলামকে যেখানে প্রতিপক্ষ মনে করে, সেখানে এই নৈতিক অবস্থানকে অমান্য করে কোনো সিনিয়র নেতা প্রতিপক্ষের কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারটি আর স্বাভাবিক মতভিন্নতা পর্যায়ে থাকে না। বাস্তবতা হচ্ছে, তাই হয়েছে। অন্যদিকে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস যখন ইলিয়াস আলীর বিষয়ে দলীয় অবস্থানের বিপক্ষে প্রকাশ্য মন্তব্য করেন তখন আর সেটি মতভিন্নতা থাকে না। বরং বিরোধিতা হিসেবেই চিহ্নিত হয়, যা দলকে এখন ভোগ করতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের অবস্থা কি মসৃণ? আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে মতভেদগুলো প্রকাশ্য নয়। সাংগঠনিকভাবে হয়তো তাদের ভিন্নমত প্রকাশ হয়েও থাকতে পারে। কিন্তু জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কোন্দল কম নয়। বরং কোথাও কোথাও ছোটখাটো মারামারি থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ডও ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত থাকলেও সংগঠনকে এর দায় বহন করতে হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও হস্তক্ষেপ করতে হয় মাঝে মাঝেই। মাস কয়েক আগে দলীয় প্রধান বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করেছেন একই কারণে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কোন্দল মিটিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বাস্তবতা হচ্ছে, জেলা পর্যায়ের কোন্দল নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর বরাদ দিয়ে ১৩ জুন পত্রিকাগুলো সংবাদ করেছে তৃণমূল পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল লাগামছাড়া হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের সভায় শেখ হাসিনা নির্দেশ প্রদান করেছেন সাংগঠনিক সম্পাদকরা যেন গুরুত্বসহ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন।
কোন্দলের কারণে কোনো কোনো জেলার নেতাদের হানাহানির সূত্র ধরে কারাগারে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। একটি জেলার কমিটির জন্য জেলা থেকেই একাধিক তালিকা এসেছে কেন্দ্রে। এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রের নির্দেশনা না মানার উদাহরণও আছে। ওইদিনই ফরিদপুর শহর কমিটির কথা আলোচনায় আসে। সেখানে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুইজনকেই অব্যাহতি দেওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সেখানেও প্রকাট দ্বন্দ চলমান। আওয়ামী লীগ প্রধান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন ফরিদপুর শহর কমিটির জন্য যে তালিকা দেওয়া হয়েছে তার একটিকেও অনুমোদন দেওয়া হবে না। বিতর্কিত চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজ কোনো ব্যক্তি যেন কমিটিতে স্থান না পায় সেই বিষয়েও তিনি নির্দেশ প্রদান করেছেন।
এমন পরিস্থিতি ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন জেলাতেই রয়েছে। কক্সবাজার জেলার এমপি জাফরউল্লাহর বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিবৃতি এবং সেই আলোকে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ তো অতি সাম্প্রতিক ঘটনা।
সাম্প্রতিক আলোচনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি কেড়েছে নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জ এর আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা কাদেরের বেফাঁস বক্তব্য ও সেখানকার হানাহানির ঘটনা। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের ভাই হিসেবে তার কর্মকাণ্ড অনাকাঙ্ক্ষিত বললেও কম বলা হবে। তিনি স্থানীয় কোন্দলকে জিইয়ে রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককেও বাক্যবাণে জর্জরিত করতে কসুর করছেন না। সেখানেও খুনোখুনির মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। আজকের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে বলতে হবে- মির্জা কাদের আওয়ামী লীগের জন্য বিষফোঁড়ার মতো।
এমন পরিস্থিতিতে যদি করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটে তাহলে যে এই দলাদলি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা যাচ্ছে না। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কোন্দল তাদের দলেরই ক্ষতি করছে না। বরং তৃতীয় শক্তির উদ্ভবের পথ করে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময় দেখা গেছে সাম্প্রদায়িক একটি গোষ্ঠী আন্দোলনের নামে জ্বালাওপোড়াও করে সারাদেশকে তটস্ত করে দিয়েছিলো। গণতান্ত্রিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ঐক্য না এলে এর ফল জাতীয় রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।
এইচআর/জিকেএস