ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

৬ দফা নিম্নবর্গকে আন্দোলনের কেন্দ্রে নিয়ে আসে

ড. মিল্টন বিশ্বাস | প্রকাশিত: ০১:৫৫ পিএম, ০৭ জুন ২০২১

১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের কৌশলে জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। সেই জনতার অধিকাংশই ছিল নিম্নবর্গ জনগোষ্ঠী। ছাত্ররা ছিল কৃষিভিত্তিক বাংলার সাধারণ পরিবারের সদস্য, এছাড়া শ্রমিক জনতার সম্পৃক্ততা ৬ দফাকে এক দফায়(স্বাধীনতা) পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে এদেশের বামপন্থী রাজনীতির জায়গায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় সূচিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতাকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এনেছিলেন নিজে আত্মত্যাগের রাজনীতি করে।

২.
১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীকালে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন। পুনরায় তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সূচনা ঘটে ছয় দফাকে কেন্দ্র করে। প্রস্তাবিত ছয়-দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছয়-দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা পূর্ববাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাঁকে সিলেট, যশোহর, ময়মনসিংহ ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বার বার গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিব এ বছরের প্রথম তিন মাসে আট বার গ্রেফতার হন।

এবার তিনি একনাগাড়ে প্রায় তিন বছর কারাবাস করেন। ৭ জুন বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে এবং ছয়-দফার সমর্থনে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। হরতালের সময় ঢাকার তেজগাঁও, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে মনুমিয়াসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। এই দিনই বাঙালির আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ছয়-দফা বাংলাদেশের মহাসনদে (ম্যাগনাকাটা) পরিণত হয়। এই ছয় দফার ফলাফল হলো ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধুর জেলমুক্তি, এর ফলাফল হলো সত্তরের নির্বাচনে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের জয় লাভ, আর তারপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার শেষ পরিণতি অর্জন। ৬ দফার শেষ দফায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তিনি মানুষের খাদেম; জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাকি জীবন ত্যাগ করতে পারবেন। তিনি ১৯৬৬ সালে কারাগারে থেকেও দেখেছিলেন ছয় দফা দাবির জন্য মানুষকে রক্ত দিতে এবং আন্দোলন পরিচালনা করতে।

৩.
বঙ্গবন্ধুর নিজের দিনপঞ্জি ‘কারাগারের রোজনামচা’ পাঠ করলে তৎকালীন সময় ও ইতিহাসে নিম্নবর্গ যেভাবে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল তার অনুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায়। জুনের ২ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব বয়ানে ছয় দফা আন্দোলনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত, শাসকের অন্যায় আচরণ আর নেতাকর্মীদের আত্মত্যাগের কথা হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে।

৬ দফাকে জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবি হিসেবে চিহ্নিত করে চীনপন্থীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ২ জুন লিখেছেন-‘ন্যাপ নেতা মিঃ মশিয়ুর রহমানের ফটো দিয়ে একটা সংবাদ পরিবেশন করেছে। ইত্তেফাক ও অন্যান্য কাগজেও খবরটি উঠেছে। তিনি ছয় দফার দাবি সম্বন্ধে তার মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ছয় দফা কর্মসূচী কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে। এমন কি তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তাহা হলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না। এদের এই ধরনের কাজেই তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ধরা পড়ে গেছে জনগণের কাছে। জনগণ জানে এই দলটির কিছু সংখ্যক নেতা কিভাবে কৌশলে আইয়ুব সরকারের অপকর্মকে সমর্থন করছে। আবার নিজেদের বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে এরা জনগণকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে। এরা নিজদেরকে চীনপন্থী বলে থাকেন। একজন এক দেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থী, প্রগতিবাদী হয়? আবার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিৎকার করে।’

এই বামপন্থীরা ছিলেন সুবিধাবাদী। এমনকি মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছিলেন।তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলেন। যে লোকের যে মতবাদ সেই লোকের কাছে সেই ভাবেই কথা বলেন। বামপন্থীদের ভেতর সত্য বলার সাহস না থাকায় বঙ্গবন্ধু এভাবেই মন্তব্য করেছেন। তিনি গণতন্ত্রের পথে দেশের মঙ্গল করতে চেয়েছেন বলেই পাকিস্তানি শাসকের কাছে দাবি উপস্থাপন করেছিলেন।তিনি জানতেন আওয়ামী লীগ কর্মীরা আর ছাত্র তরুণ কর্মীরা কাজ রাজপথে আছে। বেপরোয়া গ্রেফতারের পরও ভেঙে পড়েনি।

৬ দফার সংগ্রাম ছিল-‘ ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম। যথেষ্ট নির্যাতনের পরেও আওয়ামী লীগ কর্মীরা দেশের আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই। ...আমার বিশ্বাস আছে আওয়ামী লীগের ও ছাত্রলীগের নিঃস্বার্থ কর্মীরা, সাথে আছে। কিছু সংখ্যক শ্রমিক নেতা-যারা সত্যই শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন করেÑতারাও নিশ্চয়ই সক্রিয় সমর্থন দেবে। এত গ্রেফতার করেও এদের দমাইয়া দিতে পারে নাই। ৭ই জুন হরতালের জন্য এরা পথসভা ও মিছিল বের করেই চলেছে। পোস্টার ছিড়ে দিলেও নতুন পোস্টার লাগাইতেছে, প্যামফ্রেট বাহির করছে। সত্যই এতটা আশা আমি করতে পারি নাই। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। জনমত আমার জানা আছে। (৫ই জুন ১৯৬৬)

