বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার আগে জেনেছি, পড়ার সময় বুঝেছি এবং এখনও অনুধাবন করি- ক্যাম্পাসে শিক্ষা শুধু ক্লাসরুম বা আলোচনা-কক্ষে হয় না, হয় মিছিলে স্লোগানে, গান আর নাটকে, খেলাধুলায়, ক্যান্টিনে, চায়ের দোকানে। বিশ্ববিদ্যালয় মানে বড়’র সাধনা যেখানে নিরন্তর চলবে যুক্তি-প্রতিযুক্তির আদানপ্রদান।
আমি আশির দশকের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এমন একটা পরিবেশ দেখেছি। সন্ত্রাস সহিংসতার মতো খারাপ পরিবেশও আমাদের ভুগিয়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যেমন ছিল, ছিল ক্রীড়া ও সংস্কৃতির চর্চা। কিন্তু আরও বেশি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা। রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মতাদর্শের তর্ক করার পরিবেশ ছিল।
আমরা আমাদের শিক্ষকদের কাছে শিখেছিলাম যে, কোনো ব্যক্তি, মতাদর্শ বা চিন্তাই প্রশ্নাতীত নয়। সবাইকেই প্রশ্ন করা যায়, সবাইকে নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়। প্রশ্ন ও উত্তরের আদানপ্রদান, বিতর্কের মাধ্যমেই সত্যকে জানা সম্ভব। সত্য জটিল এবং গভীর। বিশ্ববিদ্যালয় শেখায় সত্যের সন্ধানে যুক্তিতে থাক, নির্ভয়ে প্রশ্ন কর, এমনকি শিক্ষকদেরও প্রশ্ন করো। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়নেই শিক্ষকদের পদন্নোতি হয়।
পঠনপাঠন ও গবেষণার অগ্রগতির ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী যে র্যাংকিং হয় সেখানে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। কিন্তু তবুও বহু কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতির জীবনে, বিশেষ করে মুক্তচিন্তার মানস ঘটনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
প্রশ্ন হলো সেই বিশ্ববিদ্যালয় কেন এখন প্রশ্নকে ভয় পায়, সমালোচনা বা বিদ্রূপকে ভয় পায়? কথাগুলো এ কারণে উঠছে যে, আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় এই বিদ্যাপীঠ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইনি পদক্ষেপ নেবে। কর্তৃপক্ষ বলছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা হেয়প্রতিপন্ন না হয় সেজন্য এমন সিদ্ধান্ত।
আন্তর্জাতিক তো বটেই, জাতীয় পর্যায়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কি ভাবমূর্তি আছে সে প্রশ্ন আর করলাম না। একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমার শুধু এটুকুই জিজ্ঞাসা মাননীয় উপাচার্যের কাছে, শতবর্ষের মাথায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এতটা অসহিষ্ণু হয়ে গেল? বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান, উপাচার্যও প্রতিষ্ঠান। সামান্য ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার প্রধান যদি মামলার হুমকি দেন তাহলে এর শিক্ষার্থীরা উদারতার পাঠ কোথায় পাবে?
গণতন্ত্রে বিরুদ্ধ মতো শোনা আবশ্যিক। গণতন্ত্র ও পরমতসহিষ্ণুতার অনন্য পাঠ আমরা পাই বিশ্ববিদ্যালয় ও এর শিক্ষকদের কাছ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় বললে তো এই পরিসরটির কথাই মনে হয়। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কেন সামরিক ফরমানের মতো এমন বিজ্ঞপ্তি দেয়? কিছুদিন আগেও দেখেছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ তার ছাত্র-ছাত্রীদের হুশিয়ার করে দিয়ে এমন বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সেই নোটিশেও এই ভাবমূর্তির প্রসঙ্গই আনা হয়েছে। কিন্তু ভাবমূর্তির দোহাই দিয়ে কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা প্রকৃতপক্ষে মতপ্রকাশের পরিসরকে ছোট করা।
ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয় আচরণে। বিশেষ করে শিক্ষকরা তাদের শুদ্ধ ভাবমূর্তি তৈরি করেন জ্ঞান আর ব্যক্তিত্ব প্রকাশের মাধ্যমে। যে শিক্ষকের কথা শুনতে ভাল লাগে, যার উচ্চারণ শুদ্ধ, যার জ্ঞান আর উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তার শিক্ষার্থীদের আলোড়িত করে তারাইতো আসল শিক্ষক। একটা কথা মনে রাখতেই হবে, শিক্ষক মানেই তার আচরণের পোস্টমর্টেম করবে তার ছাত্র-ছাত্রীরা। আর বড় বিদ্যাপীঠের বড় শিক্ষক প্রশাসকের আচরণের সামাজিক পোস্টমর্টেম হবে সেটাতো স্বাভাবিক। এতে এত বিচলিত হলে চলে?
ভাল শিক্ষক নিজেকে উজাড় করে দিতে পারেন শ্রেণিকক্ষে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজকে আলোড়িত করেন মানুষের মুক্তির দিশারি হয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি আছে। আর রাজনীতি মানে মানে আলোচনা, যুক্তি-প্রতিযুক্তি। রাজনৈতিক নেতা বা সংগঠন সেই চর্চা করুক বা না করুক, বিশ্ববিদ্যালয়তো করবে, তার উপাচার্য করবেন, উপাচার্যের সহকর্মীরা করবেন।
সমালোচনা করা, ব্যাঙ্গ করা মানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করা, এই ধারণা পোষণ করা মারাত্মক। বিশ্ববিদ্যালয় মানুষকে সাহস জোগায়, নাগরিকদের নিজের বোধের প্রতি অনড় বিশ্বাসের ভিত্তি গড়তে এগিয়ে আসে। বার বার অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ সংগঠিত করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাই ডিজিটাল প্লাটফর্মে কিছু ব্যঙ্গ বিদ্রুপের অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে মামলাবাজ হওয়া মানায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নমুখী মান নিয়ে অনেকদিন দিন ধরেই দুর্ভাবনা ও সমালোচনা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় সেটা নিয়ে ভাবলে জাতির উপকার হয় বেশি। ক্লাসরুমই জ্ঞান অর্জনের একমাত্র স্থান, শিক্ষকদের লেকচার ছাত্রদের কাছে বেদবাক্যের মতো পৌঁছে গেলেই চলে? সেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আবারও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে উন্নীত করার প্রচেষ্টা বেশি প্রয়োজন।
আমরা শিক্ষকদের সম্মান করি। শিক্ষকদের অসম্মান করে সমাজ এগুতো পারে না। কিন্তু সবাই নিশ্চয়ই মানবেন যে, শি ক্ষকদেরও মূল্যায়ন প্রয়োজন। আশা করি তারা বুঝবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কেবল একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়। শিক্ষকতা কেবলই রাজনৈতিক কিঙ্করতার আর এক নাম যেন না হয়, তবেই এই পেশাকে স্বর্ণালি ভাববার সুযোগ থাকবে।
এইচআর/এমএস