ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রোহিঙ্গা সঙ্কট : দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১১:০৪ এএম, ১৭ জুন ২০২১

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন

ইতিহাস বলে রোহিঙ্গারা আরাকানের ভূমিপুত্র। ১৭৮৫ সালের আগে আরাকান ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম অঞ্চল। ১৮২৬ সালের অ্যাঙ্গো-বার্মিজ যুদ্ধের পরই আরাকান ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত বার্মার অংশ হয়। কিন্তু ১৯৮৫ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে তৎকালীন সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব বাতিল করে। যদিওবা রোহিঙ্গা সঙ্কটের শুরু তারও আগে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের নারকীয় গণহত্যা চালায় বার্মিজ ও রাখাইনরা। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ গণহত্যা শুরু হয়। এর আগে ২০১২ সালে এক রাখাইন নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে এসেছে প্রায় ৬-৭ লাখ রোহিঙ্গা, সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের ক্যাম্পে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। যদিও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নভাবে মিশে গেছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে তার কোন নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান বাংলাদেশ সরকারের কাছে নেই।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের মতো সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা জাহাজকে ফের জাহাজে ঠেলে দিতে পারেনি বাংলাদেশ। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল মানবিক বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানবিক আচরণ ও আশ্রয় সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু এখন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আশু জরুরি। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটা দেশের পক্ষে ১ মিলিয়নের অধিক রোহিঙ্গার দীর্ঘমেয়াদে চাপ সামাল দেয়া অসম্ভব। রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট ধীরে ধীরে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ইস্যু হয়ে উঠছে। ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জোর দেওয়া দরকার।

আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশ সে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে আশানুরূপ সহযোগিতা করছে না। জাতিসংঘ ও মানবধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর চলা জাতিগত নিধন নিয়ে সোচ্চার হলেও প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে প্রয়োজনীয় চাপ দিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিবৃতিতে সোচ্চার হলেও তাদের ফান্ডেড সংগঠন আইএমএফ ঠিকই মিয়ানমারকে অর্থসহায়তা দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ইউরোপের দেশসমূহ মিয়ানমারে বিনিয়োগ করছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বরং বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে হস্তান্তর না করতে। এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একরোখা আচরণ। কক্সবাজার বাংলাদেশের পর্যটন ও ব্যবসায়িকভাবে সম্ভাবনাময় অঞ্চল। দীর্ঘমেয়াদে ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখানে রাখলে পর্যটন, পরিবেশ ও নিরাপত্তাজনিত হুমকি তৈরি হবে। প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক প্রয়াত তারেক শামসুর রেহমান টক শো’তে ক্ষোভের সাথে বলেছিলেন, আমাদের একটা নয় ১১টা ভাসানচর দরকার। কেননা রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে পাহাড় ও গাছ কাটার ফলে কক্সবাজার পরিবেশ ও জলবায়ু দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। মাদক, নারীপাচার, খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।

কক্সবাজার পুলিশ প্রশাসন বলছে, আগস্ট ২০১৭ থেকে মে ২০২০ এর মধ্যে ৫৮ হাজার রোহিঙ্গাকে ক্যাম্প থেকে পালানোর সময় গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া এই সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলছে, নানা অপরাধে আগস্ট ২০১৭ থেকে আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৬৪ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে ৭২৫টি মামলা হয় কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায়। এছাড়া এ সময়ে নারীসহ ১০৩ জন রোহিঙ্গা পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো কক্সবাজার অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে রোহিঙ্গাদের ভাষাগত ও শারীরিক গঠনে মিল থাকায় ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে তারা মিশে যাচ্ছে, যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ধরনের একটি সঙ্কট স্থায়ী হয়ে পড়বে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় আমার একটি গবেষণা ছিল, ‘শরণার্থীদের সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া’ নিয়ে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে রোহিঙ্গাদের মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় যেসব কেস স্টাডি পেয়েছিলাম তার মধ্যে ধর্মীয় টান, রোহিঙ্গাদের সাথে চট্টগ্রামের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতিতে মিল, রোহিঙ্গাদের সস্তা শ্রম ও আগে থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোনভাবে জায়গা করতে পারা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্য রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার মানসিকতা অন্যতম। অনেকেই ক্যাম্প থেকে বের হয়ে গিয়ে বা সরাসরি আরকান থেকে চট্টগ্রামে ঢুকে পড়ে নানা কৌশলে আশ্রয় নিচ্ছে স্থানীয় মানুষদের বাড়ি বা জনবসতিহীন পাহাড়ে।

এ বছরের শুরুতে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার স্থানীয় এক জাপা নেতাকে রোহিঙ্গারা মেরে নর্দমায় ফেলে রেখে চলে যায়। ভদ্রলোক মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গা যুবককে তার খামারে কাজ দিয়েছিলেন কিন্তু রোহিঙ্গা যুবকরাই তাকে মেরে ফেলল। রোহিঙ্গারা যেহেতু এদেশের নাগরিক না ফলে এদেশের আইন দিয়ে বিচার করাও সম্ভব নয়। তাছাড়া নির্দিষ্ট স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় তারা এক জায়গায় ক্রাইম করে অন্য জায়গায় আশ্রয় নেয়। ভাষাগত, ধর্মীয় মিল ও সস্তা শ্রমের জন্য স্থানীয়রা নানাভাবে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে আশ্রয় দিচ্ছে। এভাবে ক্যাম্পের বাইরে তাদের আশ্রয় দেওয়া দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকি মুখে ফেলছে।

গবেষণায় বুঝতে পেরেছিলাম রোহিঙ্গারা নিজেদের জাতি ভাইদের নিয়ে নিজস্ব নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকে সবসময়, সেটা ক্যাম্পে বা ক্যাম্পের বাইরে। ফলে তাদের এই মানসিকতা ও নেটওয়ার্ক স্থানীয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করলে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থায়ী অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এছাড়া রোহিঙ্গারা যেহেতু নির্যাতিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদে তারা এখানে থাকলে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয়ে পড়তে পারে। ফলে শান্ত চট্টগ্রামের পাহাড় আবার অশান্ত হয়ে ওঠার ঝুঁকি রয়েছে।

২০১৯ সালে সরকারি এক হিসাবে ২০ মাসে ১ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর জন্মের কথা বলা হয়। সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, প্রতিদিন ১৩০ জন রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম নিচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন রোহিঙ্গা সংখ্যা বাড়ছে। তার মানে মিয়ানমার প্রতি মাসে ৫ হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিলেও রোহিঙ্গার সংখ্যা ক্যাম্পে সমান থাকবে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অধিক শিশু জন্মদানের প্রবণতা রয়েছে। কারণ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে তাদের মধ্যে ট্যাবু ধারণা রয়েছে। এছাড়া পরিবারের সদস্য সংখ্যার ওপর নির্ভর করে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দেয়ার একটা পদ্ধতি রয়েছে। ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, স্থানীয়দের সাথে শরণার্থীদের মিশে যাওয়ার পাশাপাশি অধিক রোহিঙ্গা জন্মদানও একটা সঙ্কট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আইএনজিও বা বাংলাদেশ সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের বাল্যবিয়ে, কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের সচেতন করা। নতুবা দিন যত যাবে জ্যামিতিক হারে বাড়তেই থাকবে রোহিঙ্গা।

সবার আগে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেই গুরুত্ব দিতে হবে। যদিওবা প্রত্যাবাসন নিয়ে আমাদের সামনে শুধুই আশাহত খবর। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা আগালেও মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সে প্রক্রিয়াকে আবারও আটকে দিয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ। মিয়ানমারের প্রতিবেশী ও এশিয়ার দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারত ও চীন তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নায্য অবস্থান নিচ্ছে না। ভারত-চীন-বাংলাদেশ- মিয়ানমারের জোট বিসিআইএমের ভবিষ্যৎ আটকে যাওয়ার পর ভারত এখন ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়ক নির্মাণে নজর দিচ্ছে।

ভারত বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘পূর্বমুখী নীতি’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আসিয়ানের বাজার ধরতে চায়, সেই সাথে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহকে বিশ্বের সাথে যুক্ত করতে চায় নয়াদিল্লি। সেক্ষেত্রে মিয়ানমারের ভূমি ব্যবহার ছাড়া বিকল্প নেই। এছাড়া ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে চুপ রয়েছে কারণ ভারত মিয়ানমারের ভূমি ও সমুদ্র পথ ব্যবহার করে কালাদান প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে চায়। এই কালাদান প্রজেক্ট ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহকে কলকাতা বন্দরের সাথে যুক্ত করবে। ফলে ভারতের চিকেন নেক নির্ভরতা কমবে।

অন্যদিকে চীনের রয়েছে আরও বহুল ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। চীন মিয়ানমারের ওপর দিয়ে তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করছে। এছাড়া রাখাইন রাজ্যে নির্মাণ করছে গভীর সমুদ্রবন্দর। মিয়ানমারের ওপর দিয়ে যাচ্ছে চীনের বিআরই করিডোর। মিয়ানমারের চীনের এসব প্রকল্প চীন তেল গ্যাস আমদানির জন্য মালাক্কা প্রণালি ডিলেমা গুছাবে। নিজ নিজ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে চীন ও ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের গণহত্যা নিয়ে একেবারে চুপ, উল্টো চীন জাতিসংঘের ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সামনের দিনে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে দৃঢ়তার সাথে প্রস্তুত হতে হবে বাংলাদেশকে।

লেখক : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সাউথ এশিয়ান (সার্ক) বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি।

এইচআর/ফারুক/এমএস