ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে মুক্তির উপায়
করোনার ভয়াবহতার ভেতরে নতুন করে দুঃসংবাদ হয়ে এসেছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের আক্রমণ। কিন্তু যতটা প্রচার ও প্রচারণার কারণে জনমনে এটা আতঙ্ক তৈরি করছে বা আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে এটা কি ততটা গুরুত্ব পাওয়ার মতো বিষয়? এটা নিয়ে যে আতঙ্ক বা আলোচনা চলমান আছে তা কতটাই বা বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষার দিক থেকেই বা যৌক্তিক?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের আলোচনাটা সামনে এসেছে মূলত আমাদের পাশের দেশ ভারতে এ রোগে দেখা দেয়ার পর থেকে।অনেকের ধারণা করোনার ভারতীয় ভ্যারিযেন্ট এর সাথে এর বোধ হয় কোন সম্পর্ক আছে! আর যদি তাই হয় তাহলে পাশের দেশ হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের এখানে এ ভ্যারিয়েন্ট আসবেই। যদি সেটা আসে তাহলে আমাদের এখানেও করোনার ভারতীয় ভ্যারিযেন্ট এর সাথে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের আক্রমনও শুরু হবে! আমার ধারণা দুইয়ে দুইয়ে এ চার মিলিয়েই হয়ত ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রান্ত আলোচনা এতটা সামনে এসেছে।
এদিকে সম্প্রতি আমাদের দেশে বারডেমে ভর্তি হওয়া ৩ জন করোনা রোগীর দেহে নাকি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন।তবে, এটা মুখে মুখে বলা হলেও পরীক্ষা করে কিন্তু নিশ্চিত করা হয় নি। কারণ পরীক্ষার রিপোর্ট এখনও হাতে আসেনি।রিপোর্ট হাতে আসলে নিশ্চিত করে বলা সম্ভবপর হবে যে সত্যিই করোনা আক্রান্ত ঐ ব্যক্তির দেহে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমন হয়েছিলো কিনা! তারপরেও যদি আমরা এ তথ্যকে একদম সঠিকভাবেই ধরে নিই (কারণ বারডেম থেকে যেহেতু বলা হয়েছে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করে)তাহলেও কি এটা আতঙ্কের কোন বিষয় হয়ে উঠবে? এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে –না। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। নিজেই একবার ভাবুন তো-ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশে কত মানুষ এ অবধি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন সে তুলনায় ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ কতটা হয়েছে? খুবই খুবই কম। তাই না?এ কারেণেই বলছি যে এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া ঠিক হবে না। বরং করোনার সংক্রমণ যেন না হয় সেদিকেই আমাদেরকে খেয়ার রাখতে হবে বেশি করে।
দেখুন প্রকৃতিতে অসংখ্য ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস বা ছত্রাক, অনুজীবী এবং পরজীবী ইত্যাদির উপস্থিতি রয়েছে। প্রকৃতি থেকেই মূলত এরা আমাদের শরীরে অনুপ্রবেশ করছে। মাটি, পানি, খাবার বা বাতাসের মাধ্যমে এসব অনুজীব বা পরজীব আমাদের শরীরে ঢুকছে। কিন্তু তাতে কি আমরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছি? হচ্ছি না তো? তাহলে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা ছত্রাক নিয়ে আমরা এত চিন্তিত কেন হচ্ছি? আমি এটাও বলছি না যে এটা নিয়ে চিন্তার কোন বিষয় নেই। তবে, সেটা নিয়ে মূলত চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ চিন্তাভাবনা করবে যে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি কেন ও কিভাবে এ ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়েও তারাই ভাববে। সর্বসাধারণের মধ্যে এ নিয়ে অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।কারণ করোনার এ সময়ে নতুন করে আর একটা মানসিক উদ্বেগ ও উত্তেজনা তৈরি না হওয়াটাই যৌক্তিক।
আমরা জনি সকলেই-ব্ল্যাক ফ্যাঙ্গাসের সংক্রমণের বিষয়টি সামনে এসেছে মূলত ইন্ডিয়াতে এ রোগ আক্রান্ত রোগীর তুলনামূলক সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে। তার মানে হচ্ছে- আগেও এ রোগটি হতো। তবে সংখ্যায় ছিলো কম।ফলে এ নিয়ে কোন আলোচনাই হতো না।সে যাই হোক- এখন এর হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে যে কারণগুলোকে দায়ী করা হচ্ছে প্রধানত সেগুলো হচ্ছে-প্রথমত রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া। দ্বিতীয়ত করোনা রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য স্টেরয়েডের ব্যবহার আর তৃতীয়ত বলা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কথা।
অবশ্য ইন্ডিয়াতে এ প্রশ্নও উঠেছে যে, এতদিন ধরে এসব রোগীর চিকিৎসা তো এভাবেই চলে আসছিলো। তাহলে হঠাৎ করে সেখানে ব্ল্যাক ফ্যাঙ্গাসের উচ্চ সংক্রমণের পেছনে তাহলে আরও কি কোন কারণ আছে? অনেক চিকিৎসক তাই প্রশ্ন তুলছেন শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত অক্সিজেন এখন সেখানকার হাসপাতালগুলোতে ব্যবহারের ফলে কি এটা ঘটছে? যদিও এ প্রশ্নসহ ব্ল্যাক ফ্যাঙ্গাসের সংক্রমণের পেছনে সত্যিই কি কারণ রয়েছে সেটা নিয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে। সামনে হয়ত বিষয়টা পরিষ্কার করে জানা যাবে।
তাহলে এ থেকে মুক্তির উপায় কি? মুক্তির উপায় হচ্ছে-ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারে যারা ভুগছেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের দুর্বল. দীর্ঘদিন ধরে যারা স্টেরয়েড খাচ্ছেন, কেমোথেরাপি পাচ্ছেন তাদের যেন করোনা সংক্রমণ না হয় সেদিকে পরিবারের সকলকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের থাকার রুম ভালো করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।ঘরে থেকেই প্রতিদিন একটু শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে। তাহলে সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে।
আসুন ব্ল্যাক ফ্যাঙ্গাসের সংক্রমণ নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা না করে সামগ্রিকভাবে আমরা নিজে এবং পরিবারের সদস্যদেরকে করোনা থেকে কতটা মুক্ত রাখতে পারি সেদিকেই বরং বেশি মনোযোগী হই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ, সাভার।
এইচআর/জিকেএস