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়। এজন্য তাঁর দৃষ্টিতে-‘আওয়ামী লীগ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুব কর্মীরা হরতালকে সমর্থন করে পথ সভা করে চলেছে। মশাল শোভাযাত্রাও একটি বের করেছে। শত অত্যাচার ও নির্যাতনেও কর্মীরা ভেঙে পড়ে নাই। আন্দোলন চালাইয়া চলেছে। নিশ্চয়ই আদায় হবে জনগণের দাবি।’(৬ই জুন ১৯৬৬)

১৯৬৬ সালের ৭ই জুন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দিবস। দিনটি নিয়ে কারাগারের রোজনামচায় আছে বিস্তারিত বিবরণ-‘শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলেছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে।...কিছু লোক গ্রেফতার হয়ে জেল অফিসে এসেছে। তার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাই বেশি। রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। ১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয়দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায়- এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।...গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। ...কি হবে? কি হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে, নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে। এমনিভাবে দিন শেষ হয়ে এল। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা জেলে আছি। তবুও কর্মীরা, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে, তাদের জন্য ভালবাসা দেওয়া ছাড়া আমার দেবার কিছুই নাই।’

বঙ্গবন্ধু ৭ জুন লিখেছেন-কর্মীরা, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। লেখাবাহুল্য, সমাজে ক্ষমতাহীন, নিপীড়িত জনতা ছিল আন্দোলনের মূল শক্তি। এজন্য ৮ই জুনের(১৯৬৬) লেখাও বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তিনি লিখেছেন-‘ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাত ভর গ্রেফতার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। সকালেও জেল অফিসে বহু লোক পড়ে রয়েছে। প্রায় তিনশত লোককে সকাল ৮টা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ বৎসর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সের লোকও আছে। কিছু কিছু ছেলে মা মা করে কাঁদছে। এরা দুধের বাচ্চা, খেতেও পারে না নিজে। কেস টেবিলের সামনে এনে রাখা হয়েছে। সমস্ত দিন এদের কিছুই খাবার দেয় নাই। অনেকগুলি যুবক আহত অবস্থায় এসেছে। কারও পায়ে জখম, কারও কপাল কেটে গিয়াছে, কারও হাত ভাঙ্গা এদের চিকিৎসা করা বা ঔষধ দেওয়ার কোনো দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ।

গ্রেফতার করে রাখা হয়েছিল অন্য জায়গায়, সেখান থেকে সন্ধ্যার পর জেলে এনে জমা দেওয়া শুরু করে। দিনভরই লোক আনছিল, অনেক। কিছু সংখ্যক স্কুলের ছাত্রও আছে।...জেল কর্তৃপক্ষ কোথায় এত লোকের জায়গা দিবে বুঝে পাই না! ছোট ছোট ছেলেদের আলাদা করে রাখতে হয়। এরা জেলে আসার পরে খবর এল ভীষণ গুলিগোলা হয়েছে, অনেক লোক মারা গেছে তেজগাঁ ও নারায়ণগঞ্জে। সমস্ত ঢাকা শহরে টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে, লাঠিচার্জও করেছে। ...যারা মারা গেল তাদের ছেলেমেয়ে, মা-বাবা তাদের কি হবে? কত আশা করে তারা বসে আছে, কবে বাড়ি আসবে তাদের বাবা। কবে আসছে তাদের ছেলে। রোজগারের টাকা আসবে মাসের প্রথম দিকে। এরা জেলে বন্দি, সহসা আর ফিরে যাবে না, টাকাও আর পৌঁছবে না সংসারে। একথা ভেবে ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছি আমি। কিছুতেই মনকে সান্ত¦না দিতে পারছি না। কেন মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য পরের জীবন নিয়ে থাকে? তবে এদের ত্যাগ বৃথা যাবে না। এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করবার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কৃষকরা কাজ বন্ধ করেছে। ব্যবসায়ীরা দোকান পাট বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্ররা স্কুল কলেজ ছেড়েছে। এতবড় প্রতিবাদ আর কোনোদিন কি পাকিস্তানে হয়েছে?’

স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল, শ্রমিক-কৃষক-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ছাত্র-জনতা।সেদিনকার প্রতিবাদ দিবস হয়ে উঠেছিল নিম্নবর্গ জনগোষ্ঠীর আন্দোলন। পাকিস্তানিরা বাংলার নির্যাতিত গরিব জনসাধারণকে শোষণ যে বেশি দিন করতে পারবে না, সে কথাও বঙ্গবন্ধু জানতেন।বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর মতে, ‘পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণীর ছয়দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত।’

৪.
বঙ্গবন্ধুর নিজের বিবরণ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ৬ দফার দাবিনামার মধ্য দিয়ে নিম্নবর্গ আন্দোলনের কেন্দ্রে চলে আসে। যারা সংগ্রামে একটানা সংযুক্ত থাকে। ৬ দফার দাবিগুলো ছিল ন্যায়সংগত আর এজন্য তা জনসমর্থন পায়। ৭ই জুন শহীদদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ছয় দফার দাবি বাঙালির মুক্তির সনদে পরিণত হয় এবং এদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রস্তুত করে দেয়। আর মুক্তিযুদ্ধও ছিল জনযুদ্ধ তথা নিম্নবর্গ মানুষের আত্মত্যাগের যুদ্ধ।

লেখক : ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